পরিবর্তন ছাড়া গতি নেই

0

১. সব ধর্মে, সব সংস্কৃতিতে, সব সমাজে পরিবর্তন আসে। মানুষের মানসিকতায় আসে পরিবর্তন, জীবনবোধে আসে। আসতেই হয় পরিবর্তন। পরিবর্তন না এলে ধর্ম সংস্কৃতি সমাজ হয়ে ওঠে বদ্ধ জলাশয়ের মতো। পুরনো পচা মানসিকতাতে মরচে ধরে। মানসিকতারও বদল চাই। একে আধুনিক করতে হয়, চিন্তাকে ছোট্ট গন্ডি থেকে মুক্ত করে গোটা এক আকাশ দিতে হয়। পৃথিবীর প্রতিটি সমাজেই আমরা বিস্তর পরিবর্তন দেখছি। দু’হাজার বছর আগের পৃথিবী আর এখনকার পৃথিবীর মধ্যে অবিশ্বাস্য সব পরিবর্তন ঘটেছে। তবে এ অস্বীকার করার উপায় নেই কিছু লোক সব সমাজেই বাস করে, যারা পরিবর্তন বিরোধী। এদের সংখ্যাটা যে সমাজে কম, সে সমাজ সভ্যতার দিকে দ্রুত এগোয়। এদের সংখ্যা যে সমাজে বেশি, সভ্যতার দিকে এগোতে সে সমাজ বারবার বাধাগ্রস্ত হয়।
এক সময় ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করলে ইউরোপের ক্রিশ্চান ধর্ম যাজকরা মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতো। আজ যাজকেরা মানুষের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে মানুষের অনুকম্পায় টিকে আছে। তাদের সেই রাজত্ব আর প্রভুত্ব আর নেই। ইউরোপের ক্রিশ্চান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ঈশ্বরের অস্তিত্বে এখন বিশ্বাস করে না। হিন্দুরা এককালে জীবন্ত মেয়েদের ছুড়ে ফেলতো স্বামীর চিতার আগুনে, স্বামীহীন নারীর বেঁচে থাকাকে অভিশাপ বলে মনে করতো। হাজারো কুসংস্কারের মতো সতীদাহ’র কুসংস্কারও দূর করেছে তারা।
একসময়ের এগিয়ে থাকা মুসলিম সমাজ অন্যান্য সমাজের তুলনায় অনেককাল থেমে আছে। অধিকাংশ মুসলিম মূল সমাজকেও যেখানে ছিল সেখানে রেখে দিয়েছে, অভিবাসী মুসলিমরাও তাদের মানসিকতাকে সেখানেই থামিয়ে রেখেছে, যেখানে ছিল। প্রগতির চাকাকে থামিয়ে রাখলে অন্যের যত ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বেশি হয় নিজের ক্ষতি।
আমরা জানি পৃথিবী ধীরে ধীরে সভ্য হচ্ছে বটে, তবে আজও কিছু কট্টরপন্থি কিছু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী অজ্ঞানতা আর অন্ধকার ছিটিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত করাই তাদের উদ্দেশ্য। তারা ছিটেফোঁটা আলোও সহ্য করতে পারে না। এমনই তো এক গোষ্ঠী ভারতের রাষ্ট্রীয় সেবক সঙ্ঘ। উপমহাদেশের সকলে জানে রাষ্ট্রীয় সেবক সঙ্ঘ ভয়ঙ্কর মুসলিমবিরোধী, তারা ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় সব মুসলিমকে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘের এতকাল এমনই ছিল বিশ্বাস। এই সঙ্ঘও পরিবর্তন চায়। অত্যাশ্চর্য বিষয় বটে।
রাষ্ট্রীয় সেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত সেদিন যা বলেছেন শুনে নিজের কানকে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। সকলেই জানে সঙ্ঘ মুসলিম বিরোধী, সঙ্ঘ মুসলিমদের ভারতছাড়া করতে চায়। অথচ ভাগবত বললেন, ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, কারণ মনে করা হচ্ছে হিন্দু আর মুসলিম আলাদা জাত। আসলে তারা কিন্তু এক জাত। তাদের ডিএনএ এক। যার যা ধর্মই থাকুক না কেন, তারা সবাই ভারতীয়। ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এই ভারতবর্ষে কোনও হিন্দুর শাসন চলবে না, কোনও মুসলিমের শাসনও চলবে না, চলবে ভারতীয়দের শাসন। গো-রক্ষার নামে যারা মুসলিম নির্যাতন করে, তারা হিন্দু নয়। যারা বলে মুসলিমরা এদেশের নয়, তারাও হিন্দু নয়।’
আমি ভাবছি বাংলাদেশের চরম ডানপন্থি মুসলিম-কট্টরপন্থি জামায়াতে ইসলামী বা হেফাজতে ইসলাম কি এমন ঘোষণা দিতে পারে, ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, কারণ মনে করা হচ্ছে হিন্দু আর মুসলিম আলাদা জাত। আসলে তারা কিন্তু এক জাত। তাদের ডিএনএ এক। যার যা ধর্মই থাকুক না কেন, তারা সবাই বাংলাদেশি। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এই দেশে কোনও মুসলমানের শাসন চলবে না, কোনও হিন্দুর শাসনও চলবে না, চলবে বাংলাদেশির শাসন। বিধর্মী বলে যারা হিন্দুদের নির্যাতন করে, তারা মুসলমান নয়। যারা বলে হিন্দুরা এদেশের নয়, তারাও মুসলমান নয়।’
যদি না দিতে পারে, এ অর্থ একটিই তারা পরিবর্তন চায় না। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধার্মিক। অতি-ধার্মিকের সংখ্যা আজকাল বাড়ছে, অতি-ধার্মিক বাড়লে সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়। শুধু সংখ্যালঘু নয়, মুক্তচিন্তক, সে যে ধর্ম থেকেই আসুক না কেন, তাদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়। বাংলাদেশে এখন ধার্মিকের চেয়ে অতি-ধার্মিক বা কট্টরপন্থি মুসলিমের সংখ্যা বেশি। অতি-ধার্মিকরাই সংখ্যালঘু এবং মুক্তচিন্তকদের নির্যাতন বেশি করে। এই অতি-ধার্মিকদের মানসিকতা বদলাতে হবে। তাদের ধর্মীয় সংগঠনগুলোর নীতি আদর্শেরও আমূল পরিবর্তন দরকার।
আজ হিন্দুত্ববাদীদের প্রধান তার ঘৃণার আগুনে ঘি-এর বদলে ঢেলে দিয়েছেন জল। পরিবর্তন তিনিও চান। সভ্য হতে গেলে হিংসে, দ্বেষ, ঘৃণা আর অনুদার মানসিকতাকে ত্যাগ করতে হয়, তিনিও সদ্য শিখেছেন। এই শিক্ষা সবার জন্য জরুরি। এই শিক্ষা মুসলিম উম্মাবাদীদের জন্যও জরুরি। এই পৃথিবী সেদিনই পুরোপুরি সভ্য হবে, যেদিন মানুষের পরিচয় হবে মানুষের মনুষ্যত্ব দিয়ে, ধর্মবিশ্বাস দিয়ে নয়।
২. আমরা যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বলছি কয়েক দশক। এতে সরকারের কোনও হেলদোল নেই। মুসলিম পারিবারিক আইনে নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য প্রচুর, হিন্দুদের পারিবারিক আইন হিন্দু শাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে গড়া হয়েছে, এই আইনের কারণে হিন্দু মেয়েদের অধিকার বলতে কিছু নেই। সমানাধিকারের ভিত্তিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই করা উচিত ছিল। অথচ রাষ্ট্রনায়কেরা তা করেননি। কিছু কাজ আছে যে কাজে দেরি করে ফেললে সেই কাজ আর করা হয় না। সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন পালটে যায় যে সেই কাজে হাত দিতেই সরকার আপত্তি করে। নারী পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে গড়ে তোলা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি যত সহজে সত্তর দশকে প্রণয়ন করা যেত, সেটি আজ তত সহজ নয় প্রণয়ন করা, প্রণয়ন করতে গেলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আপত্তি করবে। কিন্তু কূপমন্ডুকদের আপত্তিকে তোয়াক্কা করবে কেন সরকার! যে যাই বলুক, ব্যানার নিয়ে যে যতই রাস্তায় নামুক, মানুষের মঙ্গলের কাজটি করতে সরকারের তো উচিত নয় দ্বিধা করা!
কট্টরপন্থিদের দৃঢ় বিশ্বাস ধর্ম তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তাই তারা ধর্মীয় আইনে কোনও পরিবর্তন ঘটতে দিতে চায় না। ধর্মীয় আইনের কারণে যারা ভোগে, তারা পুরুষ নয়, তারা নারী। কতকাল ভুগছে নারী- সে মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান হোক, ভুগতে তাকে হবেই। বাংলাদেশের হিন্দু মেয়েরা আজ মুখ ফুটে বলছে তারা বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার চায়। অনেকে জানে না যে এই অধিকার তাদের নেই। বাংলাদেশের মুসলিম আইনে কিছু পরিবর্তন-সংশোধন আনা হলেও হিন্দু আইন যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। রয়ে তো আর ইচ্ছে করে যায়নি। একে এভাবেই রয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ভারতের মুসলিম মৌলবাদীরা যেমন মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে কোনও পরিবর্তন চায় না, বাংলাদেশের হিন্দু মৌলবাদীরাও তেমন হিন্দু পারিবারিক আইনে কোনও পরিবর্তন চায় না। মৌলবাদীদের মধ্যে, সে যে ধর্মের মৌলবাদীই হোক না কেন, মূলত কোনও পার্থক্য নেই। সব মৌলবাদীই নারীবিরোধী। তারা চায় না নারী তার স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতায় তার জন্মগত অধিকার, তা পাক।
মুসলিম নারীদের মধ্যে যারা প্রগতিশীল এবং বৈষম্যবিরোধী, মাঝে মধ্যে তারা তাদের পারিবারিক আইনটিকে ধর্মের ভিত্তিতে না করে বরং সমানাধিকারের ভিত্তিতে করার জন্য আবেদন জানায়। এতে লাভ কিছু হয় না। খড়্গ উঁচিয়ে আছে নারীবিরোধীদের দল। হিন্দু নারীরা তো তাদের পারিবারিক আইন সংস্কারের জন্য আবদার আবেদন জানাবার সাহসই পায় না। হিন্দু মৌলবাদীরা এই সাহস বরদাশত করবে না বলেই সাহস পায় না। কিন্তু সহ্যের সীমা একদিন না একদিন তো পেরোয়। বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের অনেকেরই সেই সীমা পেরিয়েছে। পেরোবে না কেন? তারা স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, কিন্তু অত্যাচারী স্বামীকে তালাক দিতে পারছে না। প্রচুর হিন্দু মেয়ে স্বামীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে আলাদা বাস করছে, কিন্তু সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে পারছে না। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ‘হিন্দু নারীদের মধ্যে স্বামী থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা বাড়ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার না থাকায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। বিধবা নারীদের সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও এখন উঠছে।’ তা উঠবেই বৈকি।
মেয়েরা শিক্ষিত হলে, স্বনির্ভর হলে, সচেতন হলে, তালাকের সংখ্যা বাড়ে। দিন যত পার হচ্ছে, তত মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে। তত মেয়েরা স্বনির্ভর হচ্ছে। তত মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ বাড়ছে, তত মেয়েরা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। এ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তবে যেটি অস্বাভাবিক, সেটি হলো, পুরুষ শিক্ষিত হচ্ছে, স্বনির্ভর হচ্ছে, কিন্তু সচেতন হচ্ছে না। নারী-নির্যাতনের ঘটনা ততটা কমছে না কোথাও।
হিন্দু নারীদের সম্পত্তির ওপর কোনও অধিকার নেই। বাবার সম্পত্তির ভাগ পুত্র পায়, কন্যা পায় না। বিয়ের পর স্বামীর ঘরেও সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না স্ত্রীরা। বিধবা হলে আশ্রিতা হয়ে যান। যে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নির্যাতিত নারীদের আইনি সহায়তা দেয়, তাদের অভিযোগ কেন্দ্রে এখন হিন্দু নারীদের অভিযোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ভারতে এবং নেপালে হিন্দু আইনের অনেক সংস্কার হয়েছে। হিন্দু নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন অথবা বিধবা হলে তারা ফের বিয়ে করতে পারেন, বাংলাদেশে হিন্দু আইনের কোনও পরিবর্তন হয়নি। হিন্দু নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন না, বিধবা হলে ফের বিয়ে করতে পারেন না। বাংলাদেশে শুধু নিবন্ধনের বিষয়ে একটি আইন হয়েছে ২০১২ সালে। সেটিও বাধ্যতামূলক করা হয়নি। একবার এক আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সম্পত্তির মালিকানাসহ হিন্দু নারীদের অধিকারের প্রশ্নে আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোনও উদ্যোগ নিলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ তোলা হতে পারে, এমন ভয় সরকারের মধ্যে কাজ করে।’
হিন্দুদের অধিকারের পক্ষে সরব যেসব সংগঠন, তারাও হিন্দু নারীদের অধিকার নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। বিবাহ নিবন্ধন আইনটি বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারেও তাদের কোনও আগ্রহ নেই। আসলে সংগঠনগুলোর প্রধান পদে বসে আছেন পুরুষেরা, তারা মোটেও নারীর সমানাধিকার চান না।
বাংলাদেশে হিন্দু আইনের সংস্কার করতে চাইলেই হিন্দুর ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। কিছু প্রগতিশীল হিন্দু বলেন, ‘বিয়ে বা পরিবার নিয়ে ধর্মের স্বীকৃত বিধান চলে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। সে জন্য সংস্কারের ব্যাপারে হিন্দু সমাজে জড়তা আছে।’ কিছু নিয়ম দীর্ঘকাল চললেই সে নিয়মকে টিকিয়ে রাখতে হবে তার কোনও যুক্তি নেই। আর, জড়তা থাকলেই তো জড়তা ভাঙতে হয়। জড়তা টিকে থাকতে পারতো, যদি ওতে কোনও মানুষের সমস্যা না হতো।
বাংলাদেশের হিন্দু নারীরা সচেতন হচ্ছেন বলে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারের দাবি তুলছেন। ভারতের মুসলমান নারীরাও দাবি তুলছেন তিন তালাক নিষিদ্ধ করার জন্য। নারীদের প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার পথে রক্ষণশীল পুরুষরাই এবং তাদের তৈরি পুরুষতন্ত্রই সবচেয়ে বড় বাধা। পুরুষ কবে মানুষ হবে, কবে তারা তাদের সহযাত্রীকে সহযাত্রী বলে ভাববে, দাসী বলে নয়, তা আমরা জানি না। আশা করছি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় শিগগিরই হবে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।