লাগামহীন দাম ১২ নিত্যপণ্যের

0

এমএম মাসুদ॥ বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবহন সংকট ও আন্তর্জাতিক মার্কেটে দাম বাড়লে দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু দেশে এসবের কোনো কারণ নেই। আছে পর্যাপ্ত সরবরাহ। তারপরও রাজধানীর বাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। গত দুই থেকে তিনদিনের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রায় এক ডজনের বেশি পণ্যের দাম বেড়েছে। দাম বৃদ্ধির এই চিত্র সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার দর তালিকায়ও লক্ষ্য করা গেছে। ফলে ভোক্তাকে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। সংসারের মাসিক বাজেটে ঘাটতি পড়ছে অনেকের।
তথ্যে দেখা গেছে, সরু ও মোটা চাল, সয়াবিন, পাম অয়েল সুপার, পিয়াজ, রসুন, ব্রয়লার মুরগি, জিরা, ডাল, ছোলা, আদা, খোলা ময়দা ও এলাচের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে সপ্তাহের ব্যবধানে পিয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা। কেজিতে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। পাশাপাশি সব ধরনের সবজিও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। গতকাল রাজধানীর কাওরান বাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার ও মালিবাগ বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। শুক্রবার টিসিবির দৈনিক বাজার দর তালিকায় দেখা গেছে, একদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি সরু ও মোটা চালের দাম ৩.২৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ ৫২.৬৩ শতাংশ ও আমদানি করা পিয়াজ ৪২ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের দাম ০.৭১ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি প্রতি লিটার পাম অয়েল সুপারের দাম ১.৫০ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সয়াবিন লুজ ১.৫০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি কেজি দেশি রসুন ২৫ শতাংশ ও আমদানি করা রসুন ৯.০৯ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া একদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ৬.০৬ শতাংশ, চিনি ১.৯৪ শতাংশ, জিরা ২.৮৬ শতাংশ, ময়দা (প্যাকেট) ২.১১ শতাংশ, আটা (প্যাকেট) ১.৩৫ শতাংশ, আমদানি করা আদা ১৩.০৪ শতাংশ ও ছোট দানার এলাচ ৫.৪৫ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত শনিবার থেকে ধাপে ধাপে পিয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরবরাহ ও মজুত ঠিক থাকলেও পূজায় আমদানি কমার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন বিক্রেতারা। ফলে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ সর্বোচ্চ ৮২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা দুদিন আগেও ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। তবে গতকাল বাড়তি দামে স্থির রয়েছে পিয়াজের মূল্য। গতকাল খুচরা বাজারে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে পিয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা। হঠাৎ পিয়াজের এমন দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কাওরান বাজারের পিয়াজ বিক্রেতা মতিন মিয়া বলেন, পূজার কারণে কয়েকদিন ধরে ভারত থেকে পিয়াজ কম আসছে। আবার ভারতের বাজারে পিয়াজের দাম বাড়ছে। এছাড়া বাজারে দেশি পিয়াজের সরবরাহও কিছুটা কমেছে। সবমিলে পিয়াজের দাম বেড়ে গেছে। কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, করোনাকালে আয় কমে যাওয়ায় ভোক্তারা সব কিছুতেই ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম তাদের আরও বেশি দিশাহারা করে তুলছে। তাই সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বাজার তদারকির পাশাপাশি পণ্যের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরবরাহ ও মজুত গড়ে তোলা উচিত। এতে বাজারে পণ্যের দাম কমবে। ভোক্তারাও সুফল পাবেন।
চাল: বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চালের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। সব ধরনের চালের দাম না বাড়লেও প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়। যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকায়। মালিবাগ কাঁচাবাজারের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক ও খুচরা চাল বিক্রেতা দিদার বলেন, কয়েকদিন চালের দাম কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও মিলাররা আবার চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছেন। ফলে তাদের বেশি দরে এনে বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
সয়াবিন: নতুন করে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের মধ্যে পাঁচ লিটারে ১০ টাকা বেড়ে ৭৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাম অয়েল সুপার লিটারে ৫ টাকা বেড়ে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি চিনি ৭৮-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা একদিন আগেও ৭৫-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
মুরগি: দফায় দফায় বাড়তে থাকা ব্রয়লার ও পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগির দাম নতুন করে আরও বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে কেজিতে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। আর সোনালি মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ব্যবসায়ীরা ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ১৭৫-১৮০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৬৫-১৭০ টাকা। আর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ছিল ১২০-১৩০ টাকার মধ্যে। এ হিসাবে মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৬০ টাকা বেড়েছে। এদিকে ব্রয়লার মুরগির মতো পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগির দামও দফায় দফায় বেড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ২১০-২৩০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগির দাম কয়েক দফা বেড়ে এখন ৩২০-৩৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে এই মুরগির কেজি বিক্রি হয় ৩০০-৩২০ টাকা। এ হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে সোনালি মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। মুরগি ব্যবসায়ী আলী বলেন, মাসখানেক আগেও ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম বেশ কম থাকায় ফার্ম মালিকরা মুরগির উৎপাদন কমিয়ে দেন। তাই এখন বাজারে মুরগি সরবরাহ কম। অন্যদিকে হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে। আবার বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। ফলে মুরগির চাহিদা বেড়েছে। সবমিলিয়ে মুরগির দাম বেড়ে গেছে। রামপুরা বাজারে ব্রয়লার মুরগি কিনতে আসা আতিক বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। মাসে এক-দু’দিন পরিবার নিয়ে মাংস-ভাত খাবো এখন তার উপায়ও নেই। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০ টাকা হয়ে গেছে। আরেক ক্রেতা মুহিত বলেন, পণ্যের কোনো সংকট না থাকলেও দাম বাড়তি। বাজারে সব পণ্য পাওয়া গেলেও বাড়তি দরে কিনতে হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি নেই। যা করা হয় তা সবই লোক দেখানো। কাজের কাজ কিছু হয় না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। যৌক্তিক দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলেই শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
মসলা-অন্যান্য: প্রতি কেজি আমদানি করা রসুন ১০ টাকা বেড়ে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি জিরা ২০ টাকা বেড়ে ৪২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। খোলা ময়দা কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে ৪৩ টাকায় বিক্রি হয়ে হয়েছে পাশাপাশি প্রতি কেজি ছোট দানার এলাচ ২০০ টাকা বেড়ে ৩৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সবজি: বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা এখন সব থেকে বেশি দামে বিক্রি করছেন গাজর। মানভেদে এক কেজি গাজর ১০০-১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে এই সবজি দুটির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এখন শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা। আকার ভেদে লাউ ৬০-৮০ টাকা, ফুলকপি ৪৫-৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ঝিঙা ৮০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, পটোল ৫০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০ টাকা, আকার ভেদে বেগুন ৬০-৮৫ টাকা, এছাড়া কাঁচামরিচ ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সবজি ব্যবসায়ী শফিক বলেন, বন্যা ও বৃষ্টির কারণে মাঝে সবজির ক্ষেতের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে এখন সবজির সরবরাহ বেড়েছে। পাশাপাশি শীতের আগাম সবজির সরবরাহ বাজারে বাড়ছে। তাই আশা করা যায়, কয়েকদিনের মধ্যে সবজির দাম কিছুটা কমে আসবে।