জিরো লাইনের কাছে এত মাদক কারখানা কেন?

0

॥বিশেষ সংবাদদাতা॥
ভারতীয় সীমান্তের জিরো লাইন থেকে মাত্র ৫০ মিটারের মধ্যেও পাওয়া গেছে ইয়াবার কারখানা। সীমান্ত এলাকায় এমন তিনটি ইয়াবা ও ২০টি ফেনসিডিল কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। যেগুলোতে উৎপাদিত মাদক সহজেই ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে এসব কারখানার ঠিকানা, জিরো লাইন থেকে দূরত্ব, কারখানা মালিকের নাম ও উৎপাদিত মাদকের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ভারতকে দিয়েছে বাংলাদেশ। মূলত মিয়ানমারে তৈরি ইয়াবা ভারত হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। এতে ধরা পড়ার ঝুঁকি বেশি। মাদক কারবারিদের লাভও কম। এ কারণে ভারতীয় মাদক কারবারিরা নিজেরাই সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা বানানো শুরু করেছে।
গত ২৮ অক্টোবর ভারতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর (এনসিবি) সঙ্গে বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)-এর ডিজি পর্যায়ের ভার্চুয়াল সম্মেলন হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে এসব কারখানা বন্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে মাদক পাচারের জন্যই ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, হিমাচল, দার্জিলিং, মুর্শিদাবাদ, রাজনগর, জলপাইগুড়ি, ত্রিপুরার সীমান্ত ঘেঁষে এসব কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, কোচবিহার ও উত্তর চব্বিশ পরগনা সীমান্তে তিনটি ইয়াবা কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এরমধ্যে একটি জিরো লাইন থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে। বাকি দুটি ৪০০ মিটার ও ৫ কিলোমিটারের মধ্যে। কোচবিহারের দিনহাটা চৌধুরীরহাট এলাকার খেতাবেরকুটি নামক সীমান্ত এলাকায় নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির ইয়াবা কারখানা আছে। জিরোলাইন থেকে ওটা ৪০০ মিটার দূরে। এ কারখানায় তৈরি ইয়াবার চালান একাধিকবার বাংলাদেশের ধরা পড়েছে। জিরোলাইন থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে ইয়াবা কারখানাটির দিয়েছে একই এলাকার আল-আমিন ইসলাম। অপর কারখানাটি উত্তর চব্বিশ পরগনার সরুপনগর সীমান্তবর্তী এলাকা আমুদিয়ায়। ডিম পাল নামের এক ব্যক্তি এটার মালিক। জিরোলাইন থেকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ওটার অবস্থান। ভারতে কাঁচামাল ও রাসায়নিক সহজে পাওয়া যায় বলেই সীমান্তের ঠিক ওপারেই এসব কারখানা গড়ে উঠছে।
ফেনসিডিল কারখানা
সীমান্তের উল্লিখিত এলাকাগুলোতে অন্তত ২০টি ফেনসিডিল কারখানার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ। উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁও এলাকায় শ্রী দাকু একটি ফেনসিডিল কারখানার মালিক। সে বনগাঁও পৌরসভার মেয়র। সীমান্তের সাড়ে তিন কিলোমিটারের মধ্যে ফেনসিডিল কারখানা তৈরির উদ্দেশ্য—বাংলাদেশে পাচার করা। একই এলাকার বর্জ নামের আরেকজনের ফেনসিডিল কারখানা রয়েছে। কোচবিহারের দিনহাট চৌধুরীরহাটের সিদহালারকুটি এলাকায় সীমান্তের ১০০ মিটারের মধ্যে একটি ফেনসিডিল কারখানা রয়েছে। এর মালিক আলম মিয়ার ঠিকানা ও তথ্য এনসিবি’কে দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। একই এলাকার প্রতাপ সিং ও চব্বিশ পরগনার বনগাঁও থানার চন্দননগর রেলস্টেশনের শ্রী বন্দল নামের দুজনও সীমান্ত এলাকার চার কিলোমিটারের মধ্যে ফেনসিডিল কারখানা তৈরি করেছে। জিরোলাইন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটারের মধ্যে কারখানা আছে বনগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা শ্রী দেকুর। উত্তর চব্বিশ পরগনার বাগুইহাটির শ্রী শম্পুরও একটি কারখানা আছে সীমানার কাছাকাছি। তার নামে মাদক মামলা রয়েছে ভারতের বিভিন্ন থানায়। চব্বিশ পরগনার সরুপনগরের বিথারি সীমান্ত থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে ফেনসিডিল কারখানা বানিয়েছে উজ্জল হোসেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সূত্র জানিয়েছে, এসব কারখানা সীমান্তের এতই কাছে যে, এখানকার মাদক বাংলাদেশে ঢুকছে ঝামেলা ছাড়াই।
‘আমরা অন্য রাষ্ট্রের মাদকে আক্রান্ত’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেছেন, কেমিক্যাল উৎপাদন, ব্যবহার ও বাণিজ্যের দিক থেকে ভারতের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। আসাম, ত্রিপুরা, রাজস্থানসহ দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে কেমিক্যাল তৈরি হয়। রয়েছে বড় বাজারও। ইয়াবার কাঁচামাল সিউডোফেড্রিন বাংলাদেশ নিষিদ্ধ হলেও ভারতে তা বৈধ। ফেনসিডিলের কাঁচামালও ভারতে বৈধ। যে কারণে ওটা সহজেই মাদককারবারিদের হাতে চলে আসছে। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান কখনও আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। অনেক সময় তিনদেশের সীমান্ত বাহিনীর হাতে সেসব আটক হয়। এ কারণেও ভারতীয় কারবারিরা নিজেরাই সীমান্ত এলাকায় কারখানা খুলে বসেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক আব্দুস সবুর মন্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মাদক উৎপাদনকারী দেশ নই। ফেনসিডিল-ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল এ দেশে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমরা অন্য রাষ্ট্রের মাদকে আক্রান্ত।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে আমরা ভারতীয় সীমান্তে গড়ে ওঠা কিছু মাদক কারখানার ঠিকানা দেশটিকে দিয়েছিলাম। সেগুলো তারা ধ্বংস করেছে। আমরা আবার তথ্য দিয়েছি। দুটি দেশ একসঙ্গে কাজ করে মাদক নির্মূল করা যাবে।’ ডিজি আরও বলেন, ‘সমুদ্রপথে মাদকপাচারের বিষয়টিও তাদের জানিয়েছি। তাদের কাছে কোনও তথ্য থাকলে যেন শেয়ার করে সে অনুরোধও করেছি।’