সংবাদমাধ্যম সংকুচিত হলে মানুষ গুজবের আশ্রয় নেয়

0

সায়েম সাবু॥ আবার ‘গুজব’। কুমিল্লায় গত ১৩ অক্টোবর এক অভিযোগ ছড়ানোর পর তৈরি হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির। গুজব ছড়িয়ে চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী এবং সবশেষ রংপুরে সাম্প্রদায়িক হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এমনকি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে শিশু ধর্ষণ এবং তারপর মৃত্যুর গুজবও ছড়ানো হয়েছে, যা উসকে দিয়েছে পরিস্থিতিকে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় কেন এভাবে হাতিয়ার হচ্ছে গুজব? এ প্রসঙ্গে সায়েম সাবু সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের।
প্রশ্ন: কুমিল্লায় ‘কোরআন অবমাননা’র অভিযোগ তুলে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে। মন্দির-মণ্ডপ, বাড়িঘরে ভাঙচুর-আগুন দেওয়া হচ্ছে, যা মূলত গুজবের রেশ ধরে। নিশ্চয় পর্বেক্ষণ করছেন?
ড. শাহদীন মালিক: ধর্মের নামে যা হচ্ছে, তা অধর্মের কাজ বলে বিশ্বাস করি। তবে আদৌ ধর্মবাদীরা এসব করছে কি না তার নির্দিষ্ট সূত্র নেই আমার কাছে। যদি মুসলমানরা এসব সহিংসতা ছড়ায়, তাহলে তারা মূলত ইসলামকে জানেন না। ইসলামের সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ধরনের ঘটনা ইসলামের পাশাপাশি দেশের ভাবমূর্তিকেও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নিরীহ মানুষকে হত্যা বা মানুষের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার কথা কোনো ধর্মই বিশ্বাস করে না। অথচ গুজবের ওপর ভর করে মানুষ বিবেকহারা হয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে।
প্রশ্ন: হামলার পর হামলার ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্র ও পুলিশ তা ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে…
ড. শাহদীন মালিক: এখনকার প্রশাসন-পুলিশ অদক্ষ-অযোগ্য বলেই মনে করি। একটি দৈনিকে দেখলাম, চলমান ঘটনায় ২৮টি মামলায় নয় হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে এবং এখন এমন মামলা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। একটি মামলায় যদি ৫০০ মানুষকে আসামি করা হয়, তাহলে সেই মামলার তদন্ত ও বিচার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেষ হবে, তা অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। কখনোই এসব মামলার তদন্ত শেষ হবে না। এমন হামলার সঙ্গে অবশ্যই শত শত মানুষ জড়িত থাকে। কিন্তু মূল হোতা থাকে গুটি কয়েকজন। শত শত মানুষের বিচার করা কোনো দেশের বিচার ব্যবস্থা বা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়। তার মানে হাজার হাজার মানুষকে আসামি করা পুলিশের সম্পূর্ণ অদক্ষতা এবং অযোগ্যতা অথবা জেনে-বুঝে ঘটনাকে চাপা দেওয়া।
প্রশ্ন: কিন্তু মানুষ যে বিবেকহারা হয়ে এমন তাণ্ডব চালাচ্ছে! গুজবে কান দিচ্ছে…
ড. শাহদীন মালিক: গুজবে বিশ্বাস করার বহুবিদ কারণ থাকে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষের কণ্ঠরোধ করা, তার বাকস্বাধীনতা হরণ করা। মানুষ তার মত প্রকাশ করতে পারছে না। গণমাধ্যম তার ভূমিকা রাখতে পারছে না। সংবাদমাধ্যম যা বলছে, তা সব মানুষের কথা নয়। একটি গোষ্ঠীর কথা বলছে। তার মানে সংবাদ মাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। যেখানেই কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা পায়, সেখানেই সংবাদমাধ্যম সংকুচিত হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যম সংকুচিত হলে মানুষ গুজবের আশ্রয় নেয়। এখন আমরা তা-ই দেখতে পাচ্ছি। মূলধারার মিডিয়া থেকে মানুষ চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফেসবুকের সংবাদকেই মানুষ সত্য মনে করছে। আর এসব সহিংসতার কারণে প্রথমত ইসলামের ক্ষতি হচ্ছে, যা তারা বুঝতে পারছে না। দ্বিতীয়ত পুলিশের অদক্ষতার কারণে জনআস্থা আরও কমছে। বিশেষ করে হাজার হাজার মানুষকে আসামি করে মামলার তদন্ত কাজকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এসব মামলার মাধ্যমে সরকার আগেই ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে যে, এসবের বিচার হবে না। তৃতীয়ত যখন কর্তৃত্ববাদী সরকারের কোনো কথাই আর সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না, তখন সত্য-মিথ্যার যাচাই না করে কানকথাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে সহিংসতায় অংশ নেয়।
প্রশ্ন: সমাজ যাচ্ছে কোন দিকে? উত্তরণের উপায় কী?
ড. শাহদীন মালিক: উত্তরণের উপায় আমার আপাতত জানা নেই। তবে চলমান পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে এতটুকু শঙ্কাবোধ করতেই পারি যে, সহিংসতা আরও বাড়বে। যে কারণগুলোর পরিণতিতে সহিংসতার সমাধান আপাতত হচ্ছে না। আর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পুলিশ এই সংকট নিরসন করতে পারবে, তা কেউ বিশ্বাস করে না। সুতরাং বিপদের কথাই বলতে হচ্ছে।