এই সময়ের অভাগার সেই সময়ের ঈদ

0

গোলাম মাওলা রনি
জীবনে প্রথম যেবার রোজা রেখেছিলাম সেটি ছিল ভাদ্র মাস। আমার বয়স তখন নিতান্ত কম, সম্ভবত শিশুগোত্রীয় ছিলাম। অর্থাৎ বালক হওয়ার আগেই রোজা রেখেছিলাম। সেটি কত সাল ছিল মনে করতে পারছি না। তবে যতটুকু অনুমান করতে পারি, তাতে মনে হয় ১৯৭২-৭৩ সাল হতে পারে। আমি যে এলাকার বাসিন্দা সেখানে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভাদ্র মাসের যে চালচিত্র ছিল তার সাথে রমজানের স্মৃতি যোগ করলে যে অনবদ্য একটি কাহিনী রচিত হয় তার মতো সুমধুর কোনো উপাখ্যান আমার পরবর্তী জীবনে দ্বিতীয়বার ঘটেনি। ফলে পবিত্র ঈদুল ফিতরের উৎসবের প্রসঙ্গ এলে আমি আমার জীবনের প্রথম রোজা-প্রথম ঈদ এবং ভাদ্র মাসের সেসব দিনগুলোর কথা স্মরণ করে একধরনের নস্টালজিয়ার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকি। ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার শামপুর গ্রামে ১৯৭২-৭৩ সালের ভাদ্র মাসের প্রতিটি দিন এবং রাত ছিল একেকটি জীবন্ত স্বপ্নপুরী। পুরো গ্রাম ছিল বন্যার পানিতে টইটুম্বুর। আষাঢ়-শ্রাবণের বন্যার পানির সঙ্গে ভাদ্র মাসের পানির অমিল ছিল প্রচুর। আমাদের এলাকায় আষাঢ় মাসের শুরুতে প্রবল বৃষ্টি হতো এবং পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতি প্রভৃতি নদ-নদী ও শাখা নদীতে যে মৌসুমে জোয়ার আসত সেই পানিতে পুরো জনপদ তলিয়ে যেত। সাধারণ ফসলি জমিতে ১০-১২ ফুট পর্যন্ত পানি থাকত এবং প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে পাট, ধান, ধইঞ্চা, আখ প্রভৃতি ফসল পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠত। পানির তোড়ে পুরো জনপদকে মনে হতো শস্য-শ্যামল সাগর।
আমাদের এলাকার বাসিন্দারা বর্ষাকালের পানির কথা মাথায় রেখে উঁচু উঁচু ভিটি তৈরি করে সেখানে বসতবাড়ি গড়ে তুলতেন। কিন্তু তার পরও শেষ রক্ষা হতো না। যে বছর একটু বৃষ্টি বেশি হতো এবং জোয়ারের চাপ বেশি থাকত সে বছর বর্ষার পানি ভিটিমাটি ছাপিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ত। আর যে বছর বন্যা হতো সে বছর লোকজনকে বাড়িঘর ত্যাগ করে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় গিয়ে অস্থায়ী বসতি বানিয়ে মাসখানেক থাকতে হতো। গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবারগুলো বসতবাড়ি ত্যাগ না করে ঘরের মধ্যে উঁচু মাচা তৈরি করত আবার কেউ কেউ শহরে চলে যেত। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের পানি ঘোলাটে থাকত এবং গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্রই পানির স্রোত দৃশ্যমান হতো। অন্য দিকে ভাদ্র মাসের পানি ছিল একেবারে কাকচক্ষুর মতো স্বচ্ছ-শান্ত এবং স্রোতহীন। ফলে ১০-১২ ফুট পানির নিচের ঘাস-লতাগুল্ম এবং সেখানে ক্রীড়ারত বিভিন্ন প্রজাতির মাছের আনগোনা স্পষ্ট দেখা যেত। গ্রাম বাংলার ছেলেবুড়ো সবাই মিলে ভাদ্র মাসের সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা এবং চাঁদনী প্রহর রাতে কলাগাছের ভেলা অথবা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বসতবাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ত এবং প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করত। কেউ হয়তো ধানক্ষেত, কেউ হয়তো পাটক্ষেত-আখক্ষেতের ভেতরে ঢুকে বনবিলাসী হওয়ার চেষ্টা করত। অনেকে আবার হিজল-তমালগাছের কাছে গিয়ে নিজেদের ডিঙ্গি অথবা ভেলা থামিয়ে অপার বিস্ময়ে আকাশ-জমিন-বৃক্ষ এবং ফুলের দিকে তাকিয়ে দেহ-মন শান্ত করত।
আমি যে ভাদ্র মাসের কথা বলছি, সেই মাসে অন্যান্যবারের চেয়ে অনেক বেশি গরম পড়েছিল। আর বন্যার পানিও ছিল বেশ নিরাপদ। অর্থাৎ পানি আমাদের ঘরে ঢোকেনি- তবে বাড়ির মূল ভিটি ছুঁই ছুঁই করছিল। ফলে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা বড় বড় গাছের মগডালে উঠে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে যেভাবে জলকেলি করতাম সেই স্বর্গসুখ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সাঁতার জানা শিশু-কিশোররা হররোজ সকাল-দুপুর-বিকেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলকেলি করত এবং তাদের হইচই, ঝুপঝাঁপ শব্দ, ময়মুরুব্বিদের বকাঝকা এবং গৃহপালিত পশু-পাখির হাঁক-ডাক মিলে এমন একটি নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হতো যা শুধু অনুভব করা সম্ভব বর্ণনা করা একেবারেই অসাধ্য! উল্লিখিত ভাদ্র মাসের রোজার দিনগুলোতে আমাদের বাড়ির শিশু-কিশোররা প্রবল আগ্রহ নিয়ে সাহরি খেত কিন্তু সকাল ৮টা-৯টার মধ্যে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে রোজা ভাঙার জন্য কান্নাকাটি করত। বাড়ির ময়-মুরুব্বিরা রোজাদার শিশু-কিশোরদেরকে আল্লাহ-রাসূলের ভয় দেখাতেন, রোজার ফায়েজ ও বরকত বর্ণনা করতেন এবং জান্নাতের লোভ দেখাতেন। ফলে তারা শান্ত হতো বটে- কিন্তু তাদের মধ্যে যারা একটু দুষ্ট তারা গোপনে পানি খাওয়ার চেষ্টা যেন না করে সেজন্য তাদেরকে ভয় দেখানো হতো যে, যদি চুপ চুপি পানি খাও তবে গলায় পানি আটকে যাবে এবং যদি ডুব দিয়ে পানি পানের চেষ্টা চালাও তবে গলায় টেংরা মাছ ঢুকে যাবে।
উপরোক্ত কথাবার্তা শোনার পর অন্যসব নাবালকের মতো আমিও ভীষণ ভয় পেয়ে যেতাম এবং গোসলের সময় এমনভাবে দাঁত চেপে থাকতাম যাতে করে একফোঁটা পানিও মুখের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে সংযম করতে করতে যখন বিকেল হতো তখন অধীর আগ্রহে অপলক নেত্রে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম সূর্য ডোবার আশায়। সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার পরে আরো খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হতো ইফতারের জন্য যা কিনা সত্যিকার অর্থেই ছিল ভীষণ কষ্টকর। আমার দাদাকে ক্ষণে ক্ষণে জিজ্ঞাসা করতাম, ও দাদা! ইফতার কখন হবে! দাদা মজা করে বলতেন, হাঁস-মুরগি যখন খোপে ঢুকবে তখন। এ কথা শোনার পর আমি আমার সমবয়সীদের নিয়ে হাঁস-মুরগির পেছনে লাগতাম। তাদের দাবড়িয়ে খোপে ঢুকানোর চেষ্টা করতাম যা দেখে মুরুব্বিরা হেসে গড়াগড়ি দিতেন। হাঁস-মুরগির পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা যখন আমাদের শেষ শক্তিটুকু খরচ করে ফেলতাম আর ওমনি ইফতারের ডাক এসে যেত। তারপর পরিবারের সবার সাথে বসে ইফতার! উফ্ কল্পনাই করা যায় নাÑ আল্লাহ প্রদত্ত খাদ্য ও পানীয়ের স্বাদ এত সুমধুর হতে পারে। রোজার তৃতীয় সপ্তাহে যে মঙ্গলবার ছিল সেদিন দাদা আমাকে চৌদ্দরশির বাজারে নিয়ে গেলেন। আমার ছোট ভাইটি তখন সবে হাঁটতে শিখেছে। কিন্তু প্রচণ্ড দুরন্তপনার কারণে তার কোমরে ঘণ্টা বেঁধে দেয়া হয়েছিল যেন ঘণ্টার আওয়াজ শুনে বয়স্করা তার উপস্থিতি আন্দাজ করতে পারেন। কারণ এর আগে বেশ কয়েকবার সে কৌতূহলবশত পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ডুবতে বসেছিল। এ ছাড়া তার আরেকটি অভ্যাস আমাদের সবাইকে তটস্থ রাখত। সে হাতের কাছে সাপ-ব্যাঙ-শামুক-ঝিনুক যা পেত সবই ধরত এবং ইচ্ছেমতো মুখের মধ্যে চালান করে দিত। এসব কারণে দাদা শুধু আমাকে নিয়েই বাজারে গেলেন এবং ছোট ভাইটির শরীর, মাথা ও পায়ের মাপ নিয়ে নিলেন জামা-জুতা-টুপি কেনার জন্য।
জীবনের প্রথম ঈদের বাজারের স্মৃতি আজো আমার মানসপটে যেভাবে রঙিন বর্ণময় হয়ে রয়েছে, তার সাথে পরবর্তী জীবনের কোনো বাস্তব অথবা স্বপ্নময় দৃশ্যের তুলনা চলে না। আমি আজো চোখ বুঝলে দেখতে পাই, ভাদ্র মাসের মঙ্গলবারের সেই হাটবারের দিনে চৌদ্দরশি বাজারের সব কিছুতেই ঈদের রঙ লাগানো ছিল। সারি সারি আতশবাজির দোকান। তারপর কাগজের টুপি, বাঁশি, পুতুল, লাটিম, লজেন্স, রয়েলগুলি, রঙিন বিস্কুটসহ আরো অনেক শিশুতোষ পণ্যের দোকান। দাদা প্রতিটি দোকানে ঘুরে ঘুরে আমার জন্য এবং ছোট ভাইয়ের জন্য সব কিছু কিনলেন। এরপর জামা-জুতা কেনার পর একটি টিনের পিস্তলও কিনে দিলেন। সবকিছু কেনার পর যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, যেন আমি জিন-পরীদের স্বপ্নরাজ্যের কোনো রাজকুমার, বহু রাজ্য জয় করে বিজয়ীর বেশে আপন আলয়ে ফিরছি। বাড়ি ফেরার সাথে সাথে আমার ঈদের সামগ্রী গোপন স্থানে লুকিয়ে ফেললাম যেন কেউ দেখতে না পারে। তারপর ঈদের জন্য পরবর্তী সাত দিনের অপেক্ষা এবং সময় সুযোগ বুঝে গোপন কুঠুরি থেকে উপহারসামগ্রী বের করে বারবার দেখা, ঘ্রাণ নেয়া, শরীরের সাথে বিশেষ করে বুকের সাথে কিছুক্ষণ আঁকড়ে রাখার মাধ্যমে ঈদ-রোজা এবং সেই সময়ের ভাদ্র মাসকে মানসপটে এমনভাবে অঙ্কিত করেছি যা হয়তো ইহজগতে কেবল মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে মোচন করা সম্ভব নয়। আমার অপেক্ষার পালা শেষ করে যেদিন ঈদ এলো সেদিন কাকডাকা ভোরে বাসনার সাবান দিয়ে গোসল করলাম। নতুন পোশাক পরে শরীরে স্নো-পাউডার এবং আতর মেখে দাদার সাথে ঈদগাহে যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠতে যাবো, অমনি আমার দাদী কাজলদানি নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির। তিনি আমার কপালের বাম দিকটায় নিজের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে একটি কাজলের টিপ লাগিয়ে দিলেন যেন আমার ওপর কারো বদনজর না পড়ে। ঈদের মাঠে গ্রামের সব ছেলে হাজির। সবার মাথায় রঙিন কাগজের টুপি, পরনে নতুন পোশাক, হাতে বা গলায় বাঁশি, কোমরে পিস্তল বা কাঠের ছোট্ট তলোয়ার আবার অনেকের হাতে লাঠি লজেন্স। শিশু-কিশোরদের কলরব, ঈদ উপহারের বড়াই এবং খুনসুটিতে পুরো ঈদগা সরগরম। মুরুব্বিরা বললেন, ওদের জন্য তো নামাজ পড়া যাবে না। কারণ জামাত শুরু হলেই এমন হাসাহাসি শুরু করবে যা দেখে বুড়োরাও হাসাহাসি শুরু করে দেবে। আমরা যখন নামাজে দাঁড়ালাম তখন সত্যিই সেখানে হাসাহাসির গড়াগড়ির যে ইতিহাস পয়দা করলাম, যার কারণে হাসির ভাইরাস সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এবং পরিস্থিতি এমন হলো যে, নামাজ শেষে হাসির অপরাধে কাউকে বকা দেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া গেল না। বরং নামাজ শেষে খুতবার সময় অনেক মুরুব্বি মাথা নিচু করে হাসি চেপে রাখতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি বের করে ফেললেন। আজকের পরিণত বয়সে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের শেষ দিনে অর্থাৎ শুক্রবারে যখন ঈদের নামাজের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলাম তখন জটিল জীবনের বহু কুটিল ঘটনা, করোনার মহামারী, গণতন্ত্রের জন্য হাহাকার, সন্ত্রাসী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল কর্তৃক পবিত্র আল-আকসা মসজিদ আক্রমণ, বাংলাদেশের লকডাউন ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করার পরিবর্তে যখন শৈশবের সেই ভাদ্র মাসের ঈদের স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম তখন নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে ঈদের অলৌকিক পুলক এসে এই-কাল থেকে সেই-কালে নিয়ে গেল।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য