টার্গেট প্রত্যাবাসন: মিয়ানমারের পালাবদলে কাজে আপত্তি নেই ঢাকার

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ রাতের আঁধারে মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে গেছে। নির্বাচিত সরকারকে আচমকা উৎখাত করে দেশটির শাসনভার নিয়ে নিয়েছে সেনাবাহিনী । জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দুনিয়া সর্বোচ্চ কড়া ভাষায় বর্মী সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের প্রতি পূর্বের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া বেশ সংযত এবং সতর্ক। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চীন, ভারত কিংবা আসিয়ান জোট আর পশ্চিমা প্রতিক্রিয়ার তুলনায় ঢাকার বিবৃতিটি অনেকটা ব্যালেন্স। মিয়ানমারের শান্তি এবং স্থিতিশীলতা কামনা করেছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দেশটিতে গণতন্ত্র এবং সংবিধানকে সমুন্নত দেখতে চেয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের রাখাইনে টেকসই, নিরাপদ এবং স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনে চলমান উদ্যোগগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নও চাওয়া হয়েছে তাৎক্ষণিক প্রচারিত ঢাকার ওই বিবৃতিতে।
ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বন্ধু রাষ্ট্রের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি শব্দও উল্লেখ না করে, বিশেষত অভ্যুত্থানের নিন্দা না জানিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ যেভাবে জোর দিয়েছে তা বিশ্ব মিডিয়ারও দৃষ্টি কেড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ কি আদতে মিয়ানমারের সেনা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত? জবাব খুঁজতে গেলে পেশাদার একাধিক কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল- এখনই বলা ‘প্রিমেচিউর কমেন্ট’ হবে। তবে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে সেনারা খুব সহজে ক্ষমতা ছাড়বে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ পর্যন্ত বাংলাদেশ বা দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রই হয়তো বসে থাকবে না। বরং যে যার মতো করে পরবর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্ট ঢাকার এক কর্মকর্তা আরো খোলাসা করে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বেশকিছু উদ্যোগ চলমান আছে। চলতি (ফেব্রুয়ারি) মাসেই চীনের মধ্যস্থতায় কর্মকর্তা পর্যায়ে ঢাকায় একটি বৈঠক হওয়ার কথা। প্রত্যাবাসন চেষ্টায় প্রস্তাবিত ত্রিদেশীয় ওই বৈঠক স্থগিত বা পেছানো- কোনটাই ঘটেনি গত ২৪ ঘণ্টায়। কিন্তু বাস্তবতা কি? ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি এ মাসে সম্ভব হবে? নিশ্চয়ই না। ওই কর্মকর্তা নিজে থেকে প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, তাহলে কি বাংলাদেশ মাসের পর মাস বৈঠকটির অপেক্ষায় থাকবে? এটা কী সমীচীন হবে? নিশ্চয়ই না। তাহলে বাস্তবতা হলো আসিয়ান বা চীনের যে চাওয়া মিয়ানমারে দ্রুত নরমালসি ফিরে আসা। সেটি হওয়ার পর অর্থাৎ খানিকটা স্থিতিশীলতা ফেরত এলেই চীন ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেবে। সে ক্ষেত্রে চীন ও মিয়ানমার বৈঠকে রাজি হলে বাংলাদেশের পক্ষে তা এড়িয়ে যাওয়া বা ‘না’ বলা সম্ভব হবে না। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, মিয়ানমার দীর্ঘদিন সামরিক নেতৃত্বের অধীনে ছিল। গণতন্ত্রের নেত্রী হিসেবে খেতাব পাওয়া অং সান সুচি ছিলেন কারান্তরীণ। বছর চারেক আগে দেশটি ‘খোলসধারী গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করেছিল। গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য তারা দুনিয়ার বাহবা কুড়ালেও কার্যত সামরিক এবং বেসামরিক নেতৃত্বের সম্মিলনীতে মিয়ানমার চলছিল। সেখানে আনুপাতিক হারে কম-বেশি বা গরমিল ছিল। গত নভেম্বরের নির্বাচনে সুচির দল নিরঙ্কুশ জয় পায়। যা মেনে নিতে পারেনি সেনা নেতৃত্ব। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। এ জন্য সংসদ বসার দিনেই তারা তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এ নিয়ে দুনিয়াবাসীর উত্তেজনা হয়তো খুব সহসাই প্রশমিত হয়ে যাবে! তাছাড়া সুচিকে মুক্তি দিয়ে যদি সামরিক সরকারও গঠিত হয় তাতে উত্তেজনার পারদ এখন যেখানে উঠেছে তা নামতে বাধ্য। মিয়ানমারের পরিবর্তিত নেতৃত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বা সম্পর্ক কেমন হবে? তার প্রেক্ষাপট পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন এক সাংবাদিক। জবাবে তিনি এটা বলার চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশ বরাবরই মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে কাজ করে। তাছাড়া সেনা নেতৃত্বের আমলে দু’দফা (১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল হওয়ার বিষয়টিও এ সময় মন্ত্রী স্মরণ করেন। সামনের দিনে প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্ট অন্য যোগাযোগ এবং সম্পর্কের বিষয়টি যে কঠিন হবে না বা মিয়ানমারে সরকারে কে থাকবে বা থাকবে না তা নিয়ে যে ঢাকার খুব মাথা ব্যথ্যা নেই তা মন্ত্রীর কথায় অনেকটাই স্পষ্ট।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দেখতে চেয়ে বাংলাদেশের বিবৃতি বিষয়ক মানবজমিন অনলাইনে প্রচারিত রিপোর্টে একজন সচেতন পাঠক প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে এখনই সোচ্চার হতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের বিবৃতির প্রশংসা করে যে মন্তব্যে করেছেন তার অংশবিশেষ ছিল এমন- ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে যে বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসেছে তাদের সুষ্ঠু প্রত্যাবাসন আবশ্যক। দেশটির অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে তা যেনো বিঘ্নিত না হয় সেই আশা করছে বাংলাদেশের জনগণ। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান- রোহিঙ্গাদের আবাস ভূমিতে ফিরে যেতে (আপনারা) সবাই সোচ্চার হোন। এখনই আওয়াজ তুলুন। এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টা আলোচনায় অগ্রাধিকার পাওয়া জরুরি।’ মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদলে রোহিঙ্গা বিষয়ক দেশটির নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মিয়ানমারে কেন এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘটনাগুলো কেন এই মুহূর্তে হলো, এ ইস্যুতে চূড়ান্ত পর্বে চীনের ভূমিকা কী হবে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই বা শেষ পর্যন্ত কতটা সুচির পক্ষে থাকবে? তা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে এবং তা হয়তো আরো ক’দিন চলবে। কিন্তু এটা স্পষ্ট- এ পরিবর্তন রোহিঙ্গা সমস্যায় বিরাট প্রভাব ফেলবে। বিশেষত চলমান নেগোসিয়েশন প্রলম্বিত হবে। তবে মিয়ানমার পরিস্থিতি যাই হোক বা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসার মতো পরিবেশ থাকুক বা না থাকুক আন্তর্জাতিক অপরাধ কোর্ট (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচারিক কোর্টে (আইসিজে) চলমান মামলার বিষয়ে বাংলাদেশ তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান পেতে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।