এ বিরোধ অপ্রয়োজনীয়

0

শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি গত সপ্তাহে কিছুটা শ্লথ হতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সেচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে নীতিসংক্রান্ত বিরোধ-বির্তক তৈরি হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এই প্রবৃদ্ধিশ্লথতার কারণ সেটাই বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। গত সপ্তাহের প্রথম দিন ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জের পয়েন্ট ওঠে ৭২৫৮। আর বৃহস্পতিবার তা দাঁড়ায় ৭২২৮-এ। ডেইলি এভারেজ টার্নওভার কমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে। একথা স্বীকার করতেই হবে, শেয়ারবাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সঙ্গতকারণেই বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টদের আশাবাদী করে তুলেছে। বহুদিন যাবৎ শেয়ারবাজার একটা হতাশার জায়গা হয়ে ছিল। একাধিকবার শেয়ারবাজারে বিপর্যয় ঘটেছে, যাতে বিনিয়োগকারীরা বিশেষ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে। কার্যত শেয়ারবাজার একটি নামকাওয়াস্তের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। বাজার প্রায় সম্পূর্ণ ধসে যাওয়ার পর তার উঠে দাঁড়ানো মোটেই সহজ ছিল না। সোজা হয়ে দাঁড়াতে তার সময় লেগেছে অনেক। শেয়ারবাজারের এই অভূতপূর্ব উত্থানের মূলে বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রোবাইয়েতুল ইসলামের ভূমিকা প্রধান ও অনস্বীকার্য বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাঁর নেয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ শেয়ারবাজারকে ফের মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। মানুষ বিপুল উৎসাহে এগিয়ে এসেছে বিনিয়োগ করতে। অধ্যাপক ইসলাম দক্ষ, অভিজ্ঞ, সৎ ও উদ্যমী মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি এবং কমিশনের অন্য সদস্যরা শেয়ারবাজারকে একটি আস্থার জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। ফটকাবাজারী, ম্যানিপুলেশন বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু নিয়ম-কানুন কমিশন কার্যকর করেছে। কিছু সংস্কারের পরিকল্পনাও তার রয়েছে।
শেয়ারবাজারকে আরো নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ বিনিয়োগের জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনের বেশ কিছু উদ্যোগ, পদক্ষেপ ও প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই রেগুলেটরি সংস্থা পরস্পর মুখোমুখী অবস্থান নিয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। বিষয়টি অনাভিপ্রেত তো বটেই, দুঃখজনকও। বাংলাদেশ ব্যাংক বিএসইসি’র ওপর তার নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। অথচ, শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের সময় তার সুরক্ষায় এবং বিনিয়োগকারীদের সহায়তায় বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি তাকে। শেয়ারবাজারের সবচেয়ে সুদিনের এই সময়ে তার ওপর খবরদারি করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক উঠে পড়ে লেগেছে। এতে বিএসইসি যেমন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে ও তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না, তেমনি দু’পক্ষের বিরোধের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, অনীহা ও হতাশা তৈরি হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যপরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার নানা ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও অপরাগতা অস্বীকার করা যাবে না। অন্যান্যের ওপর খবরদারির কর্তৃত্ব থাকলেও তার কাজের ক্ষেত্রে নানা প্রশ্ন বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদেশে টাকা পাচার হয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ তা রুখতে পারেননি। টাকা পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার সম্পৃক্ত থাকা সম্ভবযোগ্য হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বহুল আলোচিত পিকে হালদারের টাকা পাচারের সঙ্গেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অথচ, বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। সাম্প্রতিককালে অনলাইন জুয়ার বিস্তার, টাকা পাচার, বিভিন্ন এলএমএম কোম্পানির বিরুদ্ধে টাকা মেরে দেয়া বা টাকা পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিকার দেখা যায়নি। পাচারকৃত টাকা ফেরৎ আনার ক্ষেত্রে তার কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরের কাছ থেকে দেশের মানুষ অনেক কিছু আশা করলেও তিনি সে আশা পূরণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। কী করছেন তিনি, এ প্রশ্ন যখন ওঠে, তখন দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। দেড় বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর সবকিছু খুলেছে। এই সময়ে কৃষি, প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় কিছুটা ইতিবাচক থাকায় অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ পড়েনি বটে, তবে মানুষ দরিদ্র হয়েছে, কর্ম ও আয় হারিয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রীর মূল্য দফায় দফায় বাড়তে বাড়তে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমতাবস্থায়, মানুষের অভাব ও কষ্টের কোনো শেষ থাকেনি। এখন কৃষি ঠিক থাকলেও প্রবাসী ও রফতানি আয়ে ভাটার টান পড়েছে। রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক নয়। ফলে আগামীতে একটা বড় রকমের দুর্দিনের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যখন অর্থনীতির প্রায় সকল সূচক নিম্নমুখী, তখন একমাত্র আশা জাগানিয়া জায়গা হলো শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজার ক্রমশ স্ফীত ও গতিশীল হচ্ছে। সাধারণের বিনিয়োগ যেমন বাড়ছে, তেমনি শেয়ারবাজার থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পুঁজির সংস্থান করে নিতে পারছে। সেই ‘সবে ধন নীলমণি’ শেয়ারবাজারের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম এপ্রসঙ্গে বলেছেন, সকল নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উচিৎ ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া। অন্যথায় সেটা গণআস্থার ওপর আঘাত হানে। তার এ বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরা আশা করবো, বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষমতার এখতিয়ার প্রদর্শন পরিহার করে বিএসইসির সঙ্গে মিলে এমন সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেবে, যাতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং বিনিয়োগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।