এত ফুল ঝরেনি কখনো

0

॥ সায়েম সাবু ॥
সুতোয় বাঁধা যে প্রাণ, মহাকালের ডাকে তাতে টান পড়বেই। বিষময় সময় যেন অভিশপ্ত করে তুলছে মানবজনম। এমন পৃথিবী দেখেনি কেউ আগে। করোনার বিষবাষ্পে থমকে গেছে গোটা জনপদ। জীবনের ছন্দে সেই যে পতন ঘটলো, তা দু’বছর ধরে টালমাটাল। কবে স্বাভাবিকতায় ফিরবে সময়, কবে প্রাণের উচ্ছ্বাসে মিলবে প্রাণ, তা এখনো অনিশ্চয়তায়। প্রস্থানেই আগমনের সুর। নতুন দিয়েই শূন্যস্থান পূরণ। কিন্তু এত শূন্য পুরিবে কীসে? রোজ শোকের চাদরে ঢেকে যাচ্ছে সাজানো ফুলের বাগান। এত ফুল ঝরেনি কখনো! মাত্র দু’বছর। অথচ হারানোর বেদনায় যেন সময় পিছিয়েছে হাজার বছর। করোনার হানায় মরছে মানুষ। স্বাভাবিক মৃত্যুও দীর্ঘ করছে শোকের এই মিছিল।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ – ১৪ মে ২০২০), প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী (১৫ নভেম্বর ১৯৪৩ – ২৮ এপ্রিল ২০২০) লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ (২৩ অক্টোবর ১৯৪৬–২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১), গবেষক শামসুজ্জামান খানের (২৯ ডিসেম্বর ১৯৪০ – ১৪ এপ্রিল ২০২১) মতো গুণীরা চলে গেলেন এই দুঃসময়েই। সবশেষ অনুরাগীদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকও। প্রজন্ম থেকেই প্রজন্ম। অথচ, তারা বিদায়বেলায় যে গহ্বর তৈরি করে গেলেন, তা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।
বন্ধুবর সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে হারিয়ে শোকে বিহ্বল শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বলছিলেন, ‘এমন দুঃসময় মানব সভ্যতায় আর কখনো আসবে কি না জানা নেই। খুব একা হয়ে যাচ্ছি। মানুষ সামাজিক জীব। সম্পর্ক, সমাজ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আর এখন বেঁচে থাকতেই মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে। সম্পর্কের এই দূরত্ব অনেকেই মানতে পারছেন না। চলে যাচ্ছেন মহাকালের টানে।’ তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞজনেরা যারা চলে গেলেন, তাদের সবার সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। তারা খুব আপন ছিলেন। আমি খুব গভীরভাবে শূন্যতা অনুভব করছি। কাছের মানুষেরা চলে গেলে বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আর করোনাকালের একাকিত্ব এক মহাবিপর্যয়ের সূচনা করেছে। মানুষ মরছে বলেই নয়। মূলত, করোনা থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে, নিজেকে লুকিয়ে রাখা। মানুষ থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন থাকলে হতাশা-নিরাশা গেঁড়ে বসে।’ এই সমাজ বিশ্লেষক বলেন, ‘ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, যেই মাপের মানুষ চলে গেলেন সেই মাপের মানুষ হয়তো আর আসবে না। আর শিল্প-সাহিত্যচর্চার জন্য সমাজ-রাষ্ট্রের যে দায়, তাও উবে গেছে বহু আগে। জ্ঞানের চর্চার মূল্য এখন তলানিতে। এমন একটি সমাজে আমরা বাস করছি যেখানে টাকার মানদণ্ডে সব নির্মিত হয়। এই জায়গা থেকে বের হতে হলে আমাদেরকে পুঁজির ঘের থেকে বের হয়ে আসতে হবে। করোনাভাইরাসের নিকৃষ্টতম আঘাত থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি। টিকা বা বড়ি আবিষ্কার করলেই করোনার মতো আঘাত মোকাবিলা সম্ভব নয়। আমাদের মূলে যেতে হবে। প্রকৃতির ওপর জুলুম চালালে এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে পৃথিবীকে। চলমান ব্যবস্থা বদলাতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শোক জানিয়ে বলেন, ‘করোনার সময় অনেক অভিভাবকতুল্য প্রিয়জনকে হারালাম। অনেকে হয়তো স্বাভাবিক মৃত্যুতেও চলে গেলেন। কিন্তু হারানোর বেদনা খুব ভারি হলো। লেখক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষ বিদায় নিলেন এই সময়ে। তাদের শূন্যস্থান পূরণ করার মতো মানুষ সমাজ তৈরি করতে পারেনি। অনেকেই জ্ঞানের চর্চা করছেন, করবেন। কিন্তু তাদের অভাব পূরণ হওয়ার নয়। কেননা, প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র।’ ‘তবে এই শোকের মাতম কাটিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। পৃথিবী সাজাতে হবে আমাদেরই। করোনা মানবিক যোগাযোগটা অনেক দুর্বল করে ফেলছে। এই দুর্বলতা কাটাতেই হবে’—বলেন এই শিক্ষাবিদ।