লোকসমাজের প্রতীষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা-২

0

করোনা, বাল্যবিবাহ ও আগামীর বাংলাদেশ
নাজমুল আহসান

অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙালি সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় সমাজ ও সংস্কৃতির সংস্কারে আমাদের সবার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। মূলত তার উদ্যোগেই তৎকালীন ভারতে সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মা তিনি আমাদের কাছে বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি আমাদের সবার কাছে পরিচিত হলেও বাঙালি সামাজ সংস্কারে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ ইত্যাদির মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় সক্রিয় ছিলেন। তার সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি এই সামাজিক রীতিগুলোকে ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি বিদ্যাসাগর। এটা করতে গিয়ে তিনি ধর্মের সঙ্গে সমাজের ক্ষতিকর আচার বা রীতির মধ্যকার পার্থক্যকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন কিছু কিছু সামাজিক আচার বিশেষ করে নারীদের জন্য, মেয়ে শিশুদের জীবনে অভিশাপ হিসেবে ধরা দেয়। বেগম রোকেয়া বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণ, বিশেষ করে নারীশিক্ষার জাগরণে পথিকৃৎ ছিলেন। স্থান, কাল ও পাত্রের পরিবর্তন হলেও রাজ রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বেগম রোকেয়ার ভূমিকার যে প্রয়োজনীয়তা তা বোধকরি এখনো আমাদের সমাজ থেকে শেষ হয়ে যায়নি।
নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এখন মেয়েশিশুদের ভর্তির হার সন্তোষজনক। যদিও নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে বেশকিছু অগ্রগতি হলেও বাল্যবিবাহের অত্যধিক হার, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের নিম্নহার ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনো সমাজে অগ্রগতির জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আছে। বাল্যবিবাহের হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীতে চতুর্থ সর্বোচ্চ, এখনো দেশের ৫১ শতাংশ মেয়েশিশুর আঠারো বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। করোনার কারণে এই হার যে অনেক বেড়েছে তা সহজেই অনুমেয়। সম্প্রতি স্কুল খোলার পর, বাল্যবিবাহের ঘটনাগুলো একে একে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এ রকম একটি খবর খুলনার রূপসা উপজেলার এক স্কুলে কমপক্ষে ৭০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। শুধুমাত্র রূপসায় নয়, বাংলাদেশের সর্বত্রই প্রায় একই চিত্র যেখানে লকডাউন চলাকালীন মেয়েশিশুদের নির্বিঘেœ বাল্যবিবাহের কর্ম সম্পাদন করা হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, শুধুমাত্র কারোনার কারণে বাংলাদেশে অতিরিক্ত এক কোটি মেয়েশিশু বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা, পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক চাপ।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেকেই এখনো মেয়েশিশুদের বোঝা মনে করেন এবং মেয়েসন্তান বড় হওয়ার সময় নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাহীনতা, মেয়েসন্তানের প্রতি নেতিবাচক সামাজিক আচার ও রীতি, ও ছেলেসন্তানের মাধ্যমে বংশগতি রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। প্রেম, ভালোবাসায় জড়িয়ে যাওয়া ও লোকলজ্জার ভয় অনেক সময় অভিভাবকদের মেয়েকে শিশু অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দিতে প্রলুব্ধ করে বলে অনেকেই বলে থাকেন। অন্যদিকে প্রায়শই দারিদ্র্যকে বাল্যবিবাহের একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং নিঃসন্দেহে গত দেড় বছরের মহামারীর সঙ্গে লড়াইকালে অনেক আপাত অবস্থাপন্ন পরিবারের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে অনেকেই পড়াশুনা থেকে দূরে সরে গিয়ে ঘরের কাজে অধিক মাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাল্যবিবাহের পেছনে এই কারণগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য কিন্তু তার থেকে বড় কারণ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। সামাজিকভাবে আমরা এখনো আমাদের মেয়েসন্তানকে মানবসম্পদ হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। অধিকন্তু নারীদের শুধু ঘরের কাজে ও পরিবারের কাজে যুক্ত রাখার প্রচেষ্টাই এখনো প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।

শিশু অবস্থায় মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া বিভিন্ন কারণের একটি ফলাফল। বলাবাহুল্য এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের মতামতের বাইরে গিয়ে বা তার মতামত অগ্রাহ্য করেই তা সম্পাদন করা হয়। আমরা জানি মেয়েদের শিক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে মেয়েরা বেশ এগিয়ে। এর পেছ নে মূলত দুটি কারণকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে একটি হচ্ছে বাংলাদেশে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিস্তৃতি এবং মেয়েদের শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের প্রণোদনার ব্যবস্থা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বাল্যবিবাহের চিত্র আমাদের সামনে এই চিত্রই উন্মোচন করেছে যে, আমাদের দেশের অভিভাবকরা এখনো মেয়েদের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেন না বরঞ্চ বিভিন্ন উপলক্ষে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো কন্যাদানের ঘটনা ঘটছে। করোনাকালে মেয়েশিশুদের বাল্যবিবাহের হার বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন পর্যায় থেকে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল এবং অনেকে এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেনদরবার করে আ সছিল যাতে কারোনাকালে মেয়েশিশুদের বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর এটাই প্রমাণ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা এক্ষেত্রে কাজ করতে পারেনি। বাল্যবিবাহ বন্ধে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন আছে। এই আইনে বাল্যবিবাহকে আইনগত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিবাহ নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জন্ মনিবন্ধনের আবশ্যকতার কথা বলা হয়েছে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। যেখানে প্রভাবশালীদের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছেই, অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের উদ্যোগও যথেষ্ট না, বা বলা হচ্ছে, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সব ঘটনার পেছনে যদি অভিযোগই দায়ের করতে হয় তাহলে আইন বাস্তবায়নে নিজস্ব উদ্যোগগুলো কোথায়। আবার বাল্যবিবাহের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই জাল জন্মসনদ ও নিবন্ধনের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। বাল্যবিবাহের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে এটা মেয়েশিশুদের শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে বেশিরভাগ মেয়েশিশু শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে এবং সারা জীবনের জন্য পরনির্ভরশীল হয়ে যায়। শিক্ষার পাশাপাশি সমাজে উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ, সা মাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার অবদান ও সর্বোপরি যুগোপযোগী কর্মদক্ষতা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়। আর এভাবে সমাজে অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রেখে সামগ্রিকভাবে সামাজিক পশ্চাৎপদতা তৈরি করা হচ্ছে। প্রতি বছরের মতো এবারও গত ১১ অক্টোবর বি শ্বব্যাপী বিশ্ব মেয়েশিশু দিবস উদযাপন করা হয়। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে বিশ্ব নারী সম্মেলনের মাধ্যমে নারী ও মেয়েশিশুদের প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি নতুন করে সবার সামনে এলে মেয়েশিশুদের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বলাভ করে। পরবর্তী সময়ে সাধারণ পরিষদে কানাডার প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতিসংঘ ২০১২ সালে বিশ্ব মেয়েশিশু দিবস গ্রহণ করে। বাংলাদেশের অগ্রগতির এই সময়ে এখন সময় এসেছে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি পরিবারেরই সোচ্চার হওয়া। এজন্য স্থানীয় সরকার ও সরকারি প্রশাসনের এ নিয়ে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দারিদ্র্য ও নিরাপত্তার নামে বাল্যবিবাহ সংঘটনের দায় এড়িয়ে যাওয়া পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই প্রতিফলন। এখন সময় এসেছে এই মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা ও পরিবর্তন নিয়ে আসা।
লেখক : উন্নয়নকর্মী


প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চড়াই-উতরাই
পাভেল চৌধুরী

মানুষ সাংস্কৃতিক প্রাণী। মানুষের জীবনযাপন এবং উপভোগের নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে এই সংস্কৃতির প্রকাশ। যদিও সংস্কৃতি বলতে সুনির্দিষ্ট কি বোঝায় তার কোনো সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা মনীষী নানা ভাবে সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। তবে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সংস্কৃতি যে সাধারণ মানুষের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে এ ব্যাপারে বিতর্ক নেই বলা যায়। সেই হাতিয়ারের একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি হলো ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই তত্ত্ব। পাশাপাশি ‘জনগনের জন্য শিল্প’ নামেও একটা তত্ত্ব সাংস্কৃিতক জগতে ক্রিয়াশীল অছে; যারা মনে করেন মুষ্টিমেয় শাসক শ্রেণির পরিবর্তে ব্যপক অংশ জনগণই হবে নিজেদের প্রকৃত নিয়ন্তা, তারা এই তত্ত্বকে ধারণ করেন। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ আর ‘জনগণের জন্য শিল্প’ এই দু’টো তত্ত্ব নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশের লেখক শিল্পীরা নানা ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল প্রশ্নটি অবিচলই রয়ে গেছে; সৃজনশীলতা কার স্বার্থে? কিসের স্বার্থে? মানুষের মনোজগৎই হলো সংস্কৃতির উপনিবেশ। যখন সমাজের যে শ্রেণির হাতে সমাজ তথা দেশ শাসনের ছড়ি থাকে সংস্কৃতির উপনিবেশও থাকে তাদের দখলে। পুঁজিবাদি সমাজে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপুল সম্ভাবনাকে দলন করে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তাদের কায়েমি স্বার্থকে জারি রাখে আর এই কাজ করতে যেয়ে তাদের যেমন নানা ধরনের কৌশল আর শক্তি অর্জনের প্রয়োজন হয়, একই ভাবে মানুষের মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারেরও প্রয়োজন হয়। আধিভৌতিক বিশ^াস, অদৃষ্টবাদ, যন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব, জৈবিক বিকৃতি, ভোগ-সর্বস্ব জীবন ইত্যাদির প্রচার ও প্রসারই হলো মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারে তাদের হাতিয়ার। মানুষের নৈতিক শক্তিকে তারা ভয় পায়। তারা নিজেরা যেমন কোনো রকমের নৈতিকতার ধার ধারে না তেমন সমাজ থেকে নৈতিকতার উচ্ছেদ হলো তাদের অন্যতম লক্ষ্য। তারা চায় পুঁজির আধিপত্য। তাদের কাছে পুঁজিই হলো জাগতিক সবকিছুর একমাত্র বিচারিক মানদ-। যে কারণে ধনতান্ত্রিক সমাজে পুঁজির যে দাপট, সেই দাপট অন্য কোনো সমাজে দেখা যায় না। পুঁজির ধর্ম হলো বিকশিত হওয়া আর প্রাণ প্রকৃতির ধ্বংস সাধনই হলো এই বিকশিত হওয়ার প্রধান শর্ত। এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকশিত হওয়ার লক্ষ্যে ব্যপক অংশ নির্যাতিত মানুষের যে লড়াই, সে লড়াই একদিকে যেমন রাজনৈতিক আবার অন্যদিকে সাংস্কৃতিকও। এ লড়াই ঐতিহাসিককাল থেকে জায়মান।। উনবিংশ শতক থেকে এ লড়াইয়ের লক্ষ্য হয়েছে সুনির্দিষ্ট আর সে লক্ষ্য হলো পুঁজিবাদী সমাজের উৎখাত। রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের গুরুত্বও কোনো অংশে কম না। রজনৈতিক লড়াইয়ের উদ্দেশ্য যেমন পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উৎখাত তেমন সাংস্কৃতিক সংগ্রামের উদ্দেশ্য হল মনোজগৎকে পুঁজিতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা থেকে মুক্ত করা। উভয় ক্ষেত্রের এই লড়াই যদি সমন্বিত না হয় তবে কোনো ভাবে তার ফল ইতিবাচক হয় না।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে সমাজ পরিবর্তনের এই বিপ্লবী লড়াইয়ের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। রাজনৈতিক সংগ্রামের মতো সাংস্কৃতিক সংগ্রামও এই ইতিহাসের অংশিদার। গত শতকের ২০ এর দশকে কাজী নজরুল ইসলাম এই লড়াইয়ের সূত্রপাত করেন। তাঁর সম্পাদিত ‘নবযুগ’ ‘লাঙ্গল’ পত্রিকায় এবং তাঁর বিভিন্ন লেখায় তিনি উপনিবেশিক শক্তি আর সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন। যদিও তাঁর এই প্রচেষ্টা ছিল একক। তাঁর লেখার বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কোনো সংগঠিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন তিনি গড়ে তোলেননি। বলাবাহুল্য, সে চেষ্টাও তিনি করেননি। গত শতকের ত্রিশের দশকে যখন ভারতবর্ষে সাম্যবাদী রাজনীতি জোরালো হয়ে উঠেছিল তখন ঐ দশকের মাঝমাঝি সময়ে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলনও একটা সংগঠিত রূপ নিয়েছিল। ১৯৩৫ সালে গঠিত হয়েছিল প্রগতি লেখক সংঘ। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত হিন্দী সাহিত্যিক মুলুকরাজ আনন্দ, সাজ্জাদ জহীর, হিরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মুহাম্মদ বিন তাহের প্রমুখ। প্রগতি লেখক সংঘের প্রথম অধিশেন অনুষ্ঠিত হয় লক্ষৌতে, ১৯৩৬ সালে। সভাপতির ভাষণে বিখ্যাত সাহিত্যিক মুন্সি প্রেমচাঁদ বলেন, ‘আমাদের মাপকাঠিতে সেই সাহিত্য খাঁটি প্রমাণিত হবে যাতে উচ্চ চিন্তন আছে, স্বধীনতার ভাব আছে, সৌকর্যের সার আছে, সৃষ্টির আতœা আছে,জীবনের সত্যের অভিব্যক্তি আছে, যা আমাদের মধ্যে গতি, সংকট, আকুলতার উদ্রেক করে, ঘুম পাড়ায় না, কেননা এখন বেশি ঘুমান মৃত্যুর লক্ষণ’। প্রগকি লেখক সংঘের অনুরুপ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাট্যগোষ্ঠিগুলোকে নিয়ে ১৯৪৩ সালে মুম্বাইয়ে গঠিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন পৃত্থিরাজ কাপুর, বিজন ভট্টাচার্য, বলরাজ সাহানী, খাজা আহম্মেদ আব্বাস, ঋতিœক ঘটক, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, সলিল চৌধুরী, হাবিব তানভির, উদয় শংকর প্রমুখ। প্রগতি লেখক সংঘ ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘ সারা ভারতের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছিল বিপুল সংখ্যক অজ্ঞাত কিন্তু অসাধারণ গুণী শিল্পী সাহিত্যিক। বিশ শতকে যারা সাংস্কৃতিক জগতের বিভিন্ন শাখায় বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের প্রভাব এখনও অক্ষুন্ন আছে এবং বহুকাল পর্যন্ত অনড় থাকবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে প্রগতি লেখক সংঘ বা ভারতীয় গণনাট্য সংঘই ছিল তাদের শিল্প চর্চার সূতিকাগার। উত্তরকালে প্রবাদ প্রতিম সুরকার গীতিকার সলিল চৌধুরী তাঁর আতœজীবনীতে লিখেছেন ‘ আমার শিল্পী জীবনের এক মূল্যবান অধ্যায় সৃষ্টি হতে পেরেছিল গণনাট্য সংঘের দৌলতে। ভারতবর্ষের এক প্রান্ত হতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত যে বিচিত্র সংস্কৃতির ভা-ার যুগ যুগ ধরে মানুষ জিইয়ে রেখেছে – তার সাথে পরিচিতি ঘটেছে প্রধানত ভারতীয় গণনাট্য সম্মেলনগুলির মধ্য দিয়ে। কত সুর, কত ছন্দ, কত প্রকাশভঙ্গি, কত বাদ্য, এক জায়গায় একত্রে আর কোথায় পেতে পারতাম?’
গত শতকে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ সারা বিশে^র মতো ভারতেরও রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টিয়ে দেয়। সবচেয়ে বেহাল দশা দাঁড়ায় ভারতের সাম্যবাদী রাজনীতির, এমত অবস্থায় নামে দেশভাগের খড়্গ। পরিবর্তিত পরিস্তিতিতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যর্থতার ঘূর্ণিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে সাম্যবাদী রাজনীতি। যার অনিবার্য প্রভাব পড়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও। দল আর মতের দ্বৈততা সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রক্তিম ছবিকে ক্রমশ মলিন করতে থাকে।
অবিভক্ত ভারতের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রভাব আমাদের এ অঞ্চলেও পড়েছিল কিন্তু এ অঞ্চল ছিল পশ্চাৎপদ অঞ্চল; শিল্প বাণিজ্যে যেমন তেমন শিক্ষা ক্ষেত্রেও। কাজেই এখানকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপও ছিল ভিন্ন। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। তাদের মুখপাত্র ছিল ‘শিখা’ পত্রিকা। শিখা’য় মুখবাণী হিসেবে ছাপা হত – জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ, মুক্তি যেখনে অসম্ভব। এছাড়া তুরণপত্র, অভিযান, জাগরণ, জয়তী, শান্তি, সাধনা, প্রমুখ পত্রিকা সমূহ সেই সময়ে বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। নানা ধরনের আলোচনা সমালোচনা এই সব পত্রিকা সমূহে স্থান পেত। ১৯৫১ সালে ‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ গঠিত হয়। ১৯৫১ সালের ১৬ মার্চ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ । যার নেপথ্যে কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে সৃজনী লেখক ও শিল্পী গোষ্ঠি, ১৯৬৬ সালে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠি , ১৯৬৮ সালে উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ, ১৯৬৮ সালে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি এবং ১৯৭১ সালের বিশেষ পরিস্থিতিতে আহমদ ছফার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বাঙলাদেশ লেখক সংগ্রাম শিবির। ১৯৭৬ সালে এই সংগঠনটি অধ্যাপক আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বাঙলাদেশ লেখক শিবির নামে পূণর্গঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে এ দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর লক্ষ্য উদ্দেশ্যর ক্ষেত্রে এক ধরনের স্পষ্টতা থাকলেও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিভ্রান্তি আর সুবিধাবাদী প্রবণতা প্রকট হতে থাকে। যার ফলে তাদের সামাজিক ভিত্তি যেমন দূর্বল হয় তেমন নানা ধরনের অপসংস্কৃতির আধিপত্য জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯৭৮ সালে ২৩টি সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট, ১৯৯৯ সালে সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ ইত্যাদি সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয়। সাময়িক ভাবে কখনও কখনও এইসব সংগঠন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিছু ঝড় তুলতে সমর্থ হলেও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য কিংবা চিন্তার অভাবে সমাজে সামগ্রীক অর্থে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে তারা সক্ষম হয়েছে বলা যাবে না। ১৯৭৬ সালের পরে বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের প্রসার ও কর্মকা- ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রগতিশীল চিন্তার বিস্তারে নানাবিধ কার্যক্রমে তারা সক্রিয় ছিল কিন্তু নানা কারণে ক্রমান্বয়ে তাদের সাংগঠনিক বিস্তার হ্রাস পায়। যদিও সীমিত পরিসরে হোলেও এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে লেখক শিবির তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির স্বার্থে যে বিভিন্ন সময়ে সক্রিয় ছিল না বা এখনও নেই এমন বলা যাবে না কিন্তু লক্ষ্যের সচ্ছতার অভাবে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রেই স্থায়িত্ব পায় না অথবা ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা পূরণের চক্রে আবর্তিত হয়। কোনোকিছুর ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা, সে রাজনীতি সংস্কৃতি যাই হোক, সর্বজন স্বীকৃত বিষয়। দৃঢ়তা বা স্থিরতার অভাব হয়ত আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যে কারণে যুগের হাওয়ায় আমরা যতটা আন্দোলিত হই, যুগকে নিয়ন্ত্রণে ততটা দৃঢ় কল্প হইনে। অতীতের প্রতি আমাদের আগ্রহ কম, অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টাও তাই তেমন গুরুত্ব পায় না। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বর্তমানে যে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে জনজীবন শুধু বিপর্যস্ত হচ্ছে এমন না, সুষ্ঠু কোনো সৃজনশীল রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কতদিনে কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে সে প্রশ্নের উত্তর দুরূহ কিন্তু এ যুগে কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিই যে দীর্ঘদিন বিরাজ করতে পারে না সামাজিক বিজ্ঞান সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়।

সংবিধান বনাম সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা
মো:হারুন-অর-রশিদ

গণতন্ত্র চর্চার জন্য আমাদের দেশের সংবিধান মন্দ নয়; বরং বোঝার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানের চেয়ে আমাদের দেশের সংবিধান অনেকটা স্পষ্ট ও সহজ। আমাদের সংবিধানে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সুস্পষ্ট ধারা সন্নিবেশিত আছে। এখানে আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতাসহ মৌল মানবিক অধিকার যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তার কথা উলে¬খ আছে। এগুলো সবই সংবিধানে লিখিত বিধান মাত্র। কার্যত সংবিধানে যা আছে আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টোটি ঘটে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।
আমরা যদি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কথা বলি তা হলে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৯ অনুচ্ছেদে যেমন বলা আছে, উপধারা (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে : (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার, নিশ্চয়তা দান করা হইল।
সংবিধানের এমন বিধান থাকা সত্ত্বেও একজন লেখক ও সাংবাদিকদের জেলে যেতে হয়? কেন মুশতাক আহমেদকে কারাগারে জীবন দিতে হলো? কেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে আটক করে নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হলো? কেন তাকে ১০ মাস কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হলো? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে একেকজন লেখক, সাংবাদিকের গলা চেপে ধরা হচ্ছে। ‘পক্ষকাল’ পত্রিকার সম্পাদক ও বণিকবার্তার ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি শেয়ার করার কারণে তাকে ৫৪ দিন নিখোঁজ ও দীর্ঘ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছিল। এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চরম হুমকি ।
সংবিধান যেখানে বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে কেন সংবাদকর্মী ও মুক্তমত প্রকাশকারী ব্যক্তিদের ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতন করা হচ্ছে তা প্রশ্নের দাবি রাখে। আসলে, যেকোনো সরকারবিরোধী সমালোচনা, উষ্মা, মতবিরোধকে চুপ করিয়ে দিতে সরকার এই আইন প্রয়োগ করছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারের এই আচরণ স্বৈরতান্ত্রিকতার বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশে সাাংবাদিকতা এক বিপজ্জনক পেশা। বিপজ্জনক শুধু এ দেশের সাংবাদিকদের জন্য নয়। পৃথিবীর নানা দেশের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। যেমন ২০২০ সালের মার্চ মাসে মেক্সিকোর সাংবাদিক মিরো¯ে¬াভা ব্রিচ ভেল ডুসিয়াকে খুন করা হয়। তার অপরাধ ছিল, রাজনৈতিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার থাকা। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেশে দেশে শাসকদের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা যত বাড়ছে, ততই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার, বাকস্বাধীনতার যার সাথে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত তার ওপর আঘাত নামছে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এই প্রবণতাকে ‘প্যান্ডেমিক অব অথরিটারিয়ানিজম’ বা কর্তৃত্ববাদের অতিমারী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, আজ সারা বিশ্বই এই জাতীয় অতিমারীর মুখোমুখি এবং মানবজীবনে ভিন্ন ভিন্নভাবে কিন্তু ‘পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত’ উপায়ে তা প্রভাবিত করছে। আরো একটু স্পষ্ট করে তিনি বলছেন, “দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট মনে করতেন ‘জনপরিসরে সব বিষয়ে লোকের বিচারবুদ্ধি ব্যবহারের স্বাধীনতা’র চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না। অথচ প্রায়ই সমাজে মতামত প্রকাশের সুযোগগুলোকে চেপে দেয়া হয়। আজকের পৃথিবীতে এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এবং খাস আমেরিকাতে স্বৈরতন্ত্র বলিয়ান হয়ে উঠেছে, এটি একটি প্রকাণ্ড দুশ্চিন্তার কারণ।”
বাকস্বাধীনতা ও তর্কবিতর্কের স্বাধীনতা- স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও প্রগতির পূর্বশর্ত এবং তা আমরা কখনোই বিসর্জন দিতে পারি না। আর কেউ এই মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। একই সাথে বলে রাখি এই স্বাধীনতাহীনতা শুধু সাংবাদিক, সাংবাদিকতার জন্য বিপজ্জনক নয়, বিপজ্জনক পাঠক, শ্রোতা, দর্শক ; অর্থাৎ নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজের কাছেও।
কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই তার গলা টিপে ধরতে হবে এটি গণতান্ত্রিক আচরণের বিপরীত। গত ৩ মার্চ জম্মু ও কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা: ফারুক আবদুল¬াহর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা খারিজ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কউলের নেতৃত্বাধীন বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তার সমন্বিত বেঞ্চের পক্ষ থেকে বলা হয়, “কোনো দৃষ্টিভঙ্গি সরকারের মতের বিরোধী ও তা থেকে ভিন্ন হলেই তাকে ‘দেশদ্রোহ’ বলা যায় না” (নয়া দিগন্ত, ৪ মার্চ ২০২১)।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন অধিকার হরণ করে এক দিকে তথ্যহীনতা, সংবাদহীনতা অন্য দিকে সরকারের বুলিকে বেশি করে প্রচার করে সাধারণ মানুষকে দেশ-কাল-অর্থনীতি বিষয়ে তার যে তথ্যের অধিকার, জানার অধিকার, সে বিষয়ে মতামত সৃষ্টির অধিকার তা থেকে বঞ্চিত করে চলেছে। এর ফলে দেশের নাগরিক সমাজ, বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজকে ক্রমে বিপন্ন করে তুলেছে।
বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২০ (ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-২০২০) এ বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম, যা ২০১৯ সালে ছিল ১৫০তম অবস্থানে।
এই সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন মারাত্মকভাবে বেড়েছে। মাঠপর্যায়ে সংবাদকর্মীদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা, নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ ও সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা বেড়েছে বলে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের বিশে¬ষণে উলে¬খ করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের জন্য অশনি সঙ্কেত হলো এই যে, অনেক দেশের সরকারই সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখতে রাজি হচ্ছে না। দেখছে প্রতিপক্ষ হিসেবে। খোলাখুলিভাবেই তারা বিরাগ, বিতৃষ্ণা প্রকাশ করছে। সরকারের গোলাম, চাটুকার হয়ে টিকে থাকতে পারলে তার অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে। কিন্তু বিবেকের স্বাধীনতা সব ব্যক্তিকেই গোলাম, দাসত্ব, আর চাটুকার বানাতে পারে না। যার কারণে বেশির ভাগ সাংবাদিক তার পেশার প্রতি বিতৃষ্ণা পোষণ করছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ‘অ্যান ইনভেস্টিগেশন ইনটু রিস্ক টু মেন্টাল হেলথ অব বাংলাদেশী জার্নালিস্টস’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায় ৭৯.১ শতাংশ সাংবাদিক তার নিজ পেশা নিয়ে সন্তুষ্ট নন (কালের কণ্ঠ, ৪ মার্চ ২০২১)।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে সংবাদকর্মীরা সরকারের বিপক্ষে যায় এমন নিউজ করার সময় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল ১৯-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে ও গ্রেফতার করা হয়েছে। ৪১টি মামলার আসামি করা হয়েছে ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে। তাদের মধ্যে ৩২ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে (নয়া দিগন্ত, ৭ মার্চ ২০২১)।
বাংলাদেশের এ কালাকানুনের ব্যাপক অপব্যবহারের মাধ্যমে সাংবাদিক, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, কার্টুনশিল্পী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্ন মতপ্রকাশকারীসহ নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন ও হয়রানির সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে ‘ডিজিটাল হাইওয়ে বিকামস ডিজিটাল জেল’। এ আইনের অপব্যবহার করে সরকার ভিন্ন মত দমন ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করতে চাইছেন।
সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্টসহ যেসব নাগরিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই জামিনে মুক্তির অধিকার থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। কাউকে কাউকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, এমন অভিযোগ পাওয়া যায়।
সব আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল চেতনা ও মতপ্রকাশ, অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং মৌলিক মানবাধিকার-সম্পর্কিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন ও বিধানের পরিপন্থী। কাজেই অসঙ্গতিপূর্ণ ধারাগুলো বাতিল করে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে আইনটি সংশোধন করা আবশ্যক।
একটি কথা মনে রাখা দরকার, কোনো জাতির মেধার প্রসারতাকে রুদ্ধ করে দেয়ার চেষ্টার মানে হলো ওই জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা। আবুল হোসেন সম্পাদিত ‘শিখা’ পত্রিকার নামপত্রে লেখা থাকা একটি উক্তি দিয়ে আজকের লেখাটির যবনিকা টানতে চাই। সেখানে যেমন লেখা থাকত- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’

ই-কমার্সে ক্রয়-বিক্রয়ের নিরাপত্তা চাই
ড. লিপন মুস্তাফিজ

১৯৪৮-৪৯ সালের দিকে বার্লিন বে¬াকেইড এবং এয়ারলিফটের দ্বারা টেলেক্সের মাধ্যমে মূলত পণ্য বেচাকেনার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সেটাকেই বর্তমান ই-কমার্সের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট প্রচলিত হওয়ার পর এই ব্যবসা ধীরে ধীরে ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে যায় এবং বেশ জনপ্রিয় হতে থাকে। ই-কমার্স শব্দ বা প্রক্রিয়ার নাম আমি প্রথম শুনি পড়াশুনা করতে বিলেতে যাওয়ার পরে, ২০০২ সালে। সে-সময় জীবনে প্রথম ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনা একটা হাতঘড়ি উপহার পাই, সেটা আসে জার্মানি থেকে। সেই ই-কমার্স কোম্পানির নাম ছিল ই-বে। ২০০৫ সালের দিকে অনলাইনে বাংলাদেশি পত্র-পত্রিকা পড়ে দেশেও ই-কমার্সের যাত্রা শুরুর খবর পাই। সুদূর বিলেত থেকে আমি আমার বাবাকে ফুল পাঠাই এবং শুভেচ্ছা জানাই। কিন্তু কিছুদিন পরই পত্রপত্রিকায় দেখতে শুরু করি যে, এই ই-কমার্সের মাধ্যমে বিক্রেতা ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। বাসায় পণ্য পৌঁছে দেওয়ার নাম করে ডাকাতির ঘটনাও ঘটছে। আবার কেউবা সঠিক পণ্য না দিয়ে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করছে। ফলে সেই সময় একটা সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটেছিল। সুযোগ ছিল, কিন্তু সেটা আসলে মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেনি তখন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ২০০৪ সালে দিকে ফেইসবুকের যাত্রা শুরু হলেও বাংলাদেশে ২০০৮ সালের শেষদিকে ফেইসবুকের ব্যবহার শুরু হয়। পাশাপাশি নানা রকমের সোশ্যাল মিডিয়াও আসতে থাকে। এসময় ই-কমার্স আবার পথচলা শুরু করে। কিছু তরুণ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এই প¬াটফর্ম নিয়ে। ঢাকার ব্যস্ত জীবনে অনেকেই বই থেকে শুরু করে খাবার, পোশাক, যানবাহন সেবাসহ অনেক কিছুই ই-কমার্সের দ্বারা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বিশেষ করে যারা অনেক ব্যস্ত এবং মোটামুটিভাবে সচ্ছল। দিন দিন তারা এই ই-কমার্সের ওপরে ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। করোনার কারণে এই মাধ্যম অনেক গ্রাহকের আস্থা অর্জন করেছে। তবে কিছু কিছু কোম্পানির সেবা নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ছিল। ছিল অতৃপ্তি, যা এখনো আছে। সম্প্রতি ই-ভ্যালি নামের এক ই-কমার্স কোম্পানি সেই অসন্তুষ্টিকে জোচ্চুরির পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তবে একটু অন্যভাবে। দেশে এখন এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা চলছে। আরেক প্রতিষ্ঠান দারাজ নিয়েও সমাজের অনেকেরই অসন্তুষ্টি-অভিযোগ আছে।
আমরা খবরের মাধ্যমে জেনেছি ২০১৮ সালে ই-কমার্সের প¬্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ই-ভ্যালি। পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য কোম্পানিটি প্রতিযোগিতামূলক পণ্যমূল্যের ওপর মনোনিবেশ করেছিল। মোটরসাইকেল, গাড়ি, মোবাইল ফোন, ঘরের সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্রের মতো উচ্চমূল্যের পণ্যে লোভনীয় মূল্য ছাড় দিয়ে আলোচনায় আসে তারা। প্রতিষ্ঠার শুরুতে ‘সাইক্লোন’, ‘আর্থকোয়েক’ ইত্যাদি নামে তারা ক্রেতাদের ১০০ শতাংশ, ১৫০ শতাংশ ক্যাশব্যাকের মতো অত্যন্ত লোভনীয় অফারও দেয়। তাদের ব্যবসার এই কৌশলের ফলে মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ই-ভ্যালি, বাংলা চলচ্চিত্র ‘মিশন এক্সট্রিম’ এবং ‘মিশন এক্সট্রিম-২’-এর পৃষ্ঠপোষকতাও করে, খেলাধুলাতেও তারা স্পন্সর করেছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ‘চ্যানেল আই মিডিয়া পুরস্কার-২০২০’-এ ই-ভ্যালি ই-কমার্স বিভাগে সেরা কোম্পানি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। ২০২০ সালের নভেম্বরে, ই-ভালি তাদের খাদ্য সরবরাহ পরিষেবা ‘ই-ফুড’-এর জন্য ‘ই-সিএবি’ র্কর্তৃক ‘ই-কমার্স মুভার্স অ্যাওয়ার্ড’ (ইসিএমএ) পেয়েছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন এশিয়াওয়ান ই-ভ্যালিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফলে এর গ্রাহক অতি অল্প সময়ে তর তর করে বাড়তে থাকে। এত কিছুর পরেও আজ কেন ই-ভ্যালির ব্যবসা বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন চলে আসে। এদের ফাঁদে মানুষ কেন পা দিচ্ছে?
আমাদের দেশে ফটকাবাজি নতুন কিছু নয়, ডেসটিনির নাম আমরা অনেকেই জানি। নব্বই দশকে ‘সাফা’ নামের এক কোম্পানি অনেককেই পথে বসিয়েছিল। ডিজিটালাইজেশনের কারণে মানুষের এই ফটকাবাজিও আধুনিক স্টাইলে হচ্ছে। পাশাপাশি অনেকেই এই ই-কমার্সকে বিনিয়োগের মাধ্যম ভাবছেন। কিন্তু কেন? এর উত্তর খুব সহজ। আমাদের দেশে আগের তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে অনেক গুণ। কিন্তু সেই তুলনায় বিনিয়োগের সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সঞ্চয়-জিডিপির অনুপাত ৪০ শতাংশের ভেতরে অবস্থান করে। এ সঞ্চয়কে আমরা বিনিয়োগে রূপ দিতে পারিনি। সাধারণ জনগণ ব্যাংকে টাকা রাখে, সরকারি বন্ড ক্রয় করে আর কিছু কিছু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। সুদের হার কমে যাওয়ার ফলে সেই সব জনগণের আজ বিনিয়োগের কোনো জায়গা নেই। শেয়ারবাজারের ঝুঁকি ও অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায় অনেকেই বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে বা পায়। দেশে আরেক ধরনের প্রচারণার কারণে আজকাল আরেকটি গোষ্ঠী ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ নিতে রাজি নন। জনগণের একটা অংশ ব্যাংকে টাকা রাখলেও সেই সুদ থেকে কর কেটে নেওয়ার ফলে অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। আবার মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের প্রকৃত আয় যা হচ্ছে তার মূল্য কমে যাচ্ছে। করোনার কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে অলসভাবে সময় কাটানো যুবকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই যুবকরাই এই জাতীয় ই-কমার্সের মূল গ্রাহক। বেশি লাভের আশায় এই শ্রেণির মানুষ ও অশিক্ষিত জনগণ ই-ভ্যালির ফাঁদে পা দিচ্ছে। জন্ম হচ্ছে এমন শত শত কোম্পানির।
কিন্তু যথাযথ তদারকির অভাবে এসব কোম্পানির বিকাশও ঘটছে না। ই-কমার্সের জন্য আলাদা আইন করে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, জাতীয় প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও কার্যকর করে এই ব্যবসাকে আরও গতিশীল করা যেতে পারে। প্রতিযোগিতা কমিশনের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকেও আরও প্রফেশনাল হতে হবে। তাদের আরও ক্ষমতা দিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। বাজার বিশে-ষণ, অসম প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। আমাদের দেশের মূল সমস্যা হলো, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব। কোনো চিন্তাভাবনা পরিপূর্ণভাবে না করে কিংবা এর ফলাফল আগাম চিন্তা না করেই আমরা কোনো একটা বিষয় শুরু করে দিই। যেহেতু এই ব্যবসা এখনো নতুন, যারা ক্রেতা বা ভোক্তা তাদেরও শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এই উদীয়মান খাতকে আরও টেকসই কীভাবে করা যায় তার জন্য নীতিমালা ও শক্ত গঠনতন্ত্র খুব দরকার। ই-কমার্স সংক্রান্ত প্রচার ই-ক্যাব কিন্তু বছরজুড়েই করতে পারে। কেননা একটি ব্যবসায়িক সংগঠক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ই-ক্যাব ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে থাকে। ই-কমার্স কেন্দ্রিক সফল উদ্যোক্তা হতে হলে ব্যবসা শুরুর আগে সঠিক ধারণা অর্জন, মূলধনের জোগান এবং কবে থেকে মুনাফা আসবে তার একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। এ ব্যবসার জন্য পণ্য নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। উদ্যোক্তা যে পণ্যগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন এবং বোঝেন সেই পণ্যগুলো নিয়েই কাজ করা উচিত। এমন পণ্য নির্বাচন করতে হবে যে পণ্যগুলোর চাহিদা আছে। পণ্যগুলোর সংগ্রহ এবং ক্রেতার কাছে জোগান দেওয়ার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে ব্যবসায় খারাপ প্রভাব পড়বে। পণ্যের গুণগত মানের দিকে সচেতন থাকা দরকার। এখন মার্কেটিংয়ের নানা মাধ্যম এবং কৌশল রয়েছে যা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার, সঠিক বিজ্ঞাপন/মার্কেটিং ব্যবসাকে সফল করবে। ই-কমার্স করতে গেলে সবার প্রথম যে বিষয়টি মাথায় আসে তা হলো একটি ওয়েবসাইট, যা ব্যবহার করে সবাই কেনাকাটা করতে পারবে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প¬াটফর্ম, সঠিক প্রযুক্তি নির্বাচন করা এবং যথাযথ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা। সাধারণ ক্রেতা যেন সহজেই এই ব্যবসার ধরন বুঝতে পারে। অর্থাৎ ডোমেইন নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি হোস্টিং-এর মান যাতে ভালো হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
ই-কমার্সের জন্য মুড অব পেমেন্ট আরেকটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোনো পণ্য ক্রয় থেকে শুরু করে সেই পণ্যটির মূল্য কীভাবে গ্রহণ করবেন অথবা ক্রেতা কীভাবে সেই মূল্য পরিশোধ করবেন সেটি আগেই ঠিক করে নিতে হবে। পেমেন্ট অনেক ধরনের হতে পারে। আমাদের দেশে ক্যাশ অন ডেলিভারির মাধমেই বেশি লেনদেন সম্পন্ন হয়। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে থাকে। ক্রেতা যেন খুব সহজে তার কোনো মূল্য পরিশোধ করতে পারেন সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। পণ্য অর্ডার থেকে শুরু করে কত সময়ের মধ্যে এবং কোন মাধ্যমে পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। ডেলিভারি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো পণ্যের মান সঠিকভাবে যাচাই করে তারপরই ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার প্রতি লক্ষ রাখা অতি জরুরি। পণ্য বিক্রয় পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে ক্রেতাকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা আবশ্যক। এমন অনেক পণ্য থাকে যা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে; সেক্ষেত্রে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন সঠিকভাবে হওয়া জরুরি। ক্রেতাকে ভুল কোনো তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি না করা ভালো। এর ফলে ব্যবসার ওপর একটা ভালো প্রভাব পড়বে। সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে মোবাইল, টেলিফোন, ই-মেইল অথবা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। তরুণ প্রজন্ম এখন পুরোপুরি তথ্য এবং প্রযুক্তিনির্ভর। ডিজিটালাইজেশনের যুগে ই-কমার্স হতে পারে তরুণদের ভরসার জায়গা। হতে পারে অনেকের কর্মসংস্থান। শুধু দরকার সঠিক নিয়মের ভেতরে একটা ভিত্তি গড়ে দেওয়া। ই-কমার্স হোক বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ের ভরসার স্থল।
লেখক ব্যাংকার ও গবেষক

ট্রেনে পাথর ছোড়া
তোফাজ্জল বিন আমীন

১৮৫৩ সালে উপমহাদেশে রেল যোগাযোগের গোড়াপত্তন। শুরু থেকেই রেলপথে যাতায়াত অন্য সব পথের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী, আরামদায়ক ও নিরাপদ হওয়ায় এখনো দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করে থাকেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেন ভ্রমণে যাত্রীদের সেই আস্থায় চির ধরেছে। প্রতিনিয়ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় যাত্রীরা শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। সংবাদমাধ্যমে ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারা ঘটনার খবর প্রায়ই দেখা যায়। সম্প্রতি পাথর ছোড়ার সাথে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়েছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটার ট্রেনে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেয়। এ অপকর্মে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে ডাকাতের ছুরিকাঘাতে নাহিদ ও সাগর নামে দুই যাত্রীর অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু হয়। দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েক মাসে শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় ক্রমেই ট্রেনে যাতায়াত অনিরাপদ হয়ে উঠছে। খবরে প্রকাশ, রেললাইনের পাশে বসবাসকারী উঠতি বয়সের ছেলেরা খেলার ছলে পাথর ছুড়ে মারে। তাদের ছোড়া পাথরের আঘাতে যাত্রীরা আহত হচ্ছেন। এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। অথচ এই অপরাধের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও সামাজিক পদক্ষেপ বললেই চলে।
চলন্ত ট্রেনে যারা পাথর ছোড়ে তারা ভিন দেশী নাগরিক নয়। তারা আমাদেরই সমাজেরই বাসিন্দা। তাই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পাথর ছোড়ার বেদনাদায়ক পরিণতি কী হতে পারে তা তাদের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ অপকর্ম যারা করে থাকে তারা কখনো উপলব্ধি করে না, তাদের ছোড়া পাথরের আঘাতে নিরপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।
সাধারণত মানুষ প্রতিশোধের নেশায় মানুষ কাউকে হত্যা কিংবা জখম করে থাকে। কিন্তু যারা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে; তাদের সাথে যাত্রীদের পূর্বশত্রুতা কিংবা ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ নেই। যাত্রীর আহত হওয়ার ভেতর তাদের বিন্দুমাত্র স্বার্থ নেই। তাহলে কোন জিঘাংসায় তারা পাথর ছোড়ছে তা খতিয়ে দেখা জরুরি। কারণ তাদের ছোড়া পাথরের আঘাতে বহু পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
রেলকে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করার লক্ষ্যে সরকার ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেলপথ বিভাগকে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ে উন্নীত করে। কিন্তু তার পরও রেলের বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, যাত্রী ভোগান্তি, দুর্ঘটনা কিংবা পাথর ছোড়ার ঘটনা থামেনি এবং কমেনি। উল্টো পাথর ছোড়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। দেশে মোট প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ৭০০ কিলোমিটারই অরক্ষিত। অথচ এ ব্যাপারে রেলকর্তৃপক্ষ উদাসীন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সারা দেশের ২০ জেলার ৭০টি স্থানকে পাথর ছোড়ার ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশের রেলপথে পাথর ছোড়ার ঘটনা অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। এ ধরনের হামলায় ট্রেনের দরজা-জানালা ভাঙছে। ট্রেনের চালক, সহকারী চালক ও যাত্রীরা আহত হচ্ছেন। পাথর ছোড়ায় শুধু যাত্রীদেরই ক্ষতি হচ্ছে তা কিন্তু নয়, পাথর ছোড়ার ফলে রেলের প্রতি বছর কোটি কোটি টাকারও ক্ষতি হচ্ছে। সুতরাং এ ব্যাপারে সংশি¬ষ্ট মহলের দ্রুত উদ্যোগী ভূমিকা নেয়া অত্যাবশ্যক। কোনো সভ্য দেশে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের নজির না থাকলেও আমাদের দেশে পাথর ছোড়ার ঘটনা থামছে না। যাত্রীরা এখন জানালার পাশে বসতেও ভয় পান। জানালা বন্ধ রেখেও রেহাই পাচ্ছেন না। পাথরের টুকরো চোখে মুখে কপালে লাগছে। রেল মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলন্ত ট্রেনে ১১০টির মতো পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে ট্রেনের জানালার অন্তত ১০৩টি কাচ ভেঙেছে এবং আহত হয়েছেন ২৯ জন যাত্রী। গত পাঁচ বছরে দুই হাজারের চেয়ে বেশি পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৫ আগস্ট চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার আঘাতে পাঁচ বছর বয়সী শিশু আজমির চোখে লাগে। এতে শিশুর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় একটি চলন্ত ট্রেনে এ ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল খুলনা বেনাপোল কমিউটার ট্রেনের পরিদর্শক বায়েজিদ হোসেন ছোড়া পাথরের আঘাতে ৪১ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৩ সালে চট্টগামে ভাটিয়ারী এলাকায় চলন্ত ট্রেনে ছোড়া পাথরের আঘাতে প্রীতি দাশ নামে এক প্রকৌশলী নিহত হন। রেললাইনের ওপর ১৪৪ ধারার বিধান কার্যকর আছে। অথচ রেললাইনের পাশে বাজার কিংবা বস্তি সরেনি। মাঝে মধ্যে উচ্ছেদের নামে ইঁদুর-বিড়াল খেলা হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। আইনের বিধান থাকা সত্ত্বেও পাথর ছোড়া বন্ধ না হওয়া দুঃখজনক। বাংলাদেশ রেল আইনের ১২৭ ধারা অনুসারে পাথর নিক্ষেপের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কোনো যাত্রী মারা গেলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০২ ধারানুসারে ফাঁসির বিধান রয়েছে। অপরাধী অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে সে ক্ষেত্রে তার অভিভাবককে শাস্তি ভোগ করতে হবে। এমন কঠোর আইন থাকার পরও পাথর ছোড়া বন্ধ হচ্ছে না। কারণ রেল আইনে শাস্তির নজির খুবই কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে এ প্রবণতা কমছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও নিরাপদ ট্রেন যাতায়াত নিশ্চিত করা যায়নি। এ ধরনের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সমাজ ও পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিকভাবে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, মসজিদের ইমাম ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে এ বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ ট্রেনে যাতায়াতের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবেন। তাই এ ধরনের অপরাধ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

হারিয়ে গেছে বাঙালি সংস্কৃতির বিয়ে পার্বণ
জয়নুল আবেদীন

কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কমতে না কমতেই বাড়ছে বিয়েশাদির ধুম। কেনাকাটা শেষ করে বিয়ের গেট-প্যান্ডেল থেকে শুরু করে খানাপিনা পর্যন্ত সব দায় ডেকোরেটর-বাবুর্চির ওপর চাপিয়ে আয়োজকপক্ষের সুদর্শন সন্তানরা পানের ডালা সাজিয়ে খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়েন টাকা কালেকশনে। ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর এ সংস্কৃতি শহর থেকে প্রবেশ করেছে গাঁও-গেরামেও। সামান্য ব্যতিক্রমসাপেক্ষে সর্বত্র একই প্রকারের রান্না। নিজে তিন তিনবার রিং পরানো হার্টের রোগী। চিকিৎসকের কড়া হুকুম, ‘পরিহার করতে হবে চর্বি, স্নেহ, মিষ্টি, ননী, ঘি, বাটার, মালাই, ক্রিম, তেল, পেস্তাবাদাম, লাল গোশত, তৃণভোজী প্রাণীর গোশত, গিলা, কলিজা, মগজ, ডিমের হলুদ অংশ। গ্রহণ করতে হবে আটা, মুড়ি, চিঁড়া, রুটি, বিস্কুট, ডাল, শাকসবজি, ফল, মাছ, ননীবিহীন দুধ ও কুসুমবিহীন ডিম।’ আজকাল চিকিৎসকের পরিহারকৃত খাদ্য ছাড়া অনুষ্ঠানই অচল। এসব জীবনসংহারী খাদ্য ও ’গিভ অ্যান্ড টেক’ সংস্কৃতি চিরায়ত অতিথিপরায়ণ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। বিভিন্ন কারণে অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যা। হার্টের সমস্যাসহ ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এসব খাদ্য ঝুঁকিপূর্ণ। অনুষ্ঠানে খাদ্য ভক্ষণের চেয়ে অপচয়ও কম হয় না। গরমের দেশে এসব খাদ্য খাওয়ার সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুসহ হাসপাতালে ভর্তির খবরও পাওয়া যায়। খানাপিনার মতো বিয়ের পার্বণেও বদলে গেছে সংস্কৃতি। কালের কবলে হারিয়ে যাওয়া বিয়ের খানাপিনা ও রীতিনীতিই বাঙালির আদি-আসল চিরায়ত সংস্কৃতি।
বর ঘোড়া কিংবা পালকিতে চড়ে চলছে আগে। আতশবাজি-পটকা ফুটাতে ফুটাতে বরকে অনুসরণ করছে যুবকদল। সবার পেছনে জয়ঢাক বাজিয়ে চলছে ব্যান্ডপার্টি। যাত্রাপথে ঘাটে ঘাটে বাধা। বিড়ি-সিগারেট ও পান-বাতাসা বিলিয়ে সব বাধা অতিক্রম করার পর শেষ বাধা শাহদরজায়। কনের বাড়িতে প্রবেশের জন্য প্রথমেই শাহদরজা। এর জন্য খুঁজে আনা হয় লম্বা কলাগাছ। দুই দিকে খাড়া থাকে দুই জোড়া কলাগাছ। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বেড়া বানিয়ে চার কলাগাছের সাথে অর্ধচন্দ্রাকারে আটকানো হয়। আটকানো ‘ফেন্সি’র বাঁকে বাঁকে লাগানো হয় কারুকাজ করে কাটা রঙিন কাগজ। কপাল বরাবর সাঁটানো সাদা কাগজে মোটা অক্ষরে প্রবেশ মূল্য লিখে রাখা হয়। বিয়ে বাড়ির বরকে বাদশার সাথে তুলনা করে প্রবেশদ্বারের নাম ‘শাহদরজা’। শাহদরজার প্রবেশপথে আড়াআড়ি বাঁশ বেঁধে আটকে রাখা হয় বরযাত্রীকে। বাঁশের এক পাশে বরপক্ষ; আরেক পাশে অবস্থান করে কনেপক্ষ। কনেপক্ষে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। গেটমাশুলসহ কনের সঙ্গী-সাথীদের বাতাসার পরিমাণ নিয়ে শুরু হয় দরকষাকষি। এর বাগযুদ্ধে সাধারণত বরপক্ষের যুবক ও কনেপক্ষের যুবতীরা অংশ নিয়ে থাকেন। বাগযুদ্ধের শুরুটা নিম্নরূপ-
কনেপক্ষ : কনের কাছে পৌঁছাতে হলে আগে পরিশোধ করতে হবে গেটমাশুল।
বরপক্ষ : আমরা মেহমান, বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াতি মেহমান আটকে দেয়া কোন দেশী আচার?
কনেপক্ষ : বরের মতলব খারাপ। বর শুধু দাওয়াত খেতে আসেনি, নিতেও এসেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, বর কনে ছাড়া ফিরবে না। বিনা মাশুলে আমরা আমাদের সাথীকে হারাতে রাজি নই।
এভাবে অম্লমধুর তর্কবিতর্ক, বাগযুদ্ধসহ দরকষাকষি চলত মিনিটের পর মিনিট। বাগযুদ্ধ দীর্ঘায়িতসহ মাশুল আদায়ে বিলম্ব হলে শুরু হয় ঢিল মারা। ঢিলে মাটির ঢেলা ছাড়াও নিক্ষেপ করা হয় গোবর আবর্জনা ইত্যাদি। এ সময় বর রুমাল মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। পরিশেষে গেটমাশুলসহ বাতাসা-মিষ্টি ও পান-বিড়ি দিয়ে প্রবেশের অনুমতি পায়। নিরেট আনন্দ ছাড়াও দরকষাকষির একটা ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। দু’পক্ষের মুখোমুখি মুখ-দর্শন, বাকচাতুর্যের মাঝেই অনেক সময় নির্ধারিত হয়ে যায় ভবিষ্যৎ বর-কনে।
বিয়ের সময় এসব প্রচলিত রীতিনীতি আইন কিংবা ধর্মে থাকুক কিংবা না থাকুক, না মেনে উপায় ছিল না। প্রতিটি দেশেই ধর্ম ও আইনের বাইরে রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি বা কালচার। সংস্কৃতির সাথে সভ্যতার একটি বিনা সুতার বন্ধন রয়েছে। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, ‘আমরা যা করি তাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা। মূলত সংস্কৃতি হলো মানুষের স্বাভাবিক জীবনপ্রণালী আর সভ্যতা হলো সে জীবনপ্রণালীর বাহ্যিক রূপ।’ সহজ অর্থে- বৈবাহিক প্রথা সভ্যতা আর বৈবাহিক প্রথা কার্যকর প্রণালী করা হচ্ছে সংস্কৃতি। এ কারণেই যে জাতির মধ্যে বৈবাহিক প্রথা না আছে সে জাতিকে বলা হয় অসভ্য জাতি। ভিন্ন ভিন্ন জাতির বৈবাহিক প্রণালীও ভিন্ন ভিন্ন। জাতির বিকাশ ধর্ম আর সভ্যতা দিয়ে নয়, সংস্কৃতি দিয়ে। সভ্যতাকে বিকশিত করে সংস্কৃতি। কোনো দেশের জাতীয় সংস্কৃতির ধারা দু’টি- নগর সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতি হলো, গ্রামের সহজ-সরল, অনাড়ম্বর লোকসম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ, জীবনধারণ প্রণালী, চিত্তবিনোদনের উপায় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জীবনব্যবস্থা। দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে ওঠা জীবনব্যবস্থা নিজস্ব সংস্কৃতি সভ্যতার পরিচয় বহন করে। বাঙালি বৈবাহিক প্রথার সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে বহু আগেই। জোড়ায় জোড়ায় গরু, ডজন ডজন খাসি ও শত শত মুরগি জবাই করে পোলাও, কাচ্চি বিরানি করা বাঙালি সংস্কৃতি নয়।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ১৯৬৩ সালের একটি বিয়ে পার্বণের কথা। বরের বাড়ি কুমিল¬া জেলার বর্তমান মেঘনা উপজেলার কান্দারগাঁও আর কনের বাড়ি একই উপজেলার মির্জানগর গ্রামে। বরের ভাতিজা মোসলে উদ্দীন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন পিএসসি, বিএন অবসরপ্রাপ্ত) আমার সমবয়সী, দু’জনই তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ভাব জমতে সময় লাগেনি। বরযাত্রীসহ শাহদরজা পার হয়ে কনের বাড়িতে প্রবেশ করতে না করতেই কানে প্রবেশ করে গান। বরকে খোঁটা দিয়ে সম্মিলিত নারীকণ্ঠের গান-
‘পাশিবালি আনছে মাগনা বিবির কানে শোভে না
অপমাইন্না দুলারে, বিবির সম্মান চিনলি না।
শাড়ি আনছে মাগনা বিবির গায়ে শোভে না;
অপমাইন্না দুলারে, বিবির সম্মান চিনলি না।’
এভাবে কনের অলঙ্কার ও পরিচ্ছদের নাম উলে¬খ করে করে সম্মিলিত নারীকণ্ঠের গান কানে প্রবেশ করে। বহু দূর থেকে এরকম গান কানে প্রবেশ করলেই বুঝতে পারা যায়, বিয়ে বাড়ির গান। একদল থামতেই আরেক দল-
‘কেমন-অই না কুমাইরা রে ছনক্ষেত যেন নিড়াসরে
রৌদ্র যেন লাগে তোর গায়রে রে কুমার,
রৌদ্র যেন লাগে তোর গায়ে।
কেমন-অই না কইন্নায় লো কলসি যেন ভরিস লো
আগাইয়া ধরো আফের ছাত্তি লো কইন্না
আগাইয়া ধরো আফের ছাত্তি।’
বরযাত্রী নিজ নিজ আসন গ্রহণের পর দূর থেকে করুণ সুরে- ‘বাগে বাগে ডাকে কুকিল রে… কার বা বাগে ডাকে,
রাধিকার ওই বাগে কুকিল রে…বইসা রোদন করে।’
মেয়েলি গানের রয়েছে শ্রেণিবিভাগ। কমবয়সী, প্রবীণ ও বৃদ্ধা, বয়সভেদে রয়েছে পৃথক পৃথক গান। বিয়ের গান বলতে মূলত বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে কনেপক্ষ বরপক্ষকে আবার বরপক্ষ কনেপক্ষকে উদ্দেশ করে রচিত গান। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে দ্বিরাগমন পর্যন্ত এক পক্ষ আরেক পক্ষকে নিয়ে মজাদার চটুল গান বাঁধে। গান করে অন্তঃপুরের মহিলারাও। সেই প্রাচীনকাল থেকেই গানের প্রচলন ছিল। গানগুলো আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং প্রজন্মপরম্পরায় মুখে মুখে প্রচারিত। বয়স্করা অর্থাৎ মা-চাচীরা যখন গান করেন, তখন তাদের ঘিরে থাকে শিশুরা। শিশুরা মা-চাচীদের কাছে শোনা গান মনের ভেতর গেঁথে রাখে। বড় হয়ে গাইতে শুরু করে তারাও। নারী গানে পরস্পরের প্রতি কটাক্ষসহ নারী মনের আবেগ-উৎকণ্ঠা, আনন্দ-বেদনা, কামনা-বাসনা, হাসি-ঠাট্টা সব রয়েছে। খোঁটা ও খোঁচাবিষয়ক গানগুলো কম বয়সী এবং গুরুগম্ভীর ভাবমূলক গান প্রবীণ মহিলারা গেয়ে থাকেন। গান চলতে থাকার মধ্যেই খানাপিনায় বসে যায় বরযাত্রী। বড় ঘর কিংবা উঠানে শামিয়ানার তলায় বিছানার ওপর দস্তরখানা। দস্তরখানার উপরে বসে পানাহার শুরু। খাদ্য পরিবেশন পদ্ধতিও ভিন্ন। বারো রকমের খানা, একটার পর একটা চলতেই থাকে। প্রথমে পে-ট বিতরণ। এর পরপর ধারাবাহিকভাবে শুরু হয়, চিলমচি ও বদনা হাতে নিয়ে মেহমানদের হাত ধোয়ানো। হাত ধোয়ানো শেষ হতে না হতে খানা চলে আসে। খানা শুরু হয় পাতলা সাবু কিংবা টকদই দিয়ে। প্রথমেই অ্যালুমিনিয়াম পাতিল কিংবা পিতলের গামলায় করে সাবু কিংবা টকদই। সাথে সাথে খই-মুড়ি, নানা রকমের কারুকাজ করা কারিগরি পিঠা ও মিষ্টি। গামলা ভরা মিষ্টি যার যত ইচ্ছা খাও। আমৃত্তি, চমচম এত বেশি পরিমাণ দেয়া হয় যে, কেউ কেউ পাঁচ-সাতটি করে সঞ্চয়ও করতে পারেন। টকদই থেকে মিষ্টি বিতরণ পর্যন্ত প্রথম পর্ব শেষ।
দ্বিতীয় পর্ব শুরু পোলাও-মুরগি দিয়ে। পে¬ট পরিষ্কার করে এবার মুষ্টি পোলাও (পরিমিত পরিমাণ)। একজন এক চামচ করে পোলাও, অন্যজন দিয়ে যায় এক টুকরো করে মুরগির গোশত ও ঝোল। পোলাও-মুরগি শেষ হতে না হতেই শুরু হয় সাদা ভাত। আমন ধানের চালের সাদা ভাতের সাথে বড় মাছের তরকারি। মাছ যে যত খেতে পারে। মাছের পরে ডাল। মাষকলাইয়ের ডাল- ক্ষেত্রভেদে মুগ ডাল, পরিশেষে পায়েস কিংবা ক্ষীর (ঘন পায়েস)। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় খামারের মাছ দেখা দূরের কথা, নামও কেউ জানত না। বিয়েসহ বড় অনুষ্ঠানে মুরগির পরই মাছ। মিঠা পানির রুই, কাতলা ও মৃগেলের জন্য অনুষ্ঠানের আগেই জেলেদের কাছে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। মেজবানি ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানে গরু জবাইয়ের প্রচলন খুব একটা চোখে পড়ত না।
সাধারণ মেহমানদের খানাপিনা শেষে বরের জন্য স্পেশাল খানা। দোস্ত হিসেবে বরের পাশেই ছিল আমার স্থান। স্পেশাল খানাপিনার জন্য আমাকেও বসিয়ে রাখা হয়েছিল। বিয়ের আসরে বরের পাশে বসা অবস্থায় এই বয়সেই আমার গুরুত্ব টের পেতে শুরু করেছি। টের পেতে শুরু করছি যে, আড়াই দিনে বন্ধুবরের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে যাবে। বন্ধুবরকে ছায়ার মতো আগলে রাখার গুরুদায়িত্ব আমার; কারণ বরকে আড়াই দিন কনের বাড়িতে অবস্থান করতে হবে। এই আড়াই দিনে বরের আইকিউসহ নানা রকম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। শ্বশুর-শাশুড়ি সম্পর্কিত সবার সাথে বরের পরিচয় ছাড়াও শালা-শালী সম্পর্কিতদের সাথে চলে অ¤¬মধুর যুদ্ধ। এই বিয়েতে অ¤¬মধুর রসিকতাপূর্ণ বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার যুদ্ধে বরের দেহরক্ষী ছিলাম আমি। সময় শীতকাল। যে ঘরে আমাদের রাখা হয় সে ঘরে বাঁশের বেড়া। পুরনো বেড়ার মাঝে মাঝে ফাঁকা। পরদিন ঘুম ভাঙার আগেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে তরল রঙ এসে গায়ে লাগে; অর্থাৎ ঘুমন্ত অবস্থায় কনেপক্ষের আক্রমণ। বরপক্ষের সৈনিকদের মধ্যে একজন ছিল সোনারগাঁওয়ের জামাই। সোনারগাঁওয়ের জামাই যেমন চতুর তেমন বুদ্ধিমান। তার সোনারগাঁওয়ের জামাইয়ের নেতৃত্বে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। পাকা খেলোয়াড় হিসেবে ৫৭০ রঙসহ সরঞ্জাম জামাইয়ের ব্যাগে আগেই ছিল। রঙ বাটিতে গুলে প¬াস্টিকের সিরিঞ্জে ভর্তি করে শুরু হয় পাল্টা রঙযুদ্ধ। রঙযুদ্ধ মল¬যুদ্ধের দিকে গড়াতে শুরু করতেই মুরুব্বিরা চলে আসেন। আশপাশের মুরুব্বিদের হস্তক্ষেপ না হলে রঙখেলায় আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সকাল থেকে যাদের সাথে যুদ্ধ, তারাই সহাস্যে আমাদের জন্য নাশতা নিয়ে হাজির। বারো রকমের পিঠা, শিরনি, পায়েস, সেমাই, মুড়ি প্রভৃতি। সোনারগাঁওয়ের জামাই আগে থেকেই সতর্ক করেছিলেন যে, ‘পিঠা কখনো আগে মুখে দেবেন না। প্রথমে হাতে নেবেন, টুকরো টুকরো করে ভাঙবেন, নিশ্চিত হওয়ার পর মুখে তুলবেন। শিরনি ও পায়েস যাই হোক, পে¬টে নেয়ার আগে চামচের মাথায় করে আগে টেস্ট করবেন, তার পর পে¬টে উঠাবেন। এসব খানায় অস্বাভাবিকভাবে থাকতে পারে মরিচ-লবণ। বরের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার জন্য আরো পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। খানাপিনার বিষয় ছাড়াও পাড়ার মুরুব্বিরা আসতেন। বরের পেশাবিষয়ক নানা প্রশ্ন করতেন। বর কৃষক পরিবারের বিধায়, কৃষিবিষয়ক খুঁটিনাটি প্রশ্ন থেকেও বাদ পড়েনি। সোনারগাঁওয়ের জামাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ‘আড়াইউল¬ার সব পরীক্ষা’ সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে আড়াই দিনের মাথায় বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।
বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান। গ্রামের বিপুল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে হাজার বছর ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে তা-ই বাংলার লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত। নগরবাসীর স্বল্প পরিসরে ঘনবসতি জনগোষ্ঠীর আহার-বিহার, আনন্দ-উৎসব ও উৎপাদন পদ্ধতির সংমিশ্রণে নগর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা জটিল, বৈচিত্র্যময় ও দ্রুত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল নগরসংস্কৃতির করালগ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের লোকসংস্কৃতি। সাথে হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত খাদ্যাভ্যাসও। কাচ্চি বিরানি মধ্য এশিয়ার খাবার, যা তীব্র ঘ্রাণযুক্ত গরম মসলা, ঘি, কাঁচা গোশত ও সুগন্ধি চাল মিশিয়ে রান্না করা হয়। মুঘল আমল থেকে অদ্যাবধি ভারতে সমানভাবে আদৃত হতে দেখে বিখ্যাত রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘এ কি ভানুমতি! এ কি ইন্দ্রজাল’ আখ্যায় আখ্যায়িত করেছিলেন। ‘মাংস খেলে মাংস বাড়ে, ঘৃতে বাড়ে বল/দুগ্ধ খেলে চন্দ্র বাড়ে, শাকে বাড়ে মল’- মধ্যযুগের সুধীজনের শে-াকটি ভুল প্রমাণিত হয়ে সম্প্রতি নেচার মেডিসিন সাময়িকীতে প্রকাশিত, ড. স্ট্যানলি হ্যাজেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় জানা যায়, লাল মাংস কার্নিটিন নামের কেমিক্যাল পাকস্থলীর ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে প্রচুর কোলেস্টেরল তৈরি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। হৃদরোগ ছাড়াও শরীরে বেশির ভাগ রোগ সৃষ্টির মূল কারণ কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার; যার মধ্যে চিনি সবচেয়ে বেশি খারাপ। সে কারণে চিনির আরেক নাম ‘হোয়াইট পয়জন।’ সব জেনে-বুঝেও আমরা দিন দিন ভয়ঙ্করের দিকেই হাঁটছি।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক


বাঙালির ভাঙন-বিচ্ছিন্নতা
হরিপদ দত্ত

ভৌগোলিক সীমানাগঠন, রাষ্ট্রগঠন, জাতিগঠন, ভাষা-সংস্কৃতি গঠন পুনর্গঠনের কাল সেই কোন ঐতিহাসিক-প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু হয়ে আধুনিক সময়ে সুস্থির হয়েও বুঝি সুস্থির হতে চায় না। ভাঙন-বিচ্ছিন্নতা চলছেই। এর পেছনে রাজনীতি-অর্থনীতির অভিসন্ধি থাকলেও ইতিহাসের কার্যকারণকে অস্বীকার করা প্রায় অসম্ভব। ধরা যাক ইরাক আর তুরস্কের মাঝখানে বিশাল ভূখন্ড কুর্দিস্থানকে। কুর্দি জাতি দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করলেও তা আজও অনার্জিত। কুর্দিরা ইসলাম ধর্মী হলেও আজও তারা প্রাচীন আরবীয় পৌত্তলিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। তবু তারা পৃথিবীর অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর মানবজাতির একটি অংশ। অন্যদিকে বাঙালি জাতিও ইতিহাসের নানা গতিপথ ধরে স্বতন্ত্র বাঙালি জাতি হিসেবেই গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছরের স্মৃতিপথ বেয়ে। বাঙালির উদ্ভব অ্যালপাইন নরগোষ্ঠী এবং আদি অস্ট্রেলীয় কৃষ্ণবর্ণ নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে। অবশ্য আদি লর্ডিক নরগোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র ধারা গঙ্গার পশ্চিমতীরের নরগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশলেও পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশ) জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেশেনি। এই লর্ডিকরাই বৈদিক সভ্যতা বা আর্যব্রাহ্মণ্য সভ্যতা সৃষ্টি করে। এই সৃষ্টির সঙ্গে পূর্ববঙ্গের আদি জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই। এটাই আদি পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মৌলিক পার্থক্য। বাঙালি জাতির উদ্ভব বিকাশের সঠিক পর্যালোচনা করতে গেলে ইতিহাসবিদদের এই পার্থক্যকে অস্বীকার করলে চলবে না। পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের (একাংশের) যে অবজ্ঞা আর গোপন বিদ্বেষ তা নতুন কিছু নয়, এর শেকড় অতি গভীরে বহমান। সেই প্রাচীনকাল থেকে ধর্মাধর্মের বাইরে। আশ্চর্যের বিষয় যে, আধুনিককালের ধর্মগুলো অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের (ইসলাম আর আর্যধর্ম) বিকাশের পূর্ব থেকেই। ধর্মগ্রন্থ বেদ-উপনিষদ আর মহাকাব্য রামায়ণ-মহাভারতে পূর্ববঙ্গের মাটি আর মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি-এর প্রমাণ।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বাংলা নামের মানচিত্রে আধুনিক যুগের অবদান। ইংরেজ শাসন আর উপনিবেশবাদী রাজনীতির সঙ্গেই তৈরি হয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। এই সাম্প্রদায়িকতা স্থান পায় হিন্দুবর্ণবাদের সমান্তরালে। এই দুই অপশক্তি হাত ধরাধরি করে বাঙালির সমাজ জীবনে আছড়ে পড়ে। পরিণতিতে বাংলার আধুনিক মানচিত্রের পাতা দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। ভৌগোলিক ভাঙনের সঙ্গে বাঙালির মানসজগতে ভাঙনের শুরু। বিচ্ছিন্নতার ঢেউ উত্তাল হয়ে ওঠে। একাত্তরে পূর্ববঙ্গ ভাঙনের বিকল্প হিসেবে বেছে নেয় পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ খুব কৌশলে পাহাড়ি জাতিসত্তার বিদ্রোহের হাত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ধরে রাখে তার মানচিত্রে ভাঙন-বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে। এটাও বাংলাদেশের দ্বিতীয় যুদ্ধ বিজয়। রক্তাক্ত যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে মিত্রতার ভেতর সাতচলি¬শের খন্ডিত বাংলা নিজেকে রক্ষা করে। সাতচলি¬শে ধর্মের নামে যে বাংলা ভাগ হবে তা হয়তো ভাবতে পারেনি আদিবাঙালির পূর্বপুরুষ। প্রাচীন পুন্ড্র, গৌড়, সূক্ষ্ম, রাঢ়, তাম্রলিপ্তি, সমতট, বঙ্গ, হরিকেল ইত্যাদি জনপদ ঐতিহাসিক কার্যকারণের পূর্ণতা দান করতে গিয়ে বাঙালির এক ভৌগোলিক রাষ্ট্র, মিলিত জনপদ তৈরি করল। আধুনিক বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটে। ধর্মের নামে রক্তদাঙ্গার ভেতর তা টুকরো হয়ে যাবে, এটাও ভাবেনি প্রাচীন বাঙালি। ভাঙনকালের চির সমাপ্তি কী হলো? ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে। বাঙালি কি আরও ভাঙনের অপেক্ষায় নিশি জাগরণকাল কাটাচ্ছে?
চারদিক দেখেশুনে মনে হচ্ছে মানবসভ্যতা যে গতিতে এগিয়ে চলেছে বৈজ্ঞানিক মেধাকে সঙ্গে করে, উদ্ভাবন শক্তিকে বৃদ্ধি করে, বাঙালি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। পিছিয়ে পড়ছে, কেবলই পিছিয়ে। যারা পিছিয়ে পড়ে তারাই অবসাদে আক্রান্ত হয়। নিজেকে ভাঙে, বিচ্ছিন্ন হয় অন্যদের থেকে। সে কেবল তাকায় মাটির দিকে। আদিম ঠিকানার দিকে। সেই মাটি তো বাঙালি হিন্দুর কাছে সেই কোনো আদিযুগ থেকেই ঈশ্বর হয়ে রইল, হলো ভূমি দেবতা, নানান নামে মূর্তি হলো, পূজা পেল ভগবানের নামে। মাটি হলো না আধুনিক শিল্পায়নের, নগরায়ণের ভিত্তি। মাটির বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবহার আজও শিখল না বাঙালি। অন্ধ ভক্তিবাদ বাধা হয়ে রইল বিজ্ঞানবাদের। বাঙালি মুসলমান সেই ভাবের জগতে পড়ে রইল আজও। আর এই যে নদী, যার কারণে বাঙালি এই বাংলাদেশকে ‘নদী মেঘলা’ নাম দিল। কল্পনা করল যুবতী সুন্দরী রূপে, যার পায়ে শোভা পায় অলংকার, যার কোমরে, অঙ্গে হয় চন্দ্রহার। অথচ কেউ দস্যু হয়ে নদী দখল করল, তার পানি করল বর্জ্যে পরিণত। এ যেন নারী অপহরণকারীর ধর্ষণলীলা। আবার কেউ নদীকে পবিত্রজ্ঞানে পূজা করল (গঙ্গা পূজা), উন্নয়নসভ্যতার কাজে লাগাতে পারল না।
সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক সৈন্য এবং যুদ্ধ-রসদ চলাচলের জন্য বঙ্গ-ভারতে রেললাইন বসাল। এলো কয়লাচালিত স্টিম ইঞ্জিন। বাঙালির একাংশ ভাবল এবার স্বর্গের অগ্নিদেবতা মর্ত্যে নেমে এসেছে। ভয়ার্তরা তাকে পূজা করল ধান-দূর্বা দিয়ে। ইংরেজের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন হয়ে গেল বাঙালির দেবতা। আর অন্যদিকে বাঙালির কর্মকার জাতি লোহার দেবতা হিসেবে ‘বিশ্বকর্মার’ পূজা করে। আর লৌহদ্রব্য ব্যবসায়ীরাও। কৃষক তো লাঙলের ফলার পূজা না-করে মাঠেই নামে না চাষ দিতে। আবার কেউ বা যায় পীরের দরগায় শিরনি দিতে। শিকারজীবী বাঙালি (তখনো বাঙালি হয়ে ওঠেনি) আদি অস্ট্রিক নরগোষ্ঠীর হাত ধরে ধান থেকে চাল, চাল থেকে ভাত খেতে শিখল আর অরণ্যচারী প্রাণী হত্যা করে ক্ষুধা নিবারণের অভ্যাস করল পরিত্যাগ। লৌকিক ধর্ম আর দেব-দেবীরা এভাবেই জন্ম নিল বাঙালি মানসে। মাটি বা ভূমির সঙ্গে ধান-চাল-ভাত ও দেব-দেবীর স্থান দখল করে। খাদ্যের কাছে বাঙালি মাথা নত করল। পুষ্টি বিজ্ঞানচর্চা করল না, ধার করল ইউরোপ থেকে। আন্তর্জাতিক বীজ ব্যবসায়ীদের ক্রেতা হলো। জিএম ফুডের বীজ উৎপাদন করতে পারল না। উদ্ভাবক হলো না। ক্ষুধার্ত খাদ্য ক্রেতা হয়েই রইল।
বাঙালির যত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা আর বঞ্চনা তা থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ শ্রেণি-সংগ্রাম করল না। মাঝে-মধ্যে সাপের মতো ফোঁস-ফাঁস করলেও শেষটায় মাথা নত করল। বিচ্ছিন্নভাবে কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন করল ও বিপ¬ব শুরুতেই মাথা নত করল। কমরেড-কমিউনিস্ট নেতা সরোজ দত্তের উদ্ভাবনায় এবং প্রেরণায় কমিউনিস্ট নেতা কমরেড চারু মজুমদার বিপ¬বের নামে, শ্রেণিশত্রু খতমের নামে কৃষক-ভূস্বামীর মুন্ড ছেদন করে হাত রক্তাক্ত করল ও বিপ¬ব ব্যর্থ হলো। সেই বিপ¬বের আঁতুড়-ভূমি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ দিনাজপুর, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার আজ আলাদা রাজ্য হতে চায়। মাথায় চাগিয়ে উঠেছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। বিস্ময়, দুঃখ আর আক্ষেপ জাগে এ কথা ভেবে যে, যে নকশালবাড়ী এক দিন রক্তাক্ত বিপ¬বের হাত ধরে কৃষক বিদ্রোহ শুরু করে সারা ভারতবর্ষের মাটিতে কাঁপন তুলেছিল বিশ্বকে চমকে, সেই নকশালবাড়ী আজ ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির দখলে। বিপ¬বী কমিউনিস্টদের এমনই নির্মম পরাজয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিরল। কমিউনিস্টশূন্য উত্তরবঙ্গ আজ আলাদা হতে চায়। বিচ্ছিন্ন হতে চায়। ভাঙতে চায়। বঞ্চিত বাঙালি ঔপনিবেশিক রাজধানী কলকাতাকে ঘৃণা করে, তাদের হাত থেকে মুক্ত হতে চায়। কোন পথে? বিপ¬বের পথে কি? না, বিচ্ছিন্নতার পথে। ভাঙনের পথে। বিপ¬ব বিশ্বাসী মানুষকে তার অতীত স্মৃতি কষ্ট দেয়। কমরেড চারু মজুমদারের জেলখানায় রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যা আর বার্ধক্য পীড়ায় আক্রান্ত, মানসিক ভারসাম্যহারা মহান বিপ¬বী নেতা কানু সান্যালের আত্মহত্যার স্মৃতি বিচলিত করে। সাম্যবাদী বিপ¬বের ভূমি উত্তরবঙ্গ আজ ভোটের রাজনীতি আর ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির গোলকধাঁধায় পড়ে খন্ডিত বাংলাকে আরও অধিক খন্ডে খন্ডিত করতে চায়। পরিণতিতে কী ঘটবে তা ভবিষ্যৎই বলবে। বাংলা ভাষা, বাঙালি আর বাংলা ভূমি নিয়ে ষড়যন্ত্রের যে ইতিহাস তা যেমনি প্রাচীন, তেমনি দীর্ঘ। এই ষড়যন্ত্রে জড়িত কেবল ইংরেজরাই নয়, সাতচলি¬শ-উত্তর হিন্দি-বলয়ের ভারতীয়রা এবং উর্দুভাষী পাকিস্তানিরা। আধুনিককালের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলেই সাতচলি¬শে বাংলা (নবাবি বাংলা) দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। যেহেতু পূর্ববঙ্গকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব, ভাষা বিদ্রোহের জন্ম এবং একাত্তরের রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেহেতু ইতিহাসে আলোচনাও হয় তা অধিক। আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও স্থান পায়। পশ্চিমবঙ্গ পায় না।
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো ঔপনিবেশিক যুগে ভারতবর্ষে প্রদেশ বিভক্তি এবং সীমানা নির্ধারণের সময়ই বাংলা ভাষাভাষীদের অঞ্চল কাটছাঁট করা হয় সুকৌশলে। সাতচলি¬শের পর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তাদের খন্ডিত অংশকে রক্ষা করতে অনেক সংগ্রাম করেছে। সুকৌশলে সেসব ঘটনাকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে কিংবা স্থান দেওয়া হয়নি। আজকের পশ্চিমবঙ্গবাসীর অনেকেই জানে না পুরুলিয়া জেলা যে বিহারের অংশ ছিল বাঙালি অধ্যুষিত হয়েও। স্বাধীনতার পর ছয় বছর সংগ্রাম করে নেহরুর কংগ্রেস সরকার থেকে তা ছিনিয়ে আনা হয় ১৯৫৩ সালে। কিন্তু থেমে থাকেনি বাংলা, বাঙালি, বঙ্গভূমি শব্দগুলো মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র। চূড়ান্ত হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে অদৃশ্য করে ফেলার। বিহার ও পশ্চিমবঙ্গকে একত্র করে নতুন নামের প্রদেশ তৈরির প্রস্তাব কাগজে-কলমে ঠিক করে ফেলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এবং বিহারের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিংহ। এই ইচ্ছা পূরণ ঘটেনি বাধার মুখে। যদি সফল হতো তবে ভারতবর্ষে বাঙালি বলে কোনো জাতিই থাকত না। কেননা বিহার-পশ্চিমবঙ্গ সংযুক্ত হলে নতুন নাম হতো ‘পূর্ব প্রদেশ’। তখন বিহারের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি আর পশ্চিমবঙ্গের আড়াই কোটি। বাঙালি হতো সংখ্যালঘু। যেদিন বাঙালির বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র বিফল করেছিল ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের সমর্থক নানা সংগঠন। আন্দোলনের সামনে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম নেওয়া বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। বাঙালির জাতীয় বিপর্যয়ের দিনে তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাম-কমিউনিস্টরা। নিষ্ঠুর সত্য এটাও যে সেদিন বাঙালির একটি অংশ বাঙালিবিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ প্রশ্নে। আজ তা অধিক বহমান। ক্রমাগত ভাঙনে নবাবি, সুলতানি যুগের অখন্ড বাংলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে পরিণত হচ্ছে। সেই বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপের মতো। হাজার বা দুইশ বছর আগের সন্দ্বীপ কি আজ আর আছে? বাঙালির একটি মাত্রই স্বাধীন-সার্বভৌম ভূমি আছে, ক্ষুদ্র সে বিশ্বমানচিত্রে। তবু সে বাংলাদেশ নামে আছে একাকী সাহসেরই সঙ্গে। আসাম গ্রাস করেছিল সিলেটকে। সে বেরিয়ে এসেছে। পারেনি বরাক-শিলচরের বাঙালিরা। ১৯৬১ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে পুলিশের গুলিতে রেলস্টেশন, রেল ¯ি¬পারের ওপর প্রাণ দিল কিশোরী কমলা ভট্টাচার্যের সঙ্গে মোট ১১ জন। তাদের ভাষা আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। বাংলা কিংবা বিহার সীমান্তে সীমান্তের ভেতর রেনেসাঁর বাঙালি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং আরও অনেকের শখের উপনিবেশ আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে পড়ে ভাগলপুর, দেওঘর, হাজারীবাগ, গিরিডিহি, নৈতিতাল, শিমলার মাটিতে। ধ্বংসাবশেষ থাকলেও আজ বাঙালি নেই। সৈয়দ ওয়ালিউল¬াহের ‘একটি তুলসীগাছের কথা’ গল্পটি মনে রেখে প্রশ্ন করা যায় আজও কি বাঙালির উদ্বাস্তু যাত্রা শেষ হয়নি? হয়তো হবেও না কোনো দিন। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাবে আমেরিকায়, কানাডায়। না-পারলে হিন্দুস্থানে। সে ভাঙবে, বিচ্ছিন্ন হবে নিজেই নিজের ভেতর। এই ভাঙন-বিচ্ছিন্নতাই বাঙালির নিয়তি।
লেখক কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক


দৈনিক লোকসমাজ এগিয়ে যাবে আপন গতিতে
অধ্যাপক শেখ দিদারুল আলম

এই তো সেদিনের কথা। ১৯৯৫ সালের ৩০ অক্টোবর। যশোর থেকে একটি নতুন দৈনিক পাঠকের চাহিদা মিটাতে বাজারে এলো। সেই দৈনিকটি দেখতে দেখতে ২৫ বছর পূর্ণ করে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। হ্যাঁ, আমি দৈনিক লোকসমাজের কথা বলছি। সাবেক মন্ত্রী ও দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ মরহুম তরিকুল ইসলামের সপ্নের ফসল এই লোকসমাজ। গণতন্ত্র প্রিয় এই মানুষটি লোকসমাজের মাধ্যমে দেশের জনগণের কথা বলতে চেয়েছিলেন। জনগণের সুখ ও দুঃখের ভাগীদার হতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিতে তার মতাদর্শ ছিল। কিন্ত মিডিয়াতে একেবারে নিরপেক্ষ থেকে সকল দলের সকল মতের কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের একটা নেশা আজও বিদ্যমান। সেটা হলো রাজধানী ঢাকা হোক আর খুলনা যশোর কুষ্টিয়া বা দেশের যে কোন জেলা শহর থেকে হোক, কোন বাংলা বা ইংরেজি দৈনিক বের হলে তার উদ্বোধনী বা প্রথম সংখ্যাটি আমি যে কোন উপায়ে সংগ্রহ করতে চেষ্টা করি। কারণ উদ্বোধনী সংখ্যায় যেমন অনেক বিদগ্ধজনের লেখা থাকে তেমনি দৈনিকটির গুণগত মান যাচাই করা যায়। দেশের সাংবাদিকতার কিংবদন্তি মরহুম আতাউস সামাদ বলতেন, শেখার শেষ নেই। আর সাংবাদিককে সব সময় শেখার মধ্যে থাকতে হয়। তাই পড়ার বিকল্প নেই। গুরু এই সাংবাদিকের বাণী মাথায় রেখে সব সময় নতুন কিছু শিখতে চেয়েছি। তাই বিভিন্ন দৈনিকের বিদগ্ধজনের লেখা আমার শেখার আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে দেয়। বন্ধু ও ভাই আবু তৈয়বের মাধ্যমে আমি লোকসমাজের প্রথম কপিটি সংগ্রহ করেছিলাম। লোকসমাজ অল্প দিনে পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে যায়। যশোর জয় করার পর খুলনা নগরী, বিশেষ করে খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় লোকসমাজ পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। তাই যখন আমার ছোট ভাই ও জাতীয়তাবাদ আদর্শের অন্যতম সৈনিক ও লোকসমাজের খুলনা প্রতিনিধি এহতেশামুল হক শাওন লোকসমাজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটা কিছু লেখার তাগিদ দিল তখন তাকে আর না করতে পারিনি। সংবাদপত্রকে সমাজের আয়না বলা হয়। কিন্তু সে আয়না আমরা কতটুকু কাজে লাগাতে পারছি সেটাই মূল কথা। পিআইবি’র এক সময়ের মহাপরিচালক ও অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক টাইমসের সম্পাদক মরহুম শহীদুল ইসলামের একটা কথা প্রায় মনে হয়। তিনি সাংবাদিক প্রশিক্ষণ বা কর্মশালাগুলোতে বলতেন, নিউজ বা সংবাদের সেন্সর শুধু মাত্র সরকার করে না। মিডিয়ার মালিক বা সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক বা রিপোর্টারও নিউজ সেন্সার করে। কখনো করে নিজের প্রয়োজনে, কখনো ভয়ে, কখনো আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য, আর কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। তাই সত্যিকারের সাংবাদিককে লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে, সাহসী হতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয় যা থাকুক না কেন, নিউজে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। আপনাকে দেখতে হবে জনগণের ও দেশের কল্যাণ। দেশ ও জনগণের জন্য যা কিছু ভালো তাকেই আপনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণ হবে না এমন কিছু করা যাবে না। বিভিন্ন জেলা থেকে যে দৈনিকগুলো বের হয় তাদের খবরে উঠে আসতে হবে এলাকার সমস্যা ও সমাধান। এলাকার না জানা বিষয়গুলো তুলে আনতে হবে পাঠকের সামনে। তবে মজার বিষয় একসময় স্থানীয় দৈনিকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খবরাখবর নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এই দিক দিয়ে দৈনিক লোকসমাজ অগ্রগামী ভুমিকা পালন করেছে। ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে লোকসমাজ আত্মপ্রকাশ হওয়ার পর তারা স্থানীয় নিউজের দিকে নজর দেয়। যার কারণে তাদের পাঠকপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। আমরা এ কথা জানি, মফস্বল থেকে একটা দৈনিক বের করে তাকে টিকিয়ে রাখা কত না কঠিন। মফস্বল দৈনিককে বহুমুখী সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। আর্থিক দৈন্যতা লাগেই থাকে। আমি অনেক দৈনিকের কথা জানি যেগুলো বিভিন্ন সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বা নিভু নিভু বা কোন রকমে টিকে আছে। সে দিক থেকে ২৫ বছর পার করতে চলছে লোকসমাজ। একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে আজকের এই দিনে আমার প্রত্যাশা পাঠক মন জয় করে লোকসমাজ এগিয়ে যাবে আপনগতিতে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, খুলনা।

সাক্ষরতা ও শিক্ষায় বৈষম্য
মাছুম বিল্লাহ

সাক্ষরতা ও শিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্যকে প্রকটতর করেছে এই কভিড মহামারী। ৭৭৩ মিলিয়ন নিরক্ষর জনগণের জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। বহু দেশই কভিড-১৯ মোকাবিলা করার জন্য যেসব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে নিরক্ষরদের জন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা, সাক্ষরতা ধরে রাখা কিংবা সাক্ষরতা ভুলে না যাওয়ার জন্য কোনো ধরনের পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে অসংখ্য সাক্ষরতা কর্মসূচিতে কাজ করা প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এসব কারণে শিক্ষার এবং শিক্ষার মার্জিনাল পয়েন্ট অর্থাৎ সাক্ষরতার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।
যাদের অবস্থান সাক্ষরতার বহু ওপরে ছিল গত সতেরো-আঠারো মাসে তাদের অনেকেই সেই যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে অর্থাৎ নিরক্ষরতার কাতারে শামিল হয়েছে। আমি নিজে আগস্টের ৩০ তারিখ থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রংপুর-গাইবান্ধার বিভিন্ন বিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাসংশি¬ষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার অবস্থা জানার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি। শিক্ষার্থীদের সাধারণ বিষয় লিখতে যখন বলা হলো দেখলাম যে লেখা তারা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লেখার কথা তা লিখতে কয়েক মিনিট লগিয়ে দিচ্ছে, তার পরও লিখতে পারছে না। আমি নিজে বুঝলাম এবং সংশি¬ষ্টরাও বলল যে, এত দিন লেখার অভ্যাস নেই বলে এ অবস্থা হয়েছে। ডিজিটাল সভ্যতার এই যুগে সাক্ষরতাকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, তা না হলে বৈশ্বিক অগ্রগতি সমতালে তো নয়ই বরং বহু ব্যবধান নিয়ে এগোবে। ডিজিটালি পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১৭ সালে তাদের একটি রিপোর্টে দেখিয়েছিল যে, ওই বছর প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৮.৪ শতাংশ এবং যে শিশুরা কখনোই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি কিংবা যায়নি তাদের হার প্রায় ২ শতাংশ। এই হারের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়েছে যে, সারা দেশে ৮-১৪ বছর বয়সী প্রায় ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন শিশু রয়েছে যারা বিদ্যালয়ের বাইরে অবস্থান করছে অর্থাৎ এই অপার সম্ভাবনাময় শিশুরা নিরক্ষর। সরকার যদিও বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে দারিদ্র্যের কারণে উলে¬খযোগ্য সংখ্যক শিশু হয় কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি কিংবা কখনো প্রাথমিকে ভর্তি হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রোগ্রামের (পিইডিপি-৪) আওতায় ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রোগ্রাম’ এসব শিশুর দ্বিতীয় সুযোগ হিসেবে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসছে এবং এটি ২০২১ জানুয়ারি মাসে প্রথমবারে ৮-১৪ বছর বয়সী পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি করার কথা। সে কাজটি কিন্তু সেভাবে এগোয়নি এই করোনার কারণে। এই উদ্দেশ্যে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর এনজিওদের সহায়তায় সারা দেশে ৩২০০০ ও বেশি লার্নিং সেন্টার স্থাপন করার কথা। বর্তমানে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরো দেশের ছয়টি জেলায় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, সিলেট ও সুনামগঞ্জে) পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে চালাচ্ছে এক লাখ শিক্ষার্থীর জন্য। এই পাইলট প্রজেক্ট শেষ হতে যাচ্ছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। তবে, শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির কারণে এটি হয়তো মার্চ ২০২২ পর্যন্ত গড়াবে। তাতে কি আমরা এই শিশু শিক্ষার্থীদের ডিজিটালি সাক্ষর করতে পারব? প্রায় দুই বছর এসব শিশু বইয়ের সংস্পর্শে থাকতে পারেনি। এমনিতেই তাদের যে বিরতি থাকে মূলধারার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, করোনা সেই বিরতিকে আরও বাড়িয়ে দিল। তাই, আমার মনে হয় এই শিশুদের অর্থাৎ যাদের ওপর পাইলটিং করা হয়েছে তাদের বিরতি কাটানোর জন্য, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য কমপক্ষে পুরো ষষ্ঠ শ্রেণিটিই এই প্রজেক্টের আওতায় তাদের ধরে রাখার ব্যবস্থা করা উচিত।
আমাদের দেশের অসহায় ও বঞ্চিত পথশিশুদের জন্য রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পের আওতায় দেড় শতাধিক উপজেলায় ২২ হাজারেরও বেশি আনন্দ স্কুলে মোট ৬ লাখ ২৪ হাজার ১০৪ জন পথশিশু শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি ও অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় এরই মধ্যে এ প্রকল্পের অনেক স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আঠারো মাসের করোনাকালীন বন্ধে এসব আনন্দ স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। এই যোগাযোগ না থাকার অর্থ হচ্ছে এখানকার শিশুরা যতটুকু সাক্ষরতা অর্জন করেছিল চর্চার অভাবে তা ভুলে গেছে। অবস্থা স্বাভাবিক হলে এসব শিশুর কত শতাংশ পড়াশোনায় ফিরে আসবে তা সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। আবার যারা আসবে তারাও যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে এবং পড়াশোনা বুঝবে তাও কিন্তু নয়। তাদের জন্য প্রয়োজন হবে বিশেষ ব্যবস্থা যা হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া পড়া ও লেখার দক্ষতা উদ্ধার হওয়ার জন্য প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কি সে ধরনের কোনো ব্যবস্থার কথা শুনছি বা দেখছি?
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে পথশিশুদের ৫১ শতাংশ অশ¬ীল কথা বলে, ২০ শতাংশ শারীরিক এবং ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পথশিশুদের ২৫-৩০ ভাগ মেয়ে, তাদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহেন্সমেন্ট প্রোগ্রামের (সিপ) গবেষণা অনুযায়ী পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশের ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। পথশিশুদের ৮২ শতাংশ নানা ধরনের পেটের অসুখে এবং ৬১ শতাংশ কোনো না কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত। একই গবেষণায় বলা হয়েছে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ পথশিশু একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকে। এই বিশালসংখ্যক শিশু যাদের থাকার স্থায়ী জায়গা নেই, নেই বাবা-মায়ের কোনো খোঁজখবর, তারা নেই বিদ্যালয়ে, কে কোথায় কেমন আছে নেই তার কোনো খবর। এটি একটি বিশাল সামাজিক অনাচার। এই শিশুরা সমাজে এভাবেই বেড়ে উঠছে! বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা র্কর্তৃক পরিচালিত অস্থায়ী কিছু বিদ্যালয়ে তারা সাধারণ মানের কিছু শিক্ষা পেত যা এরই মধ্যে ভুলে গিয়েছে কোনো কঠিন কাজ করতে গিয়ে, নয়তো কোনো অসামাজিক কাজ করতে গিয়ে। এদের সাক্ষরতা পুনরুদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা হবে কি? নাকি আমরা এসি রুমে বসে পাওয়ার পয়েন্টে প্রেজেন্টেশন দিয়ে এদের নিয়ে কথা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব?
লেখক : শিক্ষক ও শিক্ষাবিষয়ক লেখক