গড়ের চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥চলতি বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে হঠাৎ করে ভিড় বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের বাজারে। বিশেষ করে চাল-ডাল-মসলাসহ কিছু অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে এক লাফে অনেক বৃদ্ধি পায় পণ্যগুলোর দামও। মূল্যবৃদ্ধির এ ধারা বছরজুড়ে চলতেই থাকে। শুধু চাল-ডালের বাজার নয়, একই পরিস্থিতি তৈরি হয় ওষুধ ও চিকিৎসা সেবায়ও, যা বাড়িয়ে দিয়েছে মূল্যস্ফীতি।
চলতি বছরের জুনে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সে হিসেবে গড় মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। তবে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।
খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতি হিসাবের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় চাল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পণ্যটির মূল্যস্ফীতি ছিল ২ শতাংশের নিচে এবং ফেব্রুয়ারিতে তা নেতিবাচক ধারায় নেমে এসেছিল। মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে চালে মূল্যস্ফীতি। জুনে পণ্যটিতে মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে উন্নীত হয়, যা জাতীয় গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
করোনাকালে মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে চিকিৎসা সেবা, ওষুধ ও চিকিৎসা পণ্য। চিকিৎসা সেবা ও পণ্যে গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে কিছু ওষুধ ও চিকিৎসা পণ্য। যার প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুন শেষে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা বেশি। সেই সঙ্গে মাসিক হিসেবে গত মে মাসের তুলনায় জুনেও কিছুটা বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। জাতীয়, শহর ও গ্রাম সব জায়গায়ই খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এ সময়। করোনার পাশাপাশি বন্যা আঘাত হানায় দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ে বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
তবে বিবিএসের জাতীয় তথ্যের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির চাপ পরিমাপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, জুনে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ডালজাতীয় শস্যে, যার পরিমাণ ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ। এর পরই মসলাজাতীয় শস্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ। চালের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে দানাদার খাদ্যশস্যে। সেখানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মধ্যে বাড়ি ভাড়া ও জ্বালানির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ শতাংশ। এভাবেই করোনাকালে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এবং কৃষি ও খাদ্য অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. এম আসাদুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, করোনাকালে বড় শহরগুলোতে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে। মূলত সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়ার কারণে খাদ্যপণ্য শহরে না আসায় এ ধরনের মূল্যস্ফীতি হয়েছে। যদিও উৎপাদন পরিস্থিতি এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক ছিল। এখনো কিছু খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি চলমান রয়েছে। এক্ষেত্রে উৎপাদন ঘাটতিই বেশি দায়ী। বিশেষ করে চাল ও দানাদার খাদ্যশস্যে বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
গত ২০১৯ সালের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডালজাতীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি সব সময়ই নেতিবাচক পর্যায়ে ছিল। ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই তা ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়। মূল্যস্ফীতির হার করোনাকালে আরো বৃদ্ধি পায়। মে মাসে ডালজাতীয় পণ্যে মূল্যস্ফীতি ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়, যদিও জুনে তা ২৯ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছে।
দানাদার খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাইনাস শতাংশীয় পয়েন্টে ছিল। অর্থাৎ এ সময়ে ধারাবাহিকভাবেই কমেছে দানাদার খাদ্যশস্যের দাম। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে এসে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৪ শতাংশে উন্নীত হয়। আর জুন শেষে তা ১২ শতাংশে দাঁড়ায়।
তবে করোনাকালে দাম কমেছে মাছ ও শুকনা মাছের। মূলত জানুয়ারি থেকেই মাছের দাম কমতির দিকে ছিল। ফলে এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি এ মাসের পর থেকেই মাইনাস ৮-৯ শতাংশের মধ্যেই ওঠানামা করে। যদিও জুন শেষে তা মাইনাস ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। অন্যদিকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সবজির দাম কমতির দিকে ছিল। ফলে মূল্যস্ফীতি মে মাস পর্যন্ত ঋণাত্মক মানে ছিল। যদিও জুনে তা প্রায় ৬ শতাংশে উন্নীত হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে বন্যা উৎপাদনে এক ধরনের বাধা সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি বাড়তি চাহিদার কারণে পণ্যের দামে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ছিল। সরকারের সঠিক পদক্ষেপের কারণে কিছু পণ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়লেও সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তবে ডিসেম্বরের পর মূল্যস্ফীতি আরো কমে যাবে। যদিও অন্যবারের চেয়ে তা কিছুটা বেশি থাকতে পারে। মূলত চালের দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চলমান থাকলেও আমদানি চাল দেশে এলে তা আরো কমে যাবে। ফলে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই স্বাভাবিক হবে ডিসেম্বরের পর।
চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে বন্যা ও করোনা সেটি বাড়িয়ে দিয়েছে। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুনে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, যা মে মাসে ছিল ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ, যা মে মাসে ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ, যা মে মাসে ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
করোনাকালে বিশেষ কিছু পণ্যের বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণে চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি পরিমাপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভার দেয়া হচ্ছে চালে। অথচ সেই চালের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। একটি পণ্যের মাধ্যমেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি প্রভাবিত হতে পারে। বেশকিছু খাদ্যদ্রব্যের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী। তাই অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ থাকবে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় থাকতে পারে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হলে খাদ্যপণ্যের, বিশেষ করে চালের দাম কমিয়ে আনতে হবে। সেই চাপ কমানোর কৌশল হতে পারে চাল আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো।