কোভিডের নতুন এপিসেন্টার ইন্দোনেশিয়া, বাড়িতে বাড়িতে লাশ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ এশিয়া মহাদেশের নতুন কোভিড উপকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ইন্দোনেশিয়া। গত বুধবার দেশটিতে একদিনে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষের কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে। এটি দেশটির ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্তের ঘটনা। সবমিলিয়ে ভয়াবহ এক সময় পার করছে মুসলিম জনসংখ্যার বৃহত্তম এ দেশটি। এশিয়ার যে দেশগুলোতে কোভিড সব থেকে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে তারমধ্যে ভারত সব থেকে এগিয়ে রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় এখন দৈনিক শনাক্তের হার ভারতের থেকেও বেশি। অথচ ২৭ কোটি মানুষের দেশটির জনসংখ্যা ভারতের ৫ ভাগের একভাগ। এ অবস্থায় মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের খবরে ইন্দোনেশিয়াকে এশিয়ার নতুন এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয় তাহলে তা ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দেবে। তাদের আশঙ্কা, সরকারি তথ্যে শনাক্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে আসল সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি হতে পারে। দেশটিতে যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে না। গত শনিবার সিএনএনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্দোনেশিয়ার এই ভয়ঙ্কর অবস্থার জন্য দায়ী পর্যাপ্ত বিধিনিষেধ জারি না করা। লকডাউন বাস্তবায়ন করতে না পারারই দাম পরিশোধ করছে দেশটি। একইসঙ্গে কন্টাক্ট ট্রেসিং সিস্টেমের পেছনে বিনিয়োগ না করাও এই অবস্থার জন্য দায়ী। কর্তৃপক্ষ ধারণাই করতে পারেনি যে, কত দ্রুত ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বুদি গুনাদি সাদিকিন। এখন দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, হাসপাতালগুলো আর বাড়তে থাকা রোগী সামাল দিতে পারছে না। দেশটিতে ছড়িয়ে পড়ছে কোভিডের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। বাড়ছে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার। বুধবারই দেশটিতে কোভিডে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১ হাজার জন। সব মিলিয়ে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে।
দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আনতারা নিউজ জানিয়েছে, ২৭ কোটি মানুষের দেশটিতে হাসপাতালগুলোতে শয্যা রয়েছে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার যার ৯০ হাজারই ভরে গেছে। দেশটিতে বেড়ে গেছে অক্সিজেনের দাম। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সংকট দেখা যাচ্ছে। অক্সিজেন সরবরাহ শেষ হওয়ায় এ মাসের প্রথমে এক হাসপাতালে ৬৩ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের পরিস্থিতি এতোটা খারাপ হবে, সেটি সরকার অনুমান করতে পারেনি। সেজন্য অক্সিজেনের সংকট দেখা যাচ্ছে। নিজেদের পরিবারের সদস্য এবং স্বজনদের জন্য অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে অক্সিজেন ট্যাংক এবং হাসপাতালে শয্যার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। অক্সিজেন সংকটের কারণে ইন্দোনেশিয়ার অধিকাংশ অক্সিজেন স্টোর বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়েটি অক্সিজেন স্টোর খোলা রয়েছে, সেখানে মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে। অক্সিজেন সংকটের এই সময়ে প্রতারকদের উৎপাতও বেড়েছে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, অর্থ প্রদানের পরও তারা অক্সিজেন পাননি। এই অবস্থা চললেও এতদিন পরে এসে গত সপ্তাহে জাভা ও বালি দ্বীপে লকডাউন জারি করে দেশটির সরকার।
এদিকে ইন্দোনেশিয়ার ভ্যাকসিন কার্যক্রমেও নেই কোনো গতি। সিএনএনের ভ্যাকসিন ট্রাকারের তথ্যানুযায়ী, এতদিনে মাত্র ৫.৫ শতাংশ নাগরিককে ভ্যাকসিন প্রদান করতে পেরেছে দেশটির সরকার। তারমধ্যে রাজধানী জাকার্তা বাদে পুরো দেশে ভ্যাকসিন প্রদানের অবস্থা আরও ভয়াবহ। গত বুধবার দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো বলেন, ইন্দোনেশিয়ার এই দুর্যোগ থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে ভ্যাকসিন।
এদিকে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে সেখানে এখন বাড়িতে বাড়িতে মরদেহ পড়ে আছে। দমকল বাহিনীর কর্মীদের গিয়ে লাশ সংগ্রহ করে সৎকার করতে হচ্ছে। কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না শেষকৃত্যের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশীরা উদ্ধার কর্মীদের খবর দিয়ে দায় সারছেন। গত দেড় বছরের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া এতো ভয়াবহ সংকটে পরেনি। দেশটিতে এখনো পর্যন্ত ২৬ লাখ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এ সপ্তাহে অবস্থা সব থেকে বেশি খারাপ হয়েছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত বেড়ে চলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণেই এই ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়েছে দেশটি। ইন্দোনেশিয়ার আসল সংকট শুরু হয় এ বছরের ঈদুল ফিতরের পরেই। ঈদের ছুটিতে দেশটিতে ১৫ লাখ মানুষ বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে যাতায়াত করে। এরপরই মে মাসের প্রথম থেকে বাড়তে থাকে কোভিডের সংক্রমণ। সেটিই এখন বাড়তে বাড়তে এমন দুর্যোগে পরিণত হয়েছে।
সময় মতো কঠিন লকডাউন জারি করতে না পারায় কঠিন সমালোচনার মুখে পড়েছে ইন্দোনেশিয়ার সরকার। তবে অনেকেই এগিয়ে আসছেন আক্রান্তদের সাহায্যে। বিবিসি জানিয়েছে, দেশটির ২৪ বছর বয়সী এক চিকিৎসক ভিডিও কলের মাধ্যমে বিনা খরচে চিকিৎসাসেবা দেয়া শুরু করেছেন। রিও পুংকি ইরাওয়ান নামের ওই চিকিৎসক জানান, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সেলফ-আইসোলেশনে থাকা অনেকেই চিকিৎসা পাচ্ছেন না। সেজন্য তিনি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেয়া শুরু করেন। জুলাই মাসের সাত তারিখে এই সেবা চালু করার পর এখনো পর্যন্ত তিনি ৮০০ কল পেয়েছেন বলে জানান সেই চিকিৎসক।