জমিদারের নাতির সান্নিধ্যে

0
ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন
২০০৪ সালের জানুয়ারি। তৎকালীন ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ভাইয়ের মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে সকাল ৭টায় উপস্থিত হলাম। তাঁকে সালাম দিতেই বললেন, নাস্তা করে নাও। নাস্তা করে এসেছি বলার আগেই আন্তরিকতার পরশে, অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে তিনি বললেন, অতিথিকে নিয়ে সকালের নাস্তা না করলে যাত্রা মঙ্গল হয় না। আপত্তি না করে টেবিলে বসে পড়লাম। শীতের পিঠাসহ হরেক রকমের খাবার। ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী সকালের নাস্তার ধারণা আমার মোটেই ছিল না। টেবিলে বাহারি নাস্তার সাজ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, এ যেন জমিদারবাড়ির নাস্তা। হঠাৎ মনে হলো তিনি তো জমিদারেরই নাতি। দাদা জমিদার চৌধুরী মঈজউদ্দিন বিশ্বাস আর বাবা মোহন মিয়া ছিলেন ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বঙ্গের আইন পরিষদের সদস্য এবং ’৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী। সেই রক্তের ধারাবাহিকতায় অতিথিপরায়ণ কামাল ভাই নিজ হাতে ফরিদপুরের সুস্বাদু নাস্তাগুলো আমাকে এক এক করে তুলে দিচ্ছিলেন।
তাঁর ডান পাশে বসে আছি আর বিভিন্ন বিষয়ে গল্প শুনছি। তাঁর গাড়িতে করে যাব এ সিদ্ধান্তটি আমার পূর্বপরিকল্পিত। কেননা আমি চাঁদপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত চাঁদপুরের নৌ-সীমানায় জাটকা নিধন প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করি। ক্ষতিগ্রস্ত অংশগ্রহণকারী ১৫ হাজার জেলেকে পাঁচ মাসের জন্য প্রতিজনে ২০ কেজি করে চাল বরাদ্দ করার নিমিত্ত মাননীয় ত্রাণমন্ত্রীর সহযোগিতা প্রয়োজন। বিষয়টি তাঁকে আন্তরিকভাবে বোঝানোর জন্যই সফরসঙ্গী হয়েছি। সে বক্তব্য পেশ করার আগেই স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের বাহনটি যে কখন ফেরিতে এসে উঠল খেয়ালই করিনি। ফেরিতে উঠতে না উঠতেই সকালের কুয়াশা ভেজা চাদর আর মাফলারে ঢাকা প্রায় সব যাত্রীই উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল কোন মন্ত্রী যাচ্ছেন এ ফেরিতে। বিভিন্ন কারণে আমিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নকল প্রতিরোধ সংগ্রামের সিপাহসালার হিসেবে বহুবার দক্ষিণ বাংলায় মাওয়া-কেওড়াকান্দি ফেরিপথ অতিক্রম করেছি। কিন্তু আজকের মতো জনতার উৎসুক দৃষ্টি আর কখনো দেখিনি। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশি কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ফরিদপুর-৩ আসন থেকে পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য কামাল ভাই। তিনি এমনভাবে আমাকে নিয়ে হাঁটছিলেন, মনে হলো প্রথমবারের মতো ফেরিতে উঠেছি। অতি আদরে, পরম মমতায় তিনি হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। বুঝতে দেরি হলো না, আমাকে নয়, উৎসুক জনতার দৃষ্টি তাদেরই বহুদিনের পরিচিত নেতা, মোহন মিয়ার ছেলের দিকে।
চারদিক থেকে শত শত সালামের উত্তর দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেলেন, উপস্থিত অনেকের নাম ধরে তিনি কুশলাদি বিনিময় করলেন। এগিয়ে গেলাম ভিআইপি রুমের দিকে। ততক্ষণে সারা ফেরিতে রটে গেল কামাল ভাইয়ের উপস্থিতি। মানুষের জটলা ভেদ করে ফেরিতে উঠতে পারছিল না দন্ডায়মান গাড়িগুলো। পুলিশের হুইসেলের তীব্রতা এতটাই বেড়ে গেল যে তিনি কুশলাদি বিনিময় করতে পারছিলেন না। ভিআইপি রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই ফরিদপুরের স্থানীয় নেতা-কর্মীর ভিড়ে রুমটি উপচে পড়ছিল। বাঁধভাঙা জোয়ারের পানির মতো ফেরির কর্মচারী থেকে শুরু করে বেসামাল ভিড়কে আলিঙ্গন করে কামাল ভাই দক্ষিণবঙ্গের গণমানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় শুরু করলেন। সামন্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একজন ব্যক্তি কীভাবে গণমানুষের নেতা হতে পারেন, সেটাই দেখছিলাম আর ভাবছিলাম। দলের নিবেদিত কর্মীদের পেয়ে গল্পে মশগুল হয়ে গেলেন তিনি। ভিআইপি রুমের চা-বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা নদীর মাছের গল্প শুরুর চেষ্টা করছিলাম। শুরু করলাম ইলিশ দিয়ে। নগরবাড়ী ঘাটের ইলিশ মাছ নাকি চাঁদপুরের ইলিশের চেয়েও সুস্বাদু। শুরু হয়ে গেল ইলিশের গল্প। কামাল ভাই বলতে শুরু করলেন সমুদ্র মোহনা থেকে ইলিশ মাছ যতই মিঠা পানির নদী দিয়ে উজানে আসতে থাকে ততই স্বাদ বদলাতে থাকে। ফারাক্কার কারণে খরস্রোতা নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় ইলিশ আর এখন পদ্মা পাড়ি দিয়ে মাগুরার মধুমতি হয়ে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীতে যায় না।
সেই সঙ্গে তিনি অন্যান্য মাছের গল্পও শুরু করলেন। আগের দিনে অর্থাৎ তাঁদের সময়ে, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মাছ ধরত নিম্ন গোত্রের সনাতনধর্মের জেলেরা এবং এ ব্যবসায়ে ওই গোষ্ঠীর লোকেরাই সম্পৃক্ত ছিল, তাই তারা জাটকা ধরত না। আইড়, পাঙ্গাশ, রুই, কাতল, শোল, বোয়াল, রিঠা, চিতল এ ধরনের মাছ ডিম দেওয়ার সময় বা যখন পোনা ফুটিয়ে মা মাছগুলো পাহারা দিয়ে বড় করে, তখন সনাতন জেলেরা ধূপ দিয়ে পূজা করত যেন এ মাছগুলো বড় হলে তাদের আয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর আজকের দিনে সব ধর্ম-গোত্র থেকে জেলে হওয়ার কারণে মাছ বড় হওয়ার জন্য পূজা দূরের কথা, পোনা মাছ, মা মাছ আর ডিমওয়ালা মাছ নিধন উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। এ জন্যই মাছ ধরার ব্যাপারে কিছু কিছু আদি সংস্কৃতি ছিল- এই দিন, ওই দিন মাছ ধরা যায় না, সব দিন মাছ খাওয়া যায় না। কামাল ভাই আরও বললেন, জেলেরা বাজার থেকে বড় বড় মাছের লেজ বেঁধে, কাঁধের ভারে করে নিয়ে আসত বাড়িতে। জেলেরা জাটকা ইলিশ ধরে চার আনাও বিক্রি করতে পারে না, তবু কারেন্ট জাল দিয়ে ইলিশ নিধন চলছেই। কোনো অভয়ারণ্য নেই, যেখানে মাছগুলো কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নেবে, ডিম ফোটাবে। এভাবে যদি চলতে থাকে ইলিশ কোনো একদিন হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে। নদীতে আর বড় মাছই পাওয়া যাবে না। আনমনে তিনি মাছের গল্প করছেন। আর আমি তৃপ্তি নিয়ে শুনছিলাম, যা আমি বলতে এসেছিলাম। এরই মধ্যে বিশাল ফেরিখানি পদ্মার বুক চিরে ঘাটে এসে ভিড়ল। এপাড়ে নামতেই স্লোগানে মুখরিত হাজারো মানুষের ভিড়, যেমনটা ছিল ওপাড়ে। এরপর সার্কিট হাউসে এসে গার্ড-অব-অনার গ্রহণ করে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কামাল ভাই বললেন, আমার ওখানে না হয় বিশ্রাম নেবে, চল বাড়ির দিকে যাই।
আমার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মন্ত্রী মহোদয়কে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে যেতে অনুরোধ করলেন। তিনি এতটাই উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন যে ব্যক্তিগত সহকারীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেননি পূর্বনির্ধারিত কোনো কর্মসূচি আছে কিনা। এ যেন ছোট ভাইয়ের অনুরোধে বড় ভাইয়ের বেরিয়ে পড়া। আগেই চুপিচুপি তাঁর সফরসূচি জেনে আমি আমার মতো করে কর্মসূচি তৈরি করে নিয়েছিলাম। ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে আসতে না আসতেই বিএনপি নেতা শাহজাদা মিয়া ও অধ্যক্ষসহ শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখে আর প্রবেশদ্বারে সাজানো তোরণে, সাঁটানো ব্যানারে প্রধান অতিথির নাম দেখে তিনি ব্যক্তিগত সহকারীকে জিজ্ঞেস করলেন, কর্মসূচির ব্যাপারে তাঁকে আগে অবহিত করা হয়নি কেন? আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনাকে সারপ্রাইজ দেব বলে। তিনি এগিয়ে যাওয়ার সময় অন্যদিকে একটি ছোট্ট প্যান্ডেল দেখিয়ে বললাম, ভাই, চলুন, আগে ওখানে যাই। সেখানে যেতেই তাঁর চোখ ছানাবড়া! সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে ছাত্রীনিবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের স্মৃতিফলক প্রস্তুত, তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন এবং এরপর দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। একইভাবে সারদাসুন্দরী কলেজ ও সরকারি মীর ইয়াসিন আলি কলেজে একাডেমিক ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। বিকালে তিনি আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন তাঁর নির্বাচনী এলাকায়। ফেরার পথে মাদারীপুরের শিবচরের বাহাদুরপুরে তাঁর নানা হজরত পীর বাদশাহ মিয়ার মাজার জিয়ারত করি, যাঁর নামে ফরিদপুর কারাগারে একটি জেল ভবনও আছে। ঢাকায় ফিরতে ফিরতে তিনি আমার জাটকা নিধন প্রতিরোধ আন্দোলনের সহযোগী জেলেদের চাল বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিলেন। শুরু হলো জাটকা নিধন প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাসে ফরিদপুর জেলা বিএনপি সভাপতি শাহজাদা মিয়া, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জেড এ খান, কামাল ভাই ও আমি যাচ্ছিলাম উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের উদ্দেশে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১১৬টি আসন নিয়ে সপ্তম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আওয়ামী সরকারের নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে রোডমার্চে অংশ নিই। আমি এবং ছাত্রদলের সাবেক নেতারা প্রতিটি সভাস্থলে দেশনেত্রীর উপস্থিতির আগে অ্যাডভান্স টিম হিসেবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দায়িত্ব পালন করছিলাম। পঞ্চগড় স্টেডিয়ামে আমাদের শেষ সভা। গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকালে ঘড়িতে তখন সময় প্রায় ৪টা। সে দিনটি ছিল বিগত শত বছরে উত্তরবঙ্গের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। দুপুরের কড়া রোদে উষ্ণতা ছিল অসহনীয়। পঞ্চগড় স্টেডিয়ামে সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। আমার দেখা সব ঋতুতেই তিনি থ্রি পিস স্যুট পরেন। দুষ্টুমির পরশে কামাল ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম আজও কি তাঁর ব্যতিক্রম হবে কিনা? এরই মধ্যে জেড এ খান সাহেব বাজি ধরলেন। অ্যাডভান্স টিমের সদস্য হিসেবে সভাস্থলে উপস্থিত হতেই ব্যারিস্টার সাহেবকে দেখেই আমি জানতে চাইলাম, স্যার, এত গরমে এ পোশাকে আছেন কীভাবে? উত্তরে বললেন, রাজনীতি করতে হলে জনগণের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত করতে হয়, বুঝতে হবে, ওরা তো আমাকে এ পোশাক ছাড়া চিনবে না, তাই কষ্ট করছি। প্রচন্ড উত্তাপের কারণে গাড়িতে বসা আমার সফরসঙ্গীরা জানতে চাইলেন, কে জিতেছে বাজিতে। আমার ধারণা ছিল কামাল ভাই হেরে যাবেন। কিন্তু হারেননি। হেরে গেলেন তিনি বৈশ্বিক করোনার দ্বিতীয় থাবায়। তিনিও পারতেন অন্যান্য ধনাঢ্য ব্যক্তির মতো চার্টার্ড বিমানে করে বিদেশ পাড়ি জমাতে। সব প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, যেখানেই থাকুক না কেন। তবে বিদেশ পাড়ি জমালে আজ হয়তো করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ দাফন হতো না বাবা মোহন মিয়ার পাশে। মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
লেখক : সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক-বিএনপি এবং সভাপতি, এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইআরআই)।