এক লড়াকু বিজ্ঞানীর কাহিনী

0

সৈয়দ আবদাল আহমদ
মানবকল্যাণে নিবেদিত একজন বিজ্ঞানীর কথা। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার তাকে ২০২০ সালের জন্য ‘সায়েন্সেস ডিফেন্ডার’ বা ‘বিজ্ঞানের রক্ষক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। করোনাভাইরাস মহামারী সঙ্কটে অনন্য অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে তিনি ‘জাতির চিকিৎসক’ হিসেবে আবির্ভূত হন। বিশ্ব মিডিয়ায় তিনি এখন জনপ্রিয় ও আলোচিত মুখ। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রাণঘাতী রূপ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে তিনি আগেই সতর্ক করেছেন। তার মতে, এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে করোনার ডেল্টা ধরন। যুক্তরাষ্ট্রে টিকা নেয়নি এমন লোকজনের জন্য এ ঝুঁকি ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আলোচিত এই বিজ্ঞানী হলেন ড. অ্যান্থনি ফাউসি। যুক্তরাষ্ট্রের এনআইএইচের জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের (এনআইএআইডি) পরিচালক। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবেই তিনি একবাক্যে বিশ্বে পরিচিত। আগামী ডিসেম্বরে ৮১ বছরে পা দেবেন এ বিজ্ঞানী। কিন্তু এখনো তিনি বিরামহীনভাবে কাজ করেন। সপ্তাহে সাত দিনই দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন ফাউসি। এত বড় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেও সরাসরি কোভিড-১৯ ও এইচআইভি বা এইডস রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসায় সময় দেন। এ প্রসঙ্গে ড. ফাউসি বলেন, রোগীদের সরাসরি দেখলে রোগ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, বিজ্ঞানী অ্যান্থনি ফাউসি ভবিষ্যতে এইডস ও হেপাটাইটিস সি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য দেখাবেন। ১৯৪০ সালে নিউ ইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনে জন্ম তার। বাবা ছিলেন ফার্মাসিস্ট। তাদের পূর্বপুরুষ ইতালির নেপলস থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। স্কুলজীবনে ফাউসি বাস্কেটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন।
ড. অ্যান্থনি ফাউসিকে কেন ‘সায়েন্সেস ডিফেন্ডার’-এ ভূষিত করা হয়েছেন তার বিস্তারিত তথ্য নিবন্ধে উল্লেখ করেছে নেচার সাময়িকী। এতে বলা হয়, সংক্রামক রোগ নিয়ে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন অ্যান্থনি ফাউসি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের প্রধান হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান থেকে শুরু করে ছয়জন প্রেসিডেন্টের পরামর্শক ছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ফাউসিকে তার জনস্বাস্থ্যবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি তাতে সম্মত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।জীবাণু অস্ত্রের হামলার আশঙ্কাসহ এইচআইভি, ইবোলা ও জিকার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে করণীয় নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন ফাউসি। সর্বশেষ করোনাভাইরাস সঙ্কটে অনন্য অবদান রাখছেন ফাউসি। এ জন্য ‘জাতির চিকিৎসক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। করোনা মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সাথে প্রায়ই বিরোধে জড়িয়ে পড়তেন। এ জন্য ফাউসিকে বরখাস্ত করার হুমকিও দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু নিজ দায়িত্ব পালনে ছিলেন নির্ভীক। বিভিন্ন মহামারীতে বৈজ্ঞানিক সমাধান কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমেরিকার নাগরিক ও সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প করোনাভাইরাস সম্পর্কে অবৈজ্ঞানিক মনগড়া তথ্য দিলে ফাউসি তার প্রতিবাদ করেছেন এবং বলেছেন, একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি বিজ্ঞানের বাইরে কোনো বক্তব্যকে সমর্থন দিতে পারেন না।
ফাউসির এ অনমনীয় মনোভাব যেমন বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি তার শত্রুও জুটেছে অনেক। তাকে ‘ঘাতক’ ও ‘অযোগ্য অপদার্থ’ বলে গালমন্দও শুনতে হয়েছে। তবে এসবকে আমলে না নিয়েই তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এইডস মহামারীর সময় একবার কিছু লোক তার অফিসের সামনে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিল। তিনি তখন তাদের তার কক্ষে আমন্ত্রণ জানান এবং কথা শোনেন। এইডস নিয়ে কাজের জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়র ফাউসিকে বীর বলে মন্তব্য করেছিলেন। তার ছেলে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সাথেও কাজ করেছেন ফাউসি। তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধের পক্ষে কথা বলায় ফাউসি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। ট্রাম্প চাইছিলেন করোনার তাণ্ডবকে খাটো করে দেখাতে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যথাসম্ভব চালু রাখতে। ট্রাম্পের উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন তো হোয়াইট হাউজের বাইরে ফাউসি মাথা দেখার খায়েশ প্রকাশ করেছিলেন। এরপর তার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ফাউসি বলেছিলেন, জনগণের জীবন রক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এক কথায়, এক দিকে ভাইরাস ও সংক্রামক রোগব্যাধির বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ, অন্য দিকে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে লড়াই। আমরা জানি একপর্যায়ে ট্রাম্প করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যর্থতার কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়লে ফের পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন ফাউসি।
করোনার টিকা আবিষ্কার সম্পর্কে ফাউসি
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কারের সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত ‘সায়েন্স সাময়িকী’তে এক নিবন্ধ লিখেন ড. ফাউসি। নিবন্ধে উল্লেখ করেন, করোনাভাইরাসে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু ও সংক্রমণে মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ছিল, তখন আশার আলো হয়ে এসেছিল এ রোগের বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কারের খবর। কিছু দিন আগেও যে রোগটি সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না, তা শনাক্ত হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে উচ্চমাত্রার কার্যকর কয়েকটি টিকা আবিষ্কার হয়েছে। টিকা আবিষ্কারের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা। আগে একটি টিকা আবিষ্কারের জন্য যুগের পর যুগ না হলেও অন্তত বছরের পর বছর সময় লেগে যেতে। এবার কয়েক মাসের মধ্যে সেই অসাধ্য সাধিত হয়েছে। এত দ্রুত টিকা আবিষ্কার হওয়ায় অনেকের মনে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নও জেগেছে। তবে বিজ্ঞান বলছে, এ টিকা নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। করোনার টিকা আবিষ্কারে অনন্য অবদান রেখেছে অস্বাভাবিক দ্রুততায় ভাইরাসটির ‘জিনোম সিকোয়েন্সিং’। আগে এ কাজে কয়েক দশকও লেগে যেত। কোভিড টিকা আবিষ্কারে আরেকটি বড় সাফল্য ছিল আরএনএর মতো উচ্চ দক্ষ প্ল্যাটফরমের ব্যবহার। বিজ্ঞানী ড্রিউ ওয়াইজম্যান ও ড. ক্যাটালিন কারিকোর মতো ব্যক্তিদের বহু বছরের সাধনাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি দ্রুত টিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেসেঞ্জার আরএনএ বা এমআরএনএ ব্যবহার করে করোনার টিকা আবিষ্কার করতে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে গবেষণা হয়েছে, তাও এ টিকা দ্রুত আসার পেছনে সহযোগিতা করেছে। মূলত এইডসের টিকা আবিষ্কারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন রিসার্চ সেন্টারে (ভিআরসি) এ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ চললেও এখনো তাতে সাফল্য আসেনি। তবে এ গবেষণা কোভিড টিকা আবিষ্কারে সহায়ক হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের (সার্স-কভ-২) বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে কার্যকর স্পাইক প্রোটিন সৃষ্টির মাধ্যমে ভাইরাসটিকে নির্জীব করে দেয়া হয়। বিজ্ঞানী ড. বার্নি গ্রাহাম, ড. কিজমেকিয়া করবেট ও ড. অ্যান্ড্রু ওয়ার্ডের মতো গবেষকরা মার্স ও সার্সের বিরুদ্ধে কার্যকর স্পাইক প্রোটিন তৈরিতে সক্ষম হন। এ পদ্ধতিতেই তৈরি হয়েছে মডার্না ও ফাইজারের কোভিড টিকা। পরে বিভিন্ন ধাপের পরীক্ষায় এসব টিকার উচ্চ কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেছে। মডার্না ও ফাইজারের কোভিড টিকা ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর।
ডেল্টা ধরন সম্পর্কে ফাউসির হুঁশিয়ারি
করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি (ডিসেম্বর ২০২০-এ প্রথম শনাক্ত) বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে পরিচিত। এ সম্পর্কে ড. ফাউসি সতর্ক করে বলেন, করোনার এ ডেল্টা ধরনটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বা বাজে একটি ধরন। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার ক্ষমতা এর অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী ডেল্টা এখন পর্যন্ত ১৩৫টিরও বেশি দেশে ছড়িয়েছে। এপ্রিল-মে মাসে ভারতে ডেল্টা ধরন বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এটি ভারতে শনাক্ত হয় বলে ভারতীয় ধরন হিসেবে পরিচিত। এখন সেটি এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও বাড়ছে সংক্রমণ। ডেল্টার সংক্রমণ বাংলাদেশেও ব্যাপক বেড়েছে। বিএসএমএমইউ হাসপাতালের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে এখন ৯৮ শতাংশই ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুত ছড়ানো ও সবল ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা। এ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তির নাকে করোনার মূল ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি ভাইরাস থাকে। ডেল্টায় মারাত্মক আকার ধারণ করার কারণ স্পাইক প্রোটিনের বাজে মিউটেশন। করোনার আলফা, বেটা ও গামা ধরনের চেয়ে এই প্রজাতির স্পাইক প্রোটিনে খুব শক্তভাবে বসে যায় অ্যাসিটাইলকোলিন। যা দেহের ইমিউনিটি ভেঙে ‘ভাইরাস জিনকে’ সহজেই কোষে প্রবেশ করিয়ে দিতে সাহায্য করে। আলফা স্ট্রেইনের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি এর ক্ষমতা। সিএনএনে এবং এবিসি নিউজের ‘দিস উইকে’ অনুষ্ঠানে ডেল্টা নিয়ে কথা বলেছেন ড. ফাউসি। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভুলভাবে করোনা মহামারী মোকাবেলা করতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখনো টিকা না নেয়া মানুষের সংখ্যা অনেক। যেসব এলাকায় টিকা দেয়ার হার কম, সেখানে ডেল্টার সংক্রমণ বেশি। তিনি বলেন, যারা টিকা নিচ্ছেন তারা নিজেকে গুরুতর অসুস্থ হওয়া এবং মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করছেন। আর যারা টিকা নিচ্ছেন না তারা কার্যত ভাইরাসের বংশবিস্তারে সাহায্য করছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব টিকা আছে তা ডেল্টার ক্ষেত্রেও খুব কার্যকর। ডেল্টা দ্রুত ছড়াচ্ছে, এটি খারাপ খবর। তবে ভালো খবর হচ্ছে এর মোকাবেলায় আমাদের টিকাও আছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনার ইউকে বা আলফা ধরন ছড়িয়েছে ১৮২টি দেশে, বেটা বা দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন ছড়িয়েছে ১৩২টি দেশে এবং ব্রাজিল বা গামা ধরন ছড়িয়েছে ৮১টি দেশে। ডেল্টা ধরনের বৈজ্ঞানিক পরিচিতি বি-১-৬১৭। ডেল্টার ২৩টি অধিক মিউটেশন হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মিউটেশন মারাত্মক। এগুলো হচ্ছে এল-৪৫২আর, পি-৬১৪আর, টি৪৭৮কে। ডেল্টা ধরনগুলো নাকের বিশেষ জায়গায় আংকটার মতো লেগে গিয়ে ফুসফুসে জায়গা করে নেয়। এগুলো বেশি ছোঁয়াচে এবং রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠায়। এ জন্য ডেল্টায় মৃত্যু বেশি। করোনার ডেল্টা ধরন জলবসন্তের মতো ছড়াচ্ছে। ইসরাইল, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে করোনা টিকার ‘বুস্টার ডোজ’ দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টিকার উদ্বুদ্ধ করার জন্য বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন যারা টিকা নেবে তাদের প্রত্যেককে ১০০ ডলার করে দেয়া হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, বিশ্বের জনগণকে টিকার আওতায় না এনে, শুধু ধনী দেশগুলোর জন্য ‘বুস্টার ডোজ’-এর ব্যবস্থা করা হলে মহামারী থামানো যাবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব