নিষেধাজ্ঞার পরেও শতাধিক বাল্ক হেডে মোংলা বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন হচ্ছে

0

মনিরুল হায়দার ইকবাল, মোংলা (বাগেরহাট) ॥ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বাল্ক হেডে পণ্য পরিবহন নিষিদ্ধ থাকলেও মোংলা বন্দরে বছরের পর বছর ধরে তা উপেক্ষিত হয়ে আসছে। এক শ্রেণির অসাধু পরিবহন ঠিকাদার সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে দিনের পর দিন নিষিদ্ধ বাল্ক হেডের মাধ্যমে জাহাজ থেকে নামানো সার, কয়লা, ক্লিংকারসহ বিভিন্ন পণ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবাধে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। এতে করে পরিবহন ঠিকাদাররা (ক্যারিয়ার কোম্পানি) আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেলেও মোটা অংকের টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন কার্গো ও লাইটার মালিকরা। এ ছাড়া বাল্ক হেডে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে পণ্য পরিবহন করায় বাড়ছে নানা দুর্ঘটনা। আর এ দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ ১৫ নভেম্বর রাতে এ চ্যানেলের হারবাড়িয়া এলাকায় বিদেশি জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে গেছে কয়লা বোঝাই একটি বাল্কহেড। এতে ওই বাল্ক হেডের তিন কর্মচারীর মৃত্যু ঘটে ও দু’জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। দুর্ঘটনার শিকার এ নৌযানটির চলাচলের জন্য নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কোন সার্ভে সনদ ও পণ্য পরিবহনের কোন অনুমোদন ছিল না।
এদিকে পশুর চ্যানেলে বাল্ক হেডের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন নিষিদ্ধ থাকলেও শতাধিক বাল্ক হেডে দেদারছে মোংলা বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেদারছে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এসব বাল্ক হেডের চলাচল বন্ধে সরকারের কোন সংস্থাই নিজেদের দায় নিতে নারাজ। এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেরা কোন দায় নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। জানা গেছে, বাল্ক হেডে পণ্য পরিবহন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার মূল দায়িত্বে রয়েছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। অথচ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেদের দায় এড়িয়ে এর দোষ চাপাচ্ছেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ আর বিআইডব্লিউটিএ’র ওপর। আবার মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এর দায় চাপাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের ওপর। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ এর দায় চাপাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের ওপর। এই তিন সংস্থার সমন্বয়হীনতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বন্দরের পশুর চ্যানেলে দিনের পর দিন অবাধে বাল্ক হেডে ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র জানায়, ১৬ হর্স পাওয়ারের নিচে ও এক হ্যাচ বিশিষ্ট বাল্ক হেড পণ্য পরিবহন নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে নিষিদ্ধ। এ বাল্ক হেড বালু ছাড়া অন্য কোন পণ্য পরিবহন করতে পারবে না। এ ছাড়া বাল্ক হেডের চলাচলে নিজস্ব কোন যোগাযোগ (যান্ত্রিক বার্তা আদান-প্রদান) ব্যবস্থা নেই। এসব কারণে ঝুঁকি থাকায় পশুর চ্যানেলে বাল্ক হেডে পণ্য পরিবহন কঠোরভাবে নিষিধ রয়েছে। অথচ এ নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে দেদারছে বন্দর থেকে সার, কয়লা, ক্লিংকারসহ নানা পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এদিকে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার সম্মুখিন হয়েছে যেসব নৌযান তার কোনটিরই সার্ভে সনদ ছিল না বলে মোংলা বন্দরের হারবার বিভাগ নিশ্চিত করেছে। এভাবে চলতি বছরের ১১ মাসেই পাঁচটি নৌযান ডুবির ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার শিকার এসব নৌযান চলাচলের জন্য নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কোন সার্ভে সনদ ছিল না। মোংলা বন্দর চ্যানেলে চলতি বছরে মোট পাঁচটি নৌযান ডুবির ঘটনা ঘটে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ৭৫০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে এম ভি বিবি-১১৪৮, ৩০ মার্চ ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে এম ভি ইফসিয়া মাহিন, ৮ অক্টোবর ১২০০ মেট্রিক টন পাথর নিয়ে এম ভি বিউটি অব লোহাগড়া-২, একই দিনে ৮৫২ মেট্রিক টন ড্যাপ সার নিয়ে এম ভি দেশ বন্ধু এবং সর্বশেষ ৩৭০ মেট্রিক টন নিয়ে কয়লা নিয়ে গত সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাতে হাড়বাড়িয়া এলাকায় ডুবে যায় ফারদিন-১ নামে একটি বাল্ডহেড। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বাকি দু’জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহলের নেপথ্যেও সহযোগিতায় নিষিদ্ধ থাকলেও দিনের পর দিন বন্দর থেকে বাল্ক হেডে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এ বাল্ক হেডে পণ্য পরিবহনে প্রধান ভূমিকায় রয়েছে ক্যারিয়ার কোম্পানিগুলো। কোর্গো বা লাইটারেজ আমদানিকৃত পণ্য জাহাজ থেকে পরিবহনের নিয়ম থাকলেও আমদানিকারক ও কার্গো মালিক গ্রুপের নিয়োগকৃত এক শ্রেণির অসাধু ক্যারিয়ার কোম্পানি বাল্ক হেডের মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে পণ্য পরিবহন করিয়ে থাকে। সূত্র জানায়, মোংলা বন্দরের দিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে প্রায় শতাধিক বাল্ক হেডের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা হয়ে থাকে। খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব অহিদুজ্জামান খান পল্টু অভিযোগ করে বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএ’র উদাসীনতাকে পুঁজি করে প্রায় ১০টি ক্যারিয়ার কোম্পানি এই বাল্ক হেডের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করে থাকে। তুলনামূলকভাবে বাল্ক হেডে পণ্য পরিবহনে ব্যয় কিছুটা কম হওয়ায় ক্যারিয়ার কোম্পানিগুলো বাল্ক হেডে পণ্য পরিবহন করিয়ে নিজেরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছে। আর এতে করে কার্গো ও লাইটারের মালিকরা পণ্যেও অভাবে ভাড়া না পেয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মখুন হচ্ছেন। নৌপরিবহনের এই নেতা অবিলম্বে অবৈধ বাল্ক হেডকে পণ্য পরিবহন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের খুলনার যুগ্ম পরিচালক মো. আশরাফ হোসেন বলেন, বাল্ক হেড চলাচল নিয়ন্ত্রণে তাদের কোন ভূমিকা নেই। এ গুলো নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বন্দর কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বন্দর এলাকায় এসব বাল্ক হেড তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না বা এগুলো তাদের পাইলটরা পরিচালনা করেন না। এগুলোর কোন রুট পারমিটও নেই।
নৌপরিবহন দপ্তরের আঞ্চলিক নৌযান সার্ভে এন্ড রেজিস্ট্রেশনের মোংলার পরিদর্শক মো. আবুল কাসেম ফজলুল হক জানান, ব্লাক হেডসহ অন্যান্য অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে তারা তৎপর থাকেন। মাঝে মধ্যেই এসব নৌযানের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। এরপরও লোকবল ও জলযানের অভাবে সব সময় তারা অভিযান পরিচালনা করতে পারেন না। অপরদিকে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পরিচালক বদরুল হাসান লিটন বলেন, ‘পণ্য পরিবহনের জন্য বিভিন্ন নৌযানের সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন আমরা দিয়ে থাকি, কিন্তু যেসব নৌযান সার্ভে সনদ না নিয়ে নদীতে চলাচল করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেওয়া দায়িত্ব শুধু আমাদের একার নয়।’ তিনি দাবি করেন, পুলিশ, কোস্টগার্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএ অবৈধভাবে চলা নৌযানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মেরিন কোর্টে মামলা দিবে। আর সার্ভে সনদ না থাকা নৌযানের বিরুদ্ধে ৩৩ ধারায় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আছে বলেও জানান তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বন্দর ব্যবহারকারী জানান, মোংলা বন্দর ব্যবহারে প্রতিটি নৌযানকে বন্দরের পোর্ট ডিউজ দেয়া বাধ্যতামূলক। বন্দরে আগত নৌযানসমূহের পোর্ট ডিউজ নেয়ার সময় সংশ্লিষ্টরা নৌযানের কাগজপত্র যাচাই করে থাকে। বাল্ক হেডের পোর্ট ডিউজ নেয়ার সময় বন্দরের অসাধুু স্টাফরা উৎকোচ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা সত্তেও ওই নৌযানের বন্দরে চলাচলে অনুমতি দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার শেখ ফকর উদ্দীন বলেন, নৌযানের সার্ভে সনদসহ চলাচলের অনুমতি দেখার দায়িত্ব বন্দর কর্তৃপক্ষের নয়। এরপরও বাল্ক হেডসহ অবৈধ নৌযানে পণ্য পরিবহন বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নৌপরিবহন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলকে বার বার বলা হলেও তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তিনি এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।