যত গর্জালেন তত বর্ষালেন না তামিম-ডোমিঙ্গোরা

0

ইমাম হোসাইন সোহেল॥ কেন উইলিয়ামসন নেই, রস টেলরও ছিটকে গেলেন। এই তো সুযোগ। আনন্দে নেচে উঠলো সমস্ত তনুমন। সেই আনন্দে গত কয়েকদিন নিয়মিত ঢোল বাজল কুইন্সটাউন আর ডানেডিন থেকে। অধিনায়ক থেকে কোচ- কেউ বাদ থাকেননি। ঢোল বাজিয়ে গেছেন। বক্তব্য কমন, ‘এবারই তো সুযোগ, আগে যা কেউ পারেনি, এবার তা আমরা করে দেখাবো।’ কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো বলেছিলেন, ‘আগের চার সফরে নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ দল যা করতে পারেনি, আমরা এবার তা করে দেখাতে পারবো।’ অধিনায়ক তামিম ইকবাল আরেকটু এগিয়ে। তিনি, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ইতিহাস রচনা করবে বাংলাদেশ দল। প্রথমবারের মত নিউজিল্যান্ডের মাটি থেকে বাংলাদেশকে জয় উপহার দিতে পারবেন তিনি। নিজের ওপর খুবই আত্মবিশ্বাসী তামিম। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো। কিন্তু সেটা অতিরিক্ত হয়ে গেলেই সমস্যা। তামিমের অতি আত্মবিশ্বাস তৈরি হওয়ার দুটি কারণ, নিজেই বলেছেন। দলের মধ্যে পেসারদের আধিক্য থাকা। বাংলাদেশ দলে এখন মোস্তাফিজ, তাসকিন, রুবেলছাড়াও বেশ কয়েকজন সম্ভাবনাময়ী পেসারের আগমণ ঘটেছে। এর মধ্যে হাসান মাহমুদের তো অভিষেক হয়েই গেছে। পেসার শরিফুল ইসলাম অভিষেকের অপেক্ষায়। মোট কথা, দল সাজাতে গেলে এখন টিম ম্যানেজমেন্টকে মধুর সমস্যায় পড়তে হয়। পেসার কাকে বাদ দিয়ে কাকে নেয়া যাবে দলে, সে সমস্যা ভর করে ম্যানেজমেন্টের ওপর। তামিম আশাবাদী, এবার এই পেস দিয়েই তিনি ঘায়েল করবেন নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের। সেখান থেকেই প্রথম জয়ের সৌধ নির্মাণ হবে নিউজিল্যান্ডে।
শুধু পেসারদের ওপর ভর করাই নয়, তামিম আরেকটা বিষয়ের ওপর জোর দিলেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। এটা তো একেবারে খাঁটি কথা। মাঠের বাইরে শত পরিকল্পনা করা যায়, হেন করে ফেলবো-তেন করে ফেলবো, কিন্তু মাঠে গিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নই হলো আসল। তামিম সেটাতেই জোর দিলেন। তার কথায় মনে হলো, নাহ! এবার যেন-তেন কোনো পরিকল্পনা নয়, একেবারে নিখুঁত পরিকল্পনা করেই মাঠে নামতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যেটা বাস্তবায়ন না হয়েই যায় না। নিজেদের প্রস্তুতিটাও হয়েছে সেরা- এটা তামিম ইকবালের দাবি। তিনি সরাসরিই বলে দিয়েছিলেন, ‘হয়তোবা আমাদের মুখ থেকে শুনবেন না যে (এমনকি এই সিরিজ ভালো হোক কিংবা খারাপ হোক) প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। আমার কাছে মনে হয় যে এখন পর্যন্ত যে প্রস্তুতি নিয়েছি তাতে আমরা সন্তুষ্ট।’ সুতরাং, পুরোপুরি আটঘাঁট বেধেই আজ ডানেডিনের ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল তামিম বাহিনী। তিনি চেয়েছিলেন তিনজন পেসার, একজন অলরাউন্ডারসহ মোট ৫জন খাঁটি বোলার নিয়ে খেলতে। তো টিম ম্যানেজমেন্ট তার চাহিদা পূরণ করেছে। তিনজন পেসার মোস্তাফিজ, তাসকিন এবং হাসান মাহমুদকে নিয়েছে দলে। একজন অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়েছে দলে। আর একজন খাটি স্পিনার মেহেদী হাসানকে (যাকে মিনি অলরাউন্ডারও বলা যায়) নিয়েছে দলে। কিন্তু অবুঝ মনে প্রশ্ন জাগে, নিউজিল্যান্ডের পেস কন্ডিশনে কেন একজন স্পিন অলরাউন্ডার নেয়া হলো? কেন পেস অলরাউন্ডার সাইফউদ্দীনকে বসিয়ে রাখা হলো। আমরা না নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডের মত দেশগুলোর জন্য বহুদিন ধরে একজন পেস অলরাউন্ডারের খোঁজে ছিলাম? তো সেই পেস অলরাউন্ডার যখন তৈরি হলোই, তখন ওইসব কন্ডিশনে কেন তাকে মাঠের বাইরে রাখা হয়? টিম ম্যানেজমেন্টই ভালো বলতে পারবেন। তারা উইকেট, প্রতিপক্ষ এবং কন্ডিশন – এসব বিবেচনা করেই তো দল তৈরি করেছে। নিশ্চয় আমাদের মত কম জানা মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি ভালো জানেন দেখেই একাদশ তৈরি করেছেন এভাবে। সে যাই হোক, অধিনায়ক তামিম আর কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোর কথায় আসি। ডানেডিনে ওয়ানেড সিরিজ শুরুর আগে তারা অনেক গর্জালেন। মুহুর্মুহু গর্জনে অবশ্য নিউজিল্যান্ড কাঁপলো কি না জানা নেই। তাদের অধিনায়ক উইলিয়ামসন খেলতে পারছেন না। রস টেলরও খেলতে পারছেন না। তা নিয়ে তারা বিচলিত ছিল কি না, তাও জানা নেই। অবশেষে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক টম ল্যাথামের সঙ্গে টস করলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক তামিম ইকবাল। টস নামক ভাগ্যের খেলায় পরাজয় দিয়েই শুরু। সকালের শিশির ভেজা মাঠে কিউই পেসের সামনে ব্যাট করতে পাঠানো হলো বাংলাদেশকে। উইলিয়ামসন আর টেলর না থাকায় যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গিয়েছিল, সেখানে যে কিউই দলে বর্তমান সময়ের সেরা পেসার ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরি, কাইল জেমিসন, জেমস নিশামরা আছেন- সেটা হয়তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিল বাংলাদেশের কোচ এবং অধিনায়ক। যে কাইল জেমিসনকে পেতে কয়েকদিন আগে আইপিএলের নিলাম টেবিলে তুমুল লড়াই হয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত বিরাট কোহলির ব্যাঙ্গালুরু তাকে কিনেছে ১৫ কোটি রুপি দিয়ে। এতটাই মূল্যবান তিনি! নিউজিল্যান্ড ঘরের মাঠে নেমেছে চারজন স্পেশালিস্ট পেসার নিয়ে। স্পিনার ছিলেন একজন- মিচেল সান্তনার। আর সেখানে বাংলাদেশ একজন অলরাউন্ডার নিল- তাও স্পিন অলরাউন্ডার।
সুতরাং, চিরাচরিত যে বিষয়টা, সেটাই ঘটলো ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠে। ব্যাটসম্যানরা তেড়েফুঁড়ে লড়াই করতে গেলেন কিউই বোলারদের। কারণ, তাদেরকে তো গোনাতেই ধরা হয়নি। সুতরাং, বেঘোরে উইকেট হারাতে শুরু করলেন তামিম ইকবালরা। সর্বোচ্চ ২৭ রান করলেন টেস্ট দলে ভ্রাত্য হয়ে যাওয়া মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। মুশফিকুর রহীম করলেন ২৩ রান। লিটন দাস করলেন ১৯ রান। কিউই বোলারদের সামনে ব্যাটসম্যানরা চেষ্টা করেছেন দাঁত কামড়ে ব্যাট করার জন্য। ৪১.১ ওভার খেলাটাই তার প্রমাণ। ৩.১৩ রান রেটে স্কোরবোর্ডে উঠলো কেবল ১৩১ রান। এইখানে এসে সত্যিই ইতিহাস রচনা করলেন তামিম ইকবাল অ্যান্ড কোং। গত পাঁচ বছরে নিউজিল্যান্ডের কাছে অনেকবার হেরেছে বাংলাদেশ, এটা সত্য। কিন্তু এতটা অসহায় আত্মসমর্পন এর আগে আর কখনো করেনি। অন্তত লড়াইটুকু করেছে। দলীয় স্কোর বাংলাদেশের ২২০ এর নিচে নামেনি এই পাঁচ বছরে। এবার সেটা গিয়ে ঠেকলো ১৩১ রানে। এটা নিশ্চিত ইতিহাস এবং কোচ ডোমিঙ্গো ও অধিনায়ক তামিমের কথায়- আগের সফরগুলোতে যা করতে পারেনি বাংলাদেশ, এবার তারা তাই করবে- সে কথারই বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেলো এবার ডানেডিনে।
নিউজিল্যান্ড ১৩২ রানের লক্ষ্য পেয় ভাবলো এটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ৫০ ওভারের খেলার চিন্তা তাদের মাথা থেকে দুর হয়ে গেলো। টি-টোয়েন্টি স্টাইলে খেলেই ২১.১ ওভারে, মাত্র ১৭২ বল হাতে রেখে, ২ উইকেট হারিয়ে তারা পৌঁছে গেলো জয়ের লক্ষ্যে (ব্যবধান ৮ উইকেট)। ম্যাচ শেষে চিরাচরিত নিয়মানুসারে তামিম নিজেদের ব্যাটিংয়ের দোষ দিয়ে গেলেন। যদিও দাবি করলেন, এই ব্যাটিংটাই গর্বের। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে আমরা খুব বেশি আলগা শট খেলেছি। তাঁরা ভালো বল করেছে। কিন্তু আমরা কিছু বাজে শট খেলেছি। আমাদের নিজেদেরই দোষ। আমরা নিজেদের ব্যাটিং নিয়ে অনেক গর্ব করি। সেটা আজ কাজে লাগেনি। ১৩১ এই উইকেটে যথেষ্ট রানের কাছাকাছি না। আশা করি ভুলগুলো ধরতে পারব এবং পরের ম্যাচে ভুল এড়িয়ে চলব। আগেই বলেছি, আমরা আমাদের ব্যাটিং নিয়ে অনেক গর্ব করি।’ বোঝাই যাচ্ছে সেই নিখুঁত (!) পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। প্রস্তুতি ভালো হয়েছে, পেস বোলিং ডিপার্টমেন্ট সমৃদ্ধ হয়েছে- এসব কথা ম্যাচের আগে তামিম বলেছিলেন; কিন্তু তাদের ব্যাটিংয়ের কী অবস্থা সেটা বলেননি। সেটা বলেননি হয়তো, তা নিয়ে গর্ব করার অনেক কারণ ছিল বলে। যে বিষয়টা নিয়ে গর্ব করা যায়, তা নিয়ে বিশেষ আর কী কাজ করার থাকে কিংবা সেসব নিয়ে প্রস্তুতি না নিলেও তো চলে, তাই না? সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফুর রহমান বাবু লিখেছেন, ‘অথচ, নিউজিলান্ডের সব উইকেটেই বাংলাদেশের চেয়ে গতি ও বাউন্স বেশি থাকে। তা সবারই জানা। সেই বাড়তি পেস ও বাউন্সের সাথে মানিয়ে নিতে একটু রয়ে সয়ে খেলা এবং বলের মেধা ও গুনাগুন বিচার করে ব্যাট চালানো জরুরি। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কারো মধ্যে সেই চেষ্টাটাই দেখা যায়নি। দেখে মনেই হয়নি তারা নিউজিল্যান্ডের পিচে খেলছেন। যে দেশের উইকেটের সাথে গড়পড়তা বাংলাদেশের পিচের গতি ও উচ্চতার ফারাক বিস্তর। নিউজিল্যান্ডের উইকেটে সেই লেন্থে পড়া ডেলিভারিই গড় পড়তা পেটের থেকে বুক সমান উচ্চতায় উঠে আসে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আগে সেই বাড়তি বাউন্সের সাথে মানিয়ে নেয়া জরুরি; কিন্তু কেউ সে চেষ্টা করেননি।’ বাংলাদেশ ক্রিকেটে কোচিং স্টাফের অভাব নেই। বিসিবি পারলে প্রতিটি খেলোয়াড়ের জন্য এক একজন বিশেষজ্ঞ কোচ রেখে দেয় এবং তাও বিদেশি কোচ। নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে বুম সমান উচ্চতায় বল আসে- এর বিপক্ষে কিভাবে ব্যাটিং করতে হয়, তা শেখাননি? নিশ্চয় শিখিয়েছেন। না হয় কিভাবে ৪১.৫ ওভার খেলতে পারলেন ব্যাটসম্যানরা? অনেক কথা বলা হলো, বলতে চাইলে আরও বলা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তামিম আর কোচ ডোমিঙ্গোর তর্জন-গর্জনকে থামিয়ে ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠে নিউজিল্যান্ড যে জ্বলজ্বলে সূর্যের উদয় ঘটালো, পরের দুই ম্যাচেও যদি তারা এমন সুর্যোদয় ঘটান, তাহলে নিশ্চিত আরও বড় ইতিহাস রচনা করে আসতে পারবেন তামিম অ্যান্ড কোং।