একাত্তরের শুরু বাষট্টিতেই
হামিদ মীর
আপনি কি বিশ্বাস করবেন, পাকিস্তানের একজন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ১৯৬২ সালে তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, পাকিস্তান ভেঙে গেছে? জি হ্যাঁ, জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ল সরকারের বাঙালি আইনমন্ত্রী জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিমের ‘ উরধৎরবং ড়ভ ঔঁংঃরপব গঁযধসসধফ ওনৎধযরস (১৯৬০-১৯৬৬)’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করে জানা যায় যে, পাকিস্তান ১৯৭১ সালে নয়, ১৯৬২ সালেই ভেঙে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে শুধু পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের আনুষ্ঠানিকতা হয়েছিল। জাস্টিস ইবরাহিমের ডায়েরি ও জেনারেল আইয়ুব খানের সাথে আদান-প্রদানকৃত পত্রাবলিসংবলিত এই গ্রন্থ তার কন্যা ড. সুফিয়া আহমেদ সঙ্কলন করেন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান। জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিমের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থটিতে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটি সংবেদনশীল প্রকৃতির গোপন দলিল দস্তাবেজও সংযুক্ত করা হয়েছে। সম্ভবত এ জন্য এ গ্রন্থটি জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিমের মৃত্যুর ৪৫ বছর পর প্রকাশ করা হয়েছে (গ্রন্থটি ঢাকার একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি ২০১১ সালে প্রকাশ করেছে-অনুবাদক)।
জাস্টিস ইবরাহিম ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খানের প্রথম ক্যাবিনেটে আইনমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬২ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল আইন নিয়ে আইয়ুব খানের সাথে তার দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন। তার ধারণা ছিল, প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার অনুভূতি বৃদ্ধি করবে। তিনি আইনমন্ত্রী হিসেবে যে আইনি প্রস্তাব পেশ করলেন, তা প্রত্যাখ্যান করা হলো। ১৯৬১ সালের নভেম্বরের পর তিনি ক্যাবিনেটের বৈঠকগুলোতে অংশ নেয়া বন্ধ করে দেন। জেনারেল আইয়ুব খান তাকে রাজি করানোর জন্য অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ শোয়াইব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং হাশেম রেজাকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম তাদের সবাইকে জবাব দেন, ‘আমি পাকিস্তান ধ্বংসের আইনি পরিকল্পনায় শরিক হতে পারব না।’ ক্যাবিনেটের অপর তিন বাঙালি মন্ত্রী হাফিজুর রহমান, হাবিবুর রহমান এবং এ কে খানও জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিমের অবস্থানকে সমর্থন করতেন। তবে তারা কখনো পদত্যাগের হুমকি দেননি। ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে করাচিতে গ্রেফতার করা হলে ৫ ফেব্রুয়ারি জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বলেন, সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতার একটি ‘ব¬ান্ডার’, মারাত্মক ভুল। কিন্তু আইয়ুব এ কথায় একমত হলেন না।
তিনি বললেন, আমি তাকে ঢাকার পরিবর্তে করাচিতে গ্রেফতার করেছি। যাতে গণপ্রতিক্রিয়া বেশি না হয়। জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম তার ডায়েরিতে লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানও জানতেন, তার প্রেসিডেন্সিয়াল আইনের বিপরীতে কঠোর বিক্ষোভ হবে এবং অবশ্যম্ভাবী বিক্ষোভ দমনের জন্য তিনি এক জালিম স্বৈরশাসকরূপে মানুষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিচ্ছেন। স্বীয় ডায়েরিতে এ কথাগুলোর লেখক দরদি ব্যক্তি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
সোহরাওয়ার্দীকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে কারাগারে পাঠানোর পর জেনারেল আইয়ুব খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তনে ভাষণ দানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান পৌঁছেন, যেখানে তাকে ডক্টরেটের সম্মানজনক ডিগ্রি দেয়ার কথা। জাস্টিস ইবরাহিম তার ডায়েরিতে লিখেছেন, জেনারেল আইয়ুব খান ঢাকা পৌঁছা মাত্রই পুরো পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির জন্য বিক্ষোভ শুরু করে দেয়। গ্রন্থটির ১৪০ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ছাত্ররা পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিল। এই সময় জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম জেনারেল আইয়ুব খানের সাথে ঢাকায় সাক্ষাৎ করে নিজের পদত্যাগের প্রস্তাব পেশ করেন।
সামরিক প্রেসিডেন্ট তার আইনমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধা দেন। ধারণা করা হচ্ছিল, তিনি পাকিস্তানি জনগণের ওপর প্রেসিডেন্সিয়াল আইন চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পরিত্যাগ করবেন। কিন্তু যখন ওই আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা হলো, তখন প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল আজম খান, এরপর আইনমন্ত্রী জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম মন্ত্রীপদ থেকে পদত্যাগ করেন। সরকার বিবৃতির মাধ্যমে গণমাধ্যমকে জানায়, ‘আইনমন্ত্রী অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করেছেন।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম জেনারেল আইয়ুব খানকে পত্র লিখলেন যে, তিনি তার পদত্যাগপত্রে ১৯৬২ সালের আইন প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর তিনি পদত্যাগপত্রের অনুলিপি গণমাধ্যমকে দিতে চান। সেনাশাসক জবাবে জাস্টিস ইবরাহিমকে এমন ধরনের কোনো পদক্ষেপের কারণে ‘কঠিন’ দুর্ভোগের হুমকি দেন।
গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে অনুভব হয় যে, মারাত্মক ধরনের মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম কোনো আইনি ধারা ও চারিত্রিক রীতি ভঙ্গ করেননি। তবে জেনারেল আইয়ুব ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেন। যদি টুইটের যুগ হতো, তাহলে জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিম একটি ছোট্ট টুইট করতেন, ‘আমি ১৯৬২ সালের আইন প্রত্যাখ্যান করছি।’ এরপর তিনি চুপ হয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি টুইটের নয়, টেলিগ্রাম ও টেলিফোনের যুগে বাস করতেন। তিনি জেনারেল আইয়ুব খানের হুমকিমিশ্রিত পত্রের জবাবে চার পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ পত্র লিখেন এবং তার যুগের ‘গডফাদার’-এর হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের অধিকারের জন্য লড়াই করেছি। কেননা পাকিস্তানের সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক।’
আইয়ুব খান জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিমের স্থলে সাবেক চিফ জাস্টিস জাস্টিস মুহাম্মদ মুনীরকে তার নতুন আইনমন্ত্রী বানান। লাহোরের অধিবাসী এই বিচারপতি গণতন্ত্র হত্যাকে বৈধ আখ্যায়িত করতে প্রয়োজনীয় ‘যুক্তি’ তৈরি করেছিলেন। তিনি আইনমন্ত্রী হয়েই কায়েদে আজমের পাকিস্তানকে হত্যা করার একটি বিধিবদ্ধ ঘোষণার প্রস্তুতি শুরু করেন। জাস্টিস মুনীর তার ‘ফ্রম জিন্নাহ টু জিয়া’ গ্রন্থে স্বীকার করেছেন যে, তিনি আইনমন্ত্রী হওয়ার পর জেনারেল আইয়ুব খানের পরামর্শে ১৯৬২ সালের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বাঙালি সদস্যদের সাথে আলাদা হওয়া বা কনফেডারেশনের জন্য যথারীতি আলোচনা করেন। কিন্তু অ্যাসেম্বলির অন্যতম বাঙালি সদস্য রমিজউদ্দিন তাকে এ কথা বলে চুপ করিয়ে দেন, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আমরা পাকিস্তান। সুতরাং পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠরা নয়, সংখ্যালঘুদের করতে হবে।
পরিশেষে, ১৯৭১ সালে এই সংখ্যাগরিষ্ঠরা লড়াই করে সংখ্যালঘুদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন।
জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিমের স্মৃতিচারণে বারবার জেনারেল আইয়ুবসহ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর এ কে ফজলুল হকের আলোচনা এসেছে। এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। আর সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৬ সালে ‘দিলি¬ প্রস্তাব’ পেশ করেছিলেন যার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্র বানানো হয়। জেনারেল আইয়ুব খান শুধু সোহরাওয়ার্দী নয়, ফাতেমা জিন্নাহকেও বিশ্বাসঘাতক অভিহিত করেন। সোহরাওয়ার্দী ও ফাতেমা জিন্নাহকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ অভিহিতকারী আইয়ুব খানের নামে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি পার্ক রয়েছে। ওই আইয়ুব পার্কের কাছেই রয়েছে ফাতেমা জিন্নাহ উইমেন ইউনিভার্সিটি। আর কয়েক কিলোমিটার দূরে ইসলামাবাদে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং এ কে ফজলুল হক রোডও রয়েছে।
১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ফাতেমা জিন্নাহকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাইয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একে অপরের থেকে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্কের অনেক বন্ধনে জড়িয়ে আছে। ১৯৬২ সালের প্রেসিডেন্টব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার পর পাকিস্তানে ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টারি আইন চলছে। কিছু মানুষ পাকিস্তানকে প্রেসিডেন্টশাসিত ব্যবস্থার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তাদের মধ্যে সাবেক চিফ জাস্টিস ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরী শীর্ষ তালিকায় রয়েছেন। তাদের সবার জাস্টিস মুহাম্মদ ইবরাহিমের গ্রন্থ পাঠ করা উচিত।
দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
যশোরের তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা
অধ্যাপক মো: মসিউল আযম
বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে দেশবাসী তথা যশোরবাসীর কাছে এটা বিশেষ স্মরণীয় দিন। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক তুমুল ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল চৌগাছা সীমান্তের জগনাথপুর গ্রামের মাঠে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়। তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটে। দেশে প্রথম শত্রুমুক্ত হলো যশোর জেলার চৌগাছা। তাই এই দিনটি জাতির ইতিহাসে বড় গৌরবের দিন। স্বাধীনতার পর এই গ্রামের নামকরণ করা হয় মুক্তিনগর। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রামেরই ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে আলতাফ হোসেন শহীদ হন এই জগন্নাথপুরের যুদ্ধে।
শহীদ আলতাফ হোসেন সরদার ১৯৫২ সালের ১৮ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ও মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। বড় ভাই আমীর হামজা (৭২) এই শহীদ পরিবারের হাল ধরেছেন। শহীদ আলতাফ চুড়ামনকাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরে হাইস্কুল থেকে ১৯৬৯ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশের পর ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে যান এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে উচ্চ প্রশিক্ষণ নেন বিহারের চাকুলিয়া সেনানিবাস ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। স্কুল জীবনে আলতাফ ছিলেন কৃতী ফুটবল খেলোয়াড়। হা-ডু-ডু খেলাতেও তার জুড়ি ছিল না। একটি মজার গল্প শোনান বড় ভাই আমীর হামজা। বাড়ির পাশেই চুড়ামনকাটি হাইস্কুলের বিরাট খেলার মাঠ।
মাঠে ছেলেরা খেলায় মশগুল। এই সময় পার্শ্ববর্তী সেনানিবাস থেকে কয়েকজন পাঞ্জাবি কুস্তিগীর সেনা মাঠে মহড়া দিতে আসে। এদের একজন বাঙালি ছেলেদের প্রস্তাব দেয় তার সাথে কুস্তি লড়তে। তার বিশাল চেহারা দেখে ভয়ে কেউ রাজি হয়নি। কিন্তু আলতাফ লড়তে চাইলেন। বড় ভাই তাকে নিষেধ করলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। তাদের কুস্তি খেলা দেখতে দর্শকদের ভিড় জমে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে পাঞ্জাবি সেই কুস্তিগীরের পা উঁচুতে উঠিয়ে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন তিনি। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। ঘটনাটি তখন এলাকায় লোক মুখে রাষ্ট্র হয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল। হানাদাররা তাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। বাবা রজবালী সরদার একটি গাছি দা নিয়ে ছুটে যান প্রতিহত করতে। অবস্থা বেগতিক দেখে দৌড়ে পালিয়ে তিনি বাড়ির পাশে গোরস্থানে কবরের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন। হানাদাররা কবরখানা তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে সন্ধান পেয়ে তাকে সেই কবরের মাঝেই ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। শহীদ আলতাফ ছিলেন ১২ জন যোদ্ধার কমান্ডার। তার আরো বীরত্বের কাহিনী শোনান সহযোদ্ধা মহিউদ্দিন সরদার।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন (৬২) ১৯৭১ সালে ঢাকায় ভাই হাফিজ উদ্দীনের বাসায় থেকে ওয়েস্টা অ্যান্ড স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়তেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বড় সন্তান মাসুদুল আলম বিসিএস ক্যাডার (প্রশাসন)। বর্তমানে তিনি মেহেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে যুব শিবিরে প্রশিক্ষণে অংশ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে সীমান্তের বয়রা ক্যাম্পে ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হুদা ও মেজর আবুল মঞ্জুরের কাছ থেকে অস্ত্র গ্রহণ করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে আলতাফ ও মহিউদ্দিন দেশের অভ্যন্তরে অভিযানে অংশ নেন। এর মধ্যে মথুরাপুর বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস ও মেহেরুল¬ানগর রেলস্টেশনে অগ্নিসংযোগ উলে¬খযোগ্য। বিভিন্ন অভিযান শেষে আলতাফ ও মহিউদ্দিন দু’জনই আলতাফের খালার বাড়ি জগন্নাথপুর গ্রামে রাত্রি যাপন করছিলেন।
মিত্র বাহিনীর ৩০০ জনের একটি কোম্পানি সীমান্ত অতিক্রম করে জগন্নাথপুরে এসে জানতে পারে, গ্রামে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে। ক্যাপ্টেন তাদের কাছে প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানতে চান। দু’জনের একপর্যায়ে আদেশ দেন বেলচা দিয়ে পরিখা খননের জন্য। মাত্র ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে তারা ২টি পরিখা খনন করে ফেলেন। এতে ক্যাপ্টেন খুশি হয়ে আলতাফকে একটি এসএলআর এবং মহিউদ্দিনকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল প্রদান করেন।
২১ নভেম্বর সকাল ৭টা। ক্যাপ্টেন বাইনাকুলার দিয়ে দূরে দেখতে পান পাকিস্তানি সৈন্যরা একটি ট্যাংকের পাশে বসে নাশতা করছে। তিনি ও মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চান, সব পরিখা খনন সমাপ্ত হয়েছে কি না। মহিউদ্দিনের হাতে একটি রকেট লাঞ্চারসহ থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল কাঁধে। সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই শত্রুদের ট্যাংকে আঘাত করার ফলে ট্যাংকের চেইন বিচ্ছিন্ন হয়ে সেটি অচল হয়ে পড়ে। ওই মুহূর্তে অগণিত মর্টারের শেল এসে যুদ্ধের ময়দানে চার দিকে পড়তে থাকে।
বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট যুদ্ধরত অবস্থায় হঠাৎ একটি মর্টারের শেল এসে আলতাফের ঘাড়ে আঘাত হানে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সেখানেই শহীদ হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা! আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন সরদার (৬৭), তাকে বলা হতো ছোট আলতাফ। শহীদ আলতাফ ছিলেন দীর্ঘদেহী ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা মানুষ। শৈশবকালে সরদার গোষ্ঠীর এই দুই ছেলেকে এলাকার সবাই বলাবলি করতেন এরা দু’জন মানিকজোড়। একসাথে খেলাধুলা, স্কুলে যাওয়া, গোসল করা, সিনেমাও দেখতেন। দশম শ্রেণী পর্যন্ত একই স্কুলে সহপাঠী ছিলেন। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর গল্প করেই রাত ভোর হয়ে গেছে তাদের। দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে একই সাথে ভারতে গিয়ে টালিখোলা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প হতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। পরে বিহারের চাকুলিয়া থেকে উচ্চ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ওই সময়ে তাদের গ্রামের আরো ২৩-২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণে ছিলেন।
প্রশিক্ষণকালীন সময়ে কমান্ডার সবার বিনোদনের জন্য একদিন প্রীতি ফুটবল খেলার আয়োজন করেন। সীমান্তের এপার থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দল বনাম ছাতিয়ানতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল। ছাতিয়ানতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল ৩-১ গোলে বিজয় অর্জন করে। ওই খেলায় শহীদ আলতাফ ২ গোল ও মহিউদ্দিন ১ গোল করেন। আমৃত্যু দুই আলতাফের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। আলতাফ শহীদ হওয়ার পর অপর বন্ধু ছোট আলতাফ খুবই কান্নাকাটি করেন। যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর জগন্নাথপুর গ্রামে লাশ মাটিচাপা দিয়ে সেখানে একটি চিহ্ন রাখা হয়। যুদ্ধের সময় তার গায়ে ছিল খয়েরি রঙের সোয়েটার। এটা হয়েছিল তার দাফনের কাপড়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাস পর শহীদ আলতাফের হাড়গোড় এনে পুনঃ দাফনের ব্যবস্থা করেন। তারই সহযোদ্ধা বন্ধু আলতাফ একটি বস্তায় ভরে তা বয়ে আনেন। ছাতিয়ানতলা চুড়ামনকাটি স্কুলের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। এই মাজার নির্মাণে ইট, সিমেন্ট ও রাজমিস্ত্রির খরচ তিনি নিজে বহন করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বন্ধুত্বের প্রতি এই সম্মান, ভালোবাসা, দরদ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। স্বাধীনতার পর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশের উদ্যোগ নেন। কলেজের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে আলতাফের জীবন আত্মোৎসর্গ করায় ম্যাগাজিনে তার একটি ছবির প্রয়োজন পড়ে। কলেজ কর্তৃপক্ষ শহীদের আত্মার স্মৃতির প্রতি এটি উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ লিপিটি রচনা করেন কামরুজ্জমান আজাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারোর করুণা বা দয়ার দান নয়। শহীদ আলতাফের মতো নাম না জানা লাখো শহীদের এক সাগর রক্ত ও স্বজনহারা মা-বোনদের অশ্রু ও ইজ্জতের বিনিময়ে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বহু কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা তাই আমাদের অমূল্য সম্পদ।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী