বিশ্বাসের মর্যাদা কি এইভাবে দিতে হয়?

0

দুর্যোগ-সহনীয় গৃহনির্মাণ প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের আওতায় সরকার সমগ্র দেশে হতদরিদ্রদের গৃহনির্মাণ করার মহান উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছে এবং তাহা বাস্তবায়নও করা হইয়াছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক ভূমিহীন পরিবারকে ঘর নির্মাণ করিয়া দিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী। নিঃসন্দেহে ইহা একটি মহত্ উদ্যোগ।
আশা করা হইয়াছিল, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন করা হইবে এবং ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাহাদের জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করিয়া তুলিয়া আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ করা হইবে। কিন্তু সমগ্র দেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই সকল ঘর নির্মাণ ব্যয়, নির্মাণসামগ্রী, সাইট নির্বাচন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইহার বণ্টন লইয়া নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশিত হইতেছে। বিভিন্ন পত্রিকা এবং মিডিয়ার রিপোর্টে উঠিয়া আসিয়াছে, সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত দেশের ২২ জেলার অন্তত ৩৬টি উপজেলায় ঘর নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গিয়াছে।
কোথাও ঘর নির্মাণের পর তাহা ভাঙিয়া যাইতেছে, কোথাও আবার দেখা দিয়াছে ফাটল। যদিও যেই পরিমাণ ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হইয়াছে তাহার তুলনায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির পরিমাণ হয়তো যত্সামান্য, তথাপি এই সকল অভিযোগের ফলে সরকারপ্রধানের স্বপ্নের প্রকল্প, রাজনীতিমুক্ত একটি উদ্যোগ যাহার মূল ভাবনাই ছিল গৃহহীন থাকিবে না কেহই, তাহা নানা মহলে সমালোচনার সম্মুখীন হইতেছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্প মূলত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ একটি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, যাহার মাধ্যমে গৃহহীন এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হইল প্রকল্পটি রাখা হইয়াছিল রাজনীতিমুক্ত অর্থাত্ প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদরা নহে, সরকারের আমলারাই নিয়োজিত ছিলেন। যেইহেতু এই মহত্ উদ্যোগটি সরকারপ্রধানের স্বপ্নের প্রকল্প ছিল সেই কারণে ইহা লইয়া তাহার আশা-আকাঙ্ক্ষাও অনেক অধিক ছিল। সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদরা জড়িত থাকিলেও আশ্রয়ণ প্রকল্পটিতে ভরসা করা হইয়াছিল আমলাদেরকে। কিন্তু তাহারা সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাইতে পারিয়াছেন কি? এই প্রকল্প লইয়া যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠে, নানারূপ সমালোচনা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় তখন হতাশ না হইয়া পারা যায় না।
সরকারপ্রধান দল, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বদলে সরকারি কর্মকর্তা আর আমলাদের বিশ্বাস করিয়া শুভ উদ্যোগটির দায়িত্ব প্রদান করিয়াছিলেন, অথচ নানা রকম অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ তাহাদের বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপারটিকেই তুলিয়া ধরে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে রাজনীতিবিদদের কাজ লইয়াও বিভিন্ন অভিযোগ করিয়া থাকেন অনেকেই, কিন্তু এই কথাও তো ঠিক—অনেক সত্, ত্যাগী এবং নিবেদিত রাজনীতিবিদও রহিয়াছেন। প্রশ্ন হইল, রাজনীতিমুক্ত রাখিয়া যখন আমলা এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভরসা করা হইল, তাহারা কি সেই আশা-ভরসার পরিবর্তে হতাশ করেন নাই? আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ উঠিবার পর নড়িয়া-চড়িয়া বসা হইতেছে, বিভিন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হইতেছে, কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, ঘুড়ি যখন নাটাইয়ের সুতা ছাড়িয়া উড়িয়া চলিয়া যায়, তাহার পিছনে দৌড়াইয়া কোনো লাভ হয় না। কী হইবে এখন বিভিন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করিয়া, তাহা বোধগম্য নহে। মহত্ একটি উদ্যোগ যখন সরকারেরই আমলাদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সমালোচিত হয়, তখন আমরা বুঝিতে পারি—রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তিটি কতটা অসহায় এবং কাহাদের আশপাশে লইয়া তিনি দেশ ও দেশের মানুষ লইয়া স্বপ্ন দেখিতেছেন।
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, প্রকল্প তথা কর্মকাণ্ড লইয়া বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষ, বুদ্ধিজীবী মহল, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরাম সমালোচনা করিয়া থাকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করিতে হয়, সরকার লইয়া নানারূপ সমালোচনার কারণে বঙ্গবন্ধু একদা সিরাজুল আলম খানকে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন, বাহিরে থাকিয়া কথা না বলিয়া সরকারের ভিতরে আসিয়া দ্যাখ! আমরা বুঝিতে পারি, বাহিরে থাকিয়া সমালোচনা করা সহজ কাজ হইলেও আস্থা, বিশ্বাস এবং বিশ্বস্ততার জায়গাটিতে দেশের প্রধান নির্বাহী কতটা অসহায়, হতাশা এবং দুঃখ বোধ করিয়া থাকেন। আমরাও তাহার দুঃখে দুঃখী, তাহার হতাশায় হতাশাগ্রস্ত।