মুরাদ হাসানের ঘটনায় রাজনীতিকদের জন্য বার্তা আছে

0

সালাহ উদ্দিন জসিম॥ বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সদ্যসাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের আচরণে বিব্রত ও লজ্জিত আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে দলটির পক্ষ থেকে তাকে সব পর্যায় বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির আসন্ন সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, রাজনীতিবিদদের শালীনতা ও সৌজন্যবোধের শিক্ষাটা নিতে হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সৌজন্যবোধের অন্যতম দৃষ্টান্ত। সেখান থেকেই এ পাঠটা নেওয়া যায়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, অশালীন-অনৈতিকতার মধ্যে কেউ থাকলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এটাই বাস্তব। অনৈতিক কাজ করে কেউ পার পাবে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের মতো দলের মধ্যে থেকে। আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, মুরাদ হাসানের বিষয়ে আমরা বিব্রত ও লজ্জিত। কোনো পর্যায় থেকেই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। এটা তার প্রাপ্য ছিল। প্রধানমন্ত্রী যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি বলেন, নারীর সম্মান রক্ষার্থে বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদেরআবাসিক হল নিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটা সমাজের জন্য, সবার জন্য একটি মেসেজ। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। মুরাদ হাসানের চূড়ান্ত পরিণতি সময়ই বলে দেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সব মানুষের সৌজন্যবোধ, শালীনতাবোধ, শিষ্টাচার বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করা উচিত। বিশেষ করে যারা রাজনীতিতে আছেন, তারা তো মূলত মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন। অতএব সেখানে মানুষকে সম্মান দেওয়া, মর্যাদা দিয়ে কথা বলা, সৌজন্যবোধ ও শালীনতার মধ্যে আচার-আচরণ করা— এ শিক্ষাটা আমাদের রাজনীতিবিদদের নিতে হয়। তিনি বলেন, এ শিক্ষাটা নতুন করে নেওয়ার কথা আমরা বলি না। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর দেশ। বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্মের প্রতি যদি তাকাই। বঙ্গবন্ধু সারা পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক ছিলেন। তিনিও ঔপনিবেশিক আমলে শাসকসহ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছেন। তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর রচিত তিনটি গ্রন্থে— অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়া চীন- এর পাতায় পাতায় যেমন আছে। তেমনি তিনি যে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আমলে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে যতদিন বেঁচে ছিলেন, সেই সময়েও যত বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে সৌজন্য ছিল। ‘আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে আমাদের সৌজন্য পাঠ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যে রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয়; বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তাদের নেতাকর্মীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবনপাঠ অবশ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে আমি মনে করি।’- যোগ করেন ঢাবির এ অধ্যাপক।
এ বিষয়ে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘রাজনীতিবিদদের জন্য মেসেজ হচ্ছে, আপনি যখন রাজনীতি করেন, তখন আপনার প্রতিটা পদক্ষেপ এমন হওয়া উচিত যে, মানুষ যেন আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে ও শিখতে পারে। আর যদি আপনি এমন অবস্থা তৈরি করেন, যেখানে জবাবদিহির কোনো বালাই নাই, যেখানে আপনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে আছেন, তখন সেটার ‘ছাপ’ কিন্তু সর্বত্রই পড়ে। এটা একটা নোংরা সিস্টেম যা, গত কয়েক বছর ধরেই চলছে। মুরাদ হলেন তার অংশমাত্র। মুরাদ বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। তিনি বলেন, আমরা এ সরকারকে ভোটছাড়া ক্ষমতায় থাকতে দেখেছি। আমরা দেখেছি কীভাবে এ সরকার পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করে ম্যানুপুলেট করে ক্ষমতায় আছে। যখন আপনি এভাবে টিকে থাকেন, তখন আপনার মধ্যে একটা স্বেচ্ছাচারিতা তৈরি হয় যে, আমি যেকোনো কিছু করতে পারি, যা ইচ্ছা তা করতে পারি। মুরাদের কথাগুলো ঠিক তাই। তা নাহলে সে যখন একজন নারীকে ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছিল, তখন সে রাষ্ট্রীয় সংস্থার নাম ব্যবহার করেছিল। তার মানে এই গোটা সিস্টেমটা যে পচে গেছে, এটা হচ্ছে তার একটা উদাহরণ। ‘সমাধানে পুরো সিস্টেমটাই ঠিক হতে হবে। পুরো সিস্টেম ঠিক না হলে তো হবে না। কারণ এটা মনে রাখতে হবে যে, মুরাদ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।’ যোগ করেন এ সংসদ সদস্য।
অশালীন মন্তব্য ও কটূক্তির কারণে গত সোমবার (৬ ডিসেম্বর) রাতে ওবায়দুল কাদের তার বাসভবনে ডা. মুরাদ হাসানের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, আজ (সোমবার) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি মুরাদ হাসানকে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। রাত ৮টায় মুরাদ হাসানকে এ বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এরপর মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে পাঠান ডা. মুরাদ। পরে বিকেল ৩টায় তার পক্ষে পদত্যাগপত্রটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দপ্তরে জমা দেন তথ্য প্রতিমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। এরপর ঢাকা ত্যাগ করে দুই দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি।