তিউনিসিয়ায় কেন একনায়কত্বের পদধ্বনি?

0

মাসুম খলিলী ॥ আরব বসন্ত বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত তিউনিসিয়াতেও শেষ পর্যন্ত একনায়কতন্ত্রের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠেছে। গত ২৫ জুলাই, প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ তিউনিসিয়ার সংসদ স্থগিত ঘোষণা করেন, প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন এবং ঘোষণা করেন যে, তিনি নিজ হাতে কর্তৃত্ব নিয়ে ডিক্রি দিয়ে সাময়িকভাবে দেশ শাসন করবেন। তার এই উদ্যোগ আরব বসন্ত, গণতন্ত্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হিসেবে সমালোচনা শুরু হওয়ার পর প্রতিবাদ ঠেকাতে ২৬ জুলাই তিনি ৩০ দিনের জন্য দেশব্যাপী কারফিউ জারি করেন।
তিউনিসিয়ার এই ঘটনা যে স্পষ্টভাবে সাংবিধানিক শাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান তাতে সংশয় নেই। সংবিধানের যে ৮০ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ক্ষমতা অনুসারে দেশের প্রয়োজনে ব্যতিক্রমী কিছু করার অবকাশ প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে বলে কায়েস সাইদ দাবি করছেন সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, এ সময়ে সংসদ অব্যাহত অধিবেশনে থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের সাথে পরামর্শ করে প্রেসিডেন্টকে এই পদক্ষেপ নিতে হবে। স্পিকার ড. রশিদ ঘানুশি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট তার সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করেননি। আর তাকে সংসদের অধিবেশনে মিলিত হওয়ার জন্য সংসদ ভবনে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে।
তিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্টের এখতিয়ার কতটুকু সেই সাংবিধানিক ইস্যুর মীমাংসার জন্য ২০১৪ সালের সংবিধানে সাংবিধানিক আদালত সৃষ্টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এটি তৈরির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান প্রেসিডেন্ট নিজে। সংসদ সাংবিধানিক আদালতের চারজন সদস্য মনোনয়ন করলেও প্রেসিডেন্ট সেটি কার্যকর করেননি। আর প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রেসিডেন্ট হাউজে সেদিন কী ঘটেছিল তা এখনো রহস্যাবৃত। মিডল ইস্ট আইয়ের খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হাশিম মেসিসিকে পদত্যাগ করতে বললে তাতে তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং তাকে মারধর করার পর তিনি পদত্যাগে রাজি হন। এরপর প্রধানমন্ত্রী তার ঘরে অন্তরীণ রয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে মুখ খুলছেন না। কেবল তাকে যা বলানো হচ্ছে তাই তিনি উচ্চারণ করছেন বলে মনে হয়।
প্রধানমন্ত্রী হাশিম মেসিসি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নন। তিনিও একসময় প্রেসিডেন্টের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ। তার সরকারও প্রেসিডেন্টেরই অনুমোদিত সরকার। সংসদের বৃহত্তম দল আন নাহদা প্রেসিডেন্টের সাথে এ নিয়ে বিরোধে না গিয়ে সরকারকে সমর্থন করেছে। কিন্তু সম্প্রতি কয়েকজন মন্ত্রীর নিয়োগের বিষয় সংসদ অনুমোদন করলেও প্রেসিডেন্ট তা করেননি। এ নিয়ে কিছুটা বিরোধ দেখা দেয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে। এর মধ্যে করোনার চতুর্থ ঢেউ এলে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আন নাহদার নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার ভেঙে দিয়ে গঠিত প্রেসিডেন্টের মনোনীত হাশিম মেসিসি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হলেও রহস্যজনকভাবে ভাঙচুর করা হয় আন নাহদার কার্যালয়।
অস্থিরতার পটভূমি
২০১১ সালে বু আজিজ নামে একজন শিক্ষিত বেকার যুবকের আত্মাহুতির পরে যে বিক্ষোভ ও গণজাগরণ শুরু হয় তার পথ ধরে স্বৈরশাসক বেন আলী তিউনিসিয়া ছেড়ে সৌদি আরব পালিয়ে যান। এর জের ধরে মিসর লিবিয়া ইয়েমেন মরক্কো জর্দান সিরিয়াসহ অনেক আরব দেশে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কোনো কোনো দেশে সরকারের পরিবর্তন ঘটে আবার কোনো কোনো দেশে নানা ছাড় ও পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যমান শাসক তার শাসনভার বজায় রাখতে সক্ষম হন। অচিরেই আরব বসন্তের শিকার রাজতান্ত্রিক ও সামরিক একনায়করা জোট বেঁধে পাল্টা পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেন। আরব বসন্তের জের ধরে যেসব দেশে পরিবর্তন আসে সেখানে সরকারকে স্থিতিশীল হতে দেয়নি এই শক্তি। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, কোনো দেশে ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান।
এত কিছুর মধ্যেও তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিগুলো সেখানে গণতান্ত্রিক ধারাকে বজায় রাখতে পেরেছিলেন। এমনকি সেখানে অব্যাহতভাবে পুরনো একনায়কতান্ত্রিক সরকারি ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার পরও কায়েস সাইদের সর্বশেষ পদক্ষেপের আগে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় বড় রকমের ব্যত্যয় দেখা দেয়নি। এর পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন তিউনিসিয়ার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আন নাহদা ও এর নেতা ড. রশিদ ঘানুশি। তিনি এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও বাম ডান নির্বিশেষে সব দল নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছেন। যখন দাবি উঠেছে তখন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন। সংবিধান প্রণয়নে আদর্শ চাপিয়ে দেয়ার জন্য কোনো চাপাচাপি করেননি। একতরফাভাবে গণতন্ত্রের স্বার্থে অন্য দলের সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন।
কিন্তু এতকিছু করার পর তিউনিসিয়ার নিজস্ব রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা কাটানো যায়নি। ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত তিউনিসিয়া ছিল ফ্রান্সের কলোনি। ব্রিটেন বা অন্য ঔপনিবেশিক শক্তি কোনো রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা দেয়ার পর সেখানে প্রভাব সংরক্ষণ করার কিছু চেষ্টা হয়তো গ্রহণ করেছে কিন্তু ফ্রান্স যেসব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিয়েছে সেসব দেশের অর্থনীতি এবং ক্ষমতার পরিবর্তনের টুলসগুলোকে সব সময় নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এ জন্য অধিকাংশ সাবেক ফরাসি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে ফ্রান্সের সেনা উপস্থিতি এখনো রয়ে গেছে। সেসব দেশের ক্ষমতাসীনরা ফরাসি অর্থনৈতিক বা অন্যবিধ স্বার্থে হুমকি হওয়ার সাহস দেখায় না। যারা দেখিয়েছে তাদের হয়তো ক্ষমতা হারাতে হয়েছে অথবা গুপ্তহত্যার শিকারে জীবন থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। আর ফ্রান্স তার সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে ইসলামিক এবং বাম ভাবাদর্শের শক্তিকে সব সময় দমিয়ে রাখার কৌশল নিয়েছে আর এ জন্য সব সময় স্বৈরশাসকদের ইন্ধন দিয়ে গেছে। এমন একটি ব্যবস্থা তারা সব সময় তৈরি করে রাখে যাতে স্থানীয় ক্ষমতাধরদের স্বার্থ আর ফ্রান্সের স্বার্থ একই সমান্তরালে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র্র ফ্রান্সের প্রভাববলয়ের সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে এককভাবে কোনো হস্তক্ষেপ করত না। এ ধরনের এক অবস্থার মধ্যে আরব বসন্তের আন্দোলনে স্থানীয় শক্তির সাথে আমেরিকান গভীর ক্ষমতা বলয়ের একটি অংশ আর ওবামা প্রশাসনের সমর্থনের কারণে বেশ ক’টি আরব দেশে তা সফল হয়। কিন্তু আরব বসন্ত-পরবর্তী সময়ে অনেক রাষ্ট্রের আঞ্চলিক স্বার্থে আঘাত লাগে। এর মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ফ্রান্সের মতো প্রভাব বিস্তারকারী ঔপনিবেশিক শক্তি, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো রাজতান্ত্রিক ও একনায়ক শাসিত দেশের ক্ষমতাসীন চক্র আর ইসরাইল। আরব বসন্তের দেশগুলোর কয়েকটির নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা ভালো করলে এই কায়েমি শক্তির ঐক্য আরো জোরদার হয়। আমেরিকার গভীর ক্ষমতাবলয়ে গণতন্ত্রপন্থী প্রভাব দুর্বল হয়ে আসে। মিসরে নির্বাচিত মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ সিসির সেনা অভ্যুত্থানের পর আরব বসন্তের পাল্টা শক্তির প্রবল তৎপরতা শুরু হয়।
নেপথ্যে কারা
তিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্টের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণের ঘটনার পর স্পিকার রশিদ ঘানুশি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফ্রান্সের ভূমিকাকে দায়ী করেছিলেন। এর আগে এপ্রিলে কায়েস সাইদ মিসর সফরে গেলে সেখানে তাকে জেনারেল সিসি উষ্ণ সংবর্ধনা দেন। আর প্রেসিডেন্টের ২৫ জুলাই ক্ষমতা গ্রহণের দিন সেখানে মিসরীয় ও আমিরাতি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ঘটে। এতে আমিরাতের পাশাপাশি তিউনিসিয়ার ঘটনায় মিসরের সক্রিয়তার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়। এবার তিউনিসিয়ায় যেটি ঘটেছে সেই একই রকম ঘটনা এর আগে একাধিক প্রেসিডেন্টের সময় ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আগের কোনো প্রেসিডেন্ট আমিরাতি প্রস্তাব গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে দমনপীড়নের পুরনো শাসন ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়নি।
কায়েস সাইদ নির্বাচিত হওয়ার পরই আমিরাতি প্রস্তাবে কর্তৃত্ব গ্রহণের লোভে পড়েছিলেন বলে মনে হয়। আর এর অংশ হিসেবে সংসদ নির্বাচনে নিজের অনুগামীদের দল গঠন করে জয়ী করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সে নির্বাচনে আন নাহদার আসন কমলেও দলটি একক বৃহত্তম সংসদীয় দলে পরিণত হয়। গঠিত হয় আন নাহদার নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার। প্রেসিডেন্ট এই কোয়ালিশন সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজ পছন্দে বর্তমান হিশাম মেসিসির সরকারকে নিয়ে এসেছিলেন। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার স্বার্থে সেটিকে সমর্থন করেন আন নাহদা। কিন্তু এরপর রশিদ ঘানুশির স্পিকারের পদের বিরুদ্ধে একই চক্র অনাস্থা প্রস্তাব তোলে। আমিরাতি লবি বিপুল অর্থ খরচ করার পরও সেটি পাস করাতে পারেনি। এরপর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। বলা হয়, এক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে সাড়া না দিলে সরকারের পতন ঘটানো হবে। স্পিকার ও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সম্মত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ইসরাইল আমিরাত মিসর ফ্রান্স বলয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যাচ্ছে।
কে এই কায়েস সাইদ
কায়েস সাইদের কোনো রাজনৈতিক পটভূমি ছিল না। তিনি ছিলেন আইনের অধ্যাপক এবং টেলিভিশনের টকশোর জনপ্রিয় বক্তা। ২০১৯ সালে তিনি যখন তিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন তখন তিনি আমিরাতি বলয়ের এক নম্বর পছন্দও ছিলেন না। তখন তাদের প্রধান পছন্দ ছিল ফ্রান্সকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও মিডিয়া মোগল হার্ট অব তিউনিসিয়া দলের নাবিল কারোই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাড়ে ১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন কারোই। এ নির্বাচনে ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে আন নাহদা প্রার্থী তৃতীয় স্থানে থাকেন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে আমিরাত ফ্রান্স লবির সমর্থক হিসেবে নাবিল কারোই এর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী কায়েস সাইদকে আন নাহদাসহ অধিকাংশ দল সমর্থন করেন। ফলে তার ভোট প্রথম দফার সাড়ে ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়। আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আমিরাত-ফ্রান্স লবি কায়েস সাইদের ওপর ভর করে। কায়েসের মধ্যে এমনিতেই ক্ষমতাধর হওয়ার উচ্চাভিলাষ ছিল বলে মনে হয়। তিনি এর আগে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নানা ধরনের সমালোচনাও করেন। ফলে সহজেই তিনি পা দিতে পেরেছেন আমিরাত ফ্রান্স মিসরের পরিকল্পনার ফাঁদে। পরিকল্পনা সফল করতে পারলে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রতিও তিনি দিয়েছেন বলে আমিরাতি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে।
আঞ্চলিক সমীকরণ
আর এটি অজানা নয় যে, শুধু তিউনিসিয়া নয় এই অঞ্চলের সব দেশের ওপরই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার চাপ আমিরাতের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সাথে ইসরাইলের এ ব্যাপারে রয়েছে গভীর সখ্য। আফ্রিকার এই অঞ্চলের অন্য একটি প্রভাবশালী দেশ সুদানের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ওমর বশিরকে একই প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়েছিল, প্রস্তাবে সাড়া দিলে তিনি যতদিন খুশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। ওমর বশির এটি গ্রহণ করেননি। পরে এক রহস্যজনক বিক্ষোভে তিনি ক্ষমতা হারান।
মাগরেবের আরেক দেশ মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ হাসান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছেন। লিবিয়ার জিএনএ সরকারের প্রতিও একই ধরনের চাপ রয়েছে। আলজেরিয়াকেও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক তৈরির জন্য প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। এর পেছনে ইসরাইল এবং এর লেজ ধরে আমিরাতি প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি এই অঞ্চল থেকে তুরস্কের প্রভাব কমানোর একটি বড় লক্ষ্য সব পক্ষের রয়েছে। তুরস্ক ছিল একদিকে আরব বসন্তে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনকে সমর্থনকারী অন্যতম প্রধান দেশ। আর প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, সমুদ্রসম্পদ আহরণ এবং উন্নয়নে সহায়তা করার মতো যে সক্ষমতা দেশটির রয়েছে তা নানা ক্ষেত্রে দেশটিকে ফ্রান্স এবং ইসরাইলের প্রতিদ্ব›দ্বীতে পরিণত করেছে।
বিশেষত লিবিয়ার সাথে তুরস্কের সমুদ্রসীমানা নিয়ে যে চুক্তি হয় সেটি তুরস্ককে কনটেইন করার বড় একটি পরিকল্পনাকে ব্যর্থতার কাছাকাছি নিয়ে যায়। আর আফ্রিকায় ফ্রান্স যেসব দেশে ঔপনিবেশিক প্রভাব বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সেসব দেশ এক সময় উসমানীয় খেলাফতের অংশ থাকায় তুরস্কের সাথে তাদের ছিল ঐতিহাসিক সম্পর্ক। আফ্রিকায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তারে উত্থান, ফ্রান্সের কর্তৃত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা, ইসরাইলের স্বীকৃতি পাওয়ার বেপরোয়া উদ্যোগ আর আমিরাতের ইসরাইলের হাত ধরে মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তি হওয়ার আকাক্সক্ষা তিউনিসিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে।
কী হতে পারে তিউনিসিয়ায়?
এখন প্রশ্ন হলো, কী হতে পারে তিউনিসিয়ায়? তিউনিসিয়ায় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্ব গ্রহণের বিরোধিতা করেছে। তবে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন-ইউজিটিটির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জোরালো বিরোধিতা না থাকাটা এই ইঙ্গিত দেয় যে কায়েস সাইদ শিগগিরই পিছিয়ে পড়বে না। তবে তিনি সামনে এগিয়ে গেলে, সঙ্কট আরো বাড়তে পারে, উভয়পক্ষই তাদের সমর্থকদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছে।
বর্তমান পর্যায়ে, ক্ষমতার ভারসাম্য সাইদের পক্ষে দেখাচ্ছে। যদিও আর ২০১৯ সালে ৮৭ শতাংশ অনুমোদনের রেটিং তার নেই। এই সমর্থন এখন ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বেরিয়ে এসেছে এবং সম্ভবত উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তারা রাস্তায়ও সমবেত হবে। সম্ভাব্য সহিংসতা রোধ করার জন্য সাইদ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার পথ নিরসনে আলোচনার প্রয়োজন। এই বিষয়টি দেখার জন্য ইউজিটিটি এবং অন্যান্য সুশীলসমাজের অভিনেতাদের অবস্থান হবে গুরুত্বপূর্ণ। তারা এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মধ্যস্থতায় সাহায্য করার পদক্ষেপ কতটা নেবে সেটিই হলো প্রশ্ন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দেখার বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া। তুরস্ক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিতের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেছে। জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘অপেক্ষা করুন এবং দেখুন’ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিউনিসীয় পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সংযম ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। যদি বিশ্বের গণতন্ত্রগুলো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জোরালোভাবে না আসে, তাহলে এটি সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো প্রতিবিপ্লবী শক্তির জন্য সাইদের সমর্থনে সঙ্কটকে প্রভাবিত করার সুযোগ এনে দেবে, যেমনটা তারা মিসরের আবদেল-ফাত্তাহ আল-সিসির জন্য করেছিল।
তিউনিসিয়ান জেনারেল লেবার ইউনিয়ন, দেশের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন আর চারটি নোবেল বিজয়ীর মধ্যে একটি। তারা বর্তমান অবস্থায় এক ধরনের অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে সাংবিধানিক বৈধতার গুরুত্ব এবং জাতীয় সংলাপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি অস্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছে। তবে প্রতিবাদকারী, সামরিক বাহিনী এবং ট্রেড ইউনিয়ন- এই তিনটি শক্তি সামনের দিনগুলোতে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে।
পার্লামেন্টে আধিপত্য বিস্তারকারী রাজনৈতিক শক্তি একটি অভ্যুত্থান হিসেবে সাইদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে। প্রধান ইসলামপন্থী দল আন নাহদা এবং ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব বিক্ষোভ প্রদর্শন করার বিষয়টি কেবল সময়ের ব্যাপার। এটি করা হলে সহিংসতার প্রবল সম্ভাবনার মুখোমুখি হতে হবে। সাইদ যদি সিসি প্লেবুকের সাথে লেগে থাকেন তাহলে তিনি তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনের আদেশ দেবেন। সেনাবাহিনী জনগণকে নাকি রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করবে তা নিয়ে তখন একটি দ্বিধায় পড়ে যাবে।
তবে খুব সম্ভবত, শ্রমিক ইউনিয়নগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে। আরব বসন্তের পর শক্তিশালী, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নাগরিক-সমাজ প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি তিউনিসিয়া এবং মিসরের মধ্যে মূল পার্থক্যকারী ছিল। তারা আবারও সিদ্ধান্তকারী হতে পারে। দেশের অধিকাংশ সিভিল সার্ভিসের প্রতিনিধিত্বকারী ইউজিটিটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে, তারা পুরো তিউনিসিয়াকে স্থবির করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। সেজন্যই আন নাহদার নেতা রশিদ ঘানুশি, কায়েস সাইদের ঘোষণার প্রতি তার প্রথম প্রতিক্রিয়ায়, ইউজিটিটি’র মহাসচিব নওরেদ্দিন তাবুবির কাছে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ আবেদন করেছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে কী হতে পারে তা নিয়ে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খাদিজা মোহসেন-ফিনান বলেন, ‘কায়েস সাইদের ব্র্যান্ডের কর্তৃত্ববাদ বিপ্লবের চেতনার বিপরীতে চলতে পারে, কিন্তু এটি পুরনো শাসনের প্রত্যাবর্তন নয়-এটি তার নিজস্ব পপুলিস্ট পদ্ধতি।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হামাদি রেডিসি এর সাথে কিছুটা একমত হয়ে বলেছেন, ‘এটি একটি ছোট, অস্থায়ী স্বৈরতন্ত্র এবং আমরা কেবল আশা করতে পারি যে এটি একটি বড় স্থায়ী স্বৈরশাসনে পরিণত হবে না। আমরা হয়তো গণতন্ত্রের একটি ধারণার শেষ নিশ্বাস দেখছি যা আরব বিশ্বজুড়ে মারা যাচ্ছে।’
এখন কেন?
তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতি কেন এই সময়ে এই পদক্ষেপ নিলেন এবং কে তাকে তা করতে অনুপ্রাণিত করল? সম্ভবত এই পদক্ষেপের আসল টার্গেট প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভা নয়, বরং আন নাহদা। পার্লামেন্টের স্পিকার এবং আন নাহদা আন্দোলনের নেতা রাশেদ ঘানুশি বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে একে ‘বিপ্লব ও সংবিধানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান’ বলে বর্ণনা করেছেন। তারপর, তিনি যোগ করেন যে ‘তিউনিসিয়ার জনগণ বিপ্লবকে রক্ষা করবে।’
রশিদ ঘানুশির ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে যে সমস্যাটি কিছু রাজনৈতিক দলের আদর্শ নয়, বরং গণতন্ত্রের কার্যকারিতা। পশ্চিমা শক্তি এবং তাদের আঞ্চলিক প্রক্সি অর্থাৎ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিসির মিসর এবং লিবিয়ায় যুদ্ধবাজ জেনারেল খলিফা হাফতার প্রতিনিধিত্বকারী কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক লাইন যেকোনো গণতান্ত্রিক অভিনেতাকে ক্ষমতায় আসতে বা থাকতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে।
আরব বিশ্বে শাসনব্যবস্থা যতই কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হবে, রাষ্ট্র ততই পশ্চিমা দেশগুলোর বা অন্য কিছু বহিরাগত অভিনেতাদের ওপর নির্ভরশীল হবে। অন্য কথায়, গণতান্ত্রিক শাসনকে কাজে লাগানো অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিন। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক শাসন চায় কি না তা নিয়েই সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে। ১৯৯০ এর দশকে আলজেরিয়ার ঘটনা এবং ২০১০ এর দশকে মিসরের পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই দেখিয়েছে যে পশ্চিমা দেশগুলো সাধারণভাবে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের মতো স্বৈরাচারী এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সমর্থন করে।
ভবিষ্যতের দৃশ্যপট
তিউনিসিয়ার ভবিষ্যতের জন্য তিনটি পরিস্থিতি রয়েছে বলে মনে হয়। প্রথমত, যদি কায়েস সাইদ সফলভাবে তার হাতে সব ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন, তাহলে তিউনিসিয়া একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিপ্লব-পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসবে। কায়েস সাইদ সফলভাবে পুরনো শাসনব্যবস্থায় ফিরে আসে কিনা তা অন্যান্য রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক অভিনেতাদের সমর্থন এবং সামাজিক সমর্থনের ওপর বিশেষভাবে নির্ভর করছে। তিউনিসিয়ার অভিজাতদের রাজনৈতিক সচেতনতা বিবেচনা করে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশীয় অভিনেতাদের প্রতিক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মনে হয় ধর্মনিরপেক্ষ অভিজাতরা নতুন শাসনের ব্যাপারে বিভক্ত হবে। কেউ রাজনৈতিক সংস্কার ও মানবাধিকার চাইবে, আবার কেউ স্বাধীনতার চেয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা পছন্দ করবে।
দ্বিতীয়ত, যদি কায়েস সাইদ এক ব্যক্তি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে দেশটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সম্ভবত গৃহযুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করবে, যা হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। এই বিকল্পের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে ব্যাপক রক্তপাত, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অর্থনৈতিক দারিদ্র্য এবং বহির্মুখী অভিবাসন। এতে দুর্বল সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার জন্য তিউনিসিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রভাব বেশ বড় হবে। এর প্রভাব থেকে নিকটবর্তী ইউরোপও মুক্ত হবে না।
তৃতীয়ত, যদি সাইদ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন এবং সংসদে সাংবিধানিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন আর নতুন সরকার গঠনে নেতৃত্ব দেন, তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক ভারসাম্য এবং কার্যকরী গণতন্ত্র টিকে থাকবে। তিউনিসিয়ার গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য এটিই একমাত্র বিকল্প। তবে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে অদূর ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট কায়েস ক্ষমতা বণ্টন করবেন বা সেটি করতে তাকে দেয়া হবে কিনা। এর মধ্যে বেন আলির পরিবারকে আবার তিউনিসিয়ার ফিরিয়ে আনার কথা শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তিউনিসিয়া গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং এটি কিছু সময়ের জন্য অন্যান্য আঞ্চলিক রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকবে। এমনকি লিবিয়া বা ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের মতো ধ্বংসকারী এক অবস্থায় পড়ে যাওয়াটাও অসম্ভব নয় এই দেশটির জন্য।