দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস : বাধ্য হয়ে টিসিবি’র লাইনে তারা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না নিত্যপণ্যের দামে। বাজারে চাল, পিয়াজ, আলুসহ অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম এখনো চড়া। দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। করোনাকালে এমনিতেই অনেকের আয়ে ভাটা পড়েছে। থেমে গেছে কারো কারো রোজগারের পথও। এমন সংকটকালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে দিশাহারা মানুষ। তাই বাধ্য হয়ে কম মূল্যে পণ্য কিনতে টিসিবি’র ট্রাকসেলে ভিড় করছেন তারা। কয়েকদিন আগে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিলেন, শীতের সবজি বাজারে আসা শুরু হলে আলু, পিয়াজসহ সব ধরনের সবজির দাম কমবে।
তবে ইতিমধ্যেই বাজারে শীতের সবজির দেখা মিললেও আগের মতোই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। ওদিকে আলুর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকার পণ্যটির দর নির্ধারণ করে দিলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। এখনো বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। বরং সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে আরো ৫-৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গতকাল কাওরান বাজারে পাইকারি আড়তে গিয়ে দেখা যায়, আড়তদাররা আলুর পাইকারি দর কেজিতে ৩০ টাকা লিখে রাখলেও মূলত মান ভেদে তা ৩৫ থেকে ৩৭ টাকায় বিক্রি করছেন। যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে। তবে দর নির্ধারণ করে দেয়ার পর পাইকারিতে কয়েকদিন ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যদিও খুচরা বাজারে ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও এ দামে কেউ আলু বিক্রি করেনি। কাওরান বাজারে বিক্রমপুর আলুর আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. সবুজ জানান, দ্বিতীয় দফায় সরকার আলুর দর নির্ধারণ করে দেয়ার পর দুই একদিন ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন এটা কেউ মানে না। ৩০ টাকা লিখে রাখা হয়েছে যাতে অভিযানে এসে জরিমানা না করতে পারে। কিন্তু এই দামে কোনো ব্যবসায়ী আলু বিক্রি করছে না। আমি মান ভেদে ৩৫-৩৭ টাকা দরে বিক্রি করছি।
ওদিকে পিয়াজের দামেও লাগাম টানা যায়নি। খুচরা বাজারে দেশি পিয়াজের কেজি এখনো ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। পিয়াজ বিক্রেতারা জানান, পিয়াজের দাম কমাতে হলে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে। দেশি পিয়াজ আসতে দেরি আছে। তবে এক দুই মাসের মধ্যে গাছসহ পিয়াজ বাজারে আসতে পারে। তখন হয়তো দাম কমতে পারে। আর দেশি পিয়াজ বাজারে পুরোদমে না আসলে দাম কমার সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, দাম যে বাড়ার পরও আমদানি করা পিয়াজ মানুষ নিতে চায় না। তারা দেশি খাবে। কারণ দেশি পিয়াজে স্বাদ বেশি। সুতরাং আমদানি যতোই হোক দেশি পিয়াজ বাজারে পর্যাপ্ত না আসলে দাম কমবে না। এদিকে রাজধানীর সবজির বাজার এখনো চড়া। শীতের সবজি সরবরাহ শুরু হয়েছে। কিন্তু দাম কমেনি। অথচ ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, শীতের সবজি বাজারে আসা শুরু হলে পিয়াজ, আলু সহ সব সবজির দাম কমে আসবে। কারণ গত বন্যায় প্রচুর সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সরবারহ কমে যায়। এতে দাম বৃদ্ধি পায়। আর সবজির বাড়তি দামের প্রভাবেই আলুর দামও হঠাৎ বেড়ে গেছে। তবে এখন শীতের সবজি বাজারে ওঠা শুরু হলেও দাম কমার লক্ষণ নেই। বরং পর্যাপ্ত সরবরাহের পরও রাজধানীর খুচরা বাজারে অনেক সবজি কেজিতে ১০০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে এসব নিত্যপণ্য ক্রয়ে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠেছে। গতকাল কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, ছোট ছোট ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিস ৩০ থেকে ৫০ টাকা। আর শিমের কেজি সেই আগের দামেই চলছে। কেজি প্রতি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। নতুন আলু কেজি প্রতি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, বেগুন, গাজর, মুলা ও বরবটির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ১০০ টাকা। কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, শসা, ঝিঙে, ঢেঁড়স ও পটলের দামও কম নয়, ৬০ থেকে ৮০। প্রতি আড়াইশ’ গ্রাম কাঁচা মরিচের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা।
দেশে চালের বাজার এখনো ঊর্ধ্বমুখি। সমপ্রতি মিলারদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরও চালের দাম কমেনি। বরং সপ্তাহের ব্যবধানে আবারো বাড়তে শুরু করেছে। এখন প্রতি কেজি নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬৭ টাকায়, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৬৪ টাকা। বিআর-২৮ বিক্রি সর্বোচ্চ ৫৬, যা আগে ছিল ৫৪ টাকা কেজি। এছাড়া মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৫, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল কেজি ৪৩-৪৪ টাকা। অস্থিরতা রয়েছে ময়দার দামেও। সপ্তাহের ব্যবধানে ময়দার দাম কেজিতে ৩ টাকা বেড়েছে। ভোজ্যতেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ১০ টাকা বেড়েছে। তাছাড়া ডাল, দারুচিনি, ধনেপাতা ও তেজপাতা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে এসব ভোগ্যপণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা। বাধ্য হয়ে তাই ভিড় করছেন টিসিবি’র ট্রাকসেলে। ওদিকে সরজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিনই কম মূল্যে চাল, আলু, পিয়াজসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য কিনতে টিসিবি’র ট্রাকসেলে ভিড় করছেন অনেক মানুষ। রাজধানীর মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচে শতাধিক লোকের জটলা দেখা যায়। পাশেই টিসিবি’র পণ্যবাহী গাড়ি। দীর্ঘ লাইনে শতাধিক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। কারো কারো হাতে খালি ব্যাগ। দীর্ঘ লাইন থেকে একজন করে বের হচ্ছেন। অন্যদিকে লাইনের পিছনের অংশে আরেকজন করে যুক্ত হচ্ছেন। ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের ওপর অবস্থান করা কয়েকজন যুবক চিনি, মসুর ডাল, পিয়াজ ও সয়াবিন তেল পলিব্যাগে প্যাকেট করছেন। ট্রাকের পেছনে আরো ৩ ব্যক্তি সেসব পণ্য লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করছেন। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবি’র পণ্য হাতে পেয়ে খুঁশিতে আত্মহারা অনেকেই। তাদের মধ্যে ১ জন মো. জালাল উদ্দিন। স্থানীয় একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। টিবিসি’র ভ্রাম্যমাণ ট্রাকসেল থেকে পিয়াজ, তেল, চিনি ও ডাল কিনছেন। তিনি বলেন, ভাই ছবি তুইলেন না। আমি একজন শিক্ষক। অভাব অনটনে পড়ে এখানে এসেছি। প্রায় ৩০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে অতঃপর এসব পণ্য হাতে পেয়েছি। এখন অনেক খুশি লাগছে। আমার চাকরি এখনো এমপিও হয়নি। ফলে নানা কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে করোনাকালীন সময়ে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি। এর মধ্যে বাজারের সবকিছু এখন ঊর্ধ্বমুখী। বেশি দাম দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই দুপুরে লোকজনের ভিড় কম থাকে। এজন্য লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবি থেকে কিনছি। গত কয়েক মাস ধরে সপ্তাহে একদিন আমাকে এ লাইনে দাঁড়াতে হয়।
সীমান্ত নামের এক প্রাইভেট কার চালক বলেন, আমার স্যার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। স্যারকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে এখন লাইনে দাঁড়িয়েছি। স্যারের জন্য তেল, চিনি, মসুর ডাল কিনবো। আমি স্যারের বাসার নিচে ছোট একটি রুমে থাকি। তাই প্রায়ই স্যারের বাসার জন্য টিসিবি’র পণ্য কিনতে হয়। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষাপটে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিবিসি) ভোক্তাদের মাঝে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সংকট ও বাজারের অস্থিরতার কারণে টিসিবির বিক্রিয় কেন্দ্রে ভিড় করছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। বাজারে অস্থিরতার কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও দাঁড়াচ্ছেন লাইনে। এক কেজি করে পিয়াজ ও ডাল, তেলের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। রাজধানীর খামারবাড়ির টিসিবি ট্রাকের পাশে খালি ব্যাগ হাতে বসে আছেন জোসনা বেগম নামের এক বয়স্ক নারী। তিনি বলেন, আগে গরিব মানুষ টিসিবি থেকে মালামাল কিনতো। তখন রিকশাচালক ও বস্তিবাসী বেশি করে কিনতে পারতো। এখন গরিব মানুষ এখান থেকেও কিনতে পারছে না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বড় লোকেরা এখানে এসে ভিড় করে। এখন বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। তাই সবাই সস্তায় কিনতে এখানে আসে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর টিসিবি’র বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, দিনমজুর, সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকরিজীবীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এবার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিগত বছরগুলোর তুলনায় টিসিবি’র পণ্যের চাহিদা কয়েকগুণ বেশি। এ ছাড়া বাজারে সরবরাহ সংকটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম এখন বাড়তির দিকে। ফলে টিসিবি’র ন্যায্যমূল্যের পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই লাইনে লোকজন বাড়ছে কিন্তু সে তুলনায় জোগান বাড়েনি। এ কারণে ক্রেতাদের কেউ কেউ দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য কিনতে না পেরে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। মসুর ডাল প্রতি কেজি ৫০ টাকা দরে একজন ক্রেতার কাছে সর্বোচ্চ এক কেজি বিক্রি করা হয়। বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৮০ টাকা দরে সর্বোচ্চ ৫ লিটার ও চিনি ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। টিসিবি’র ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের একাধিক কর্মী জানান, আগে দরিদ্র মানুষ টিসিবি বিক্রয় কেন্দ্রে আসতো। এখন ধনী ব্যক্তিরাও টিসিবির পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়ায়। কেউ কেউ বাড়ির কেয়ারটেকার কিংবা গাড়িচালক দিয়ে আলু, পিয়াজ, ডাল ও তেল কিনে। চেহারা দেখলেই তা অনুমান করা যায়। এলাকাভিত্তিক অনেক প্রভাবশালীরাও আসে। তবে সবাইকেই লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে হয়। টিসিবি’র জনসংযোগ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির মানবজমিনকে জানান, রাজধানীর ৮০টি স্থানে টিসিবি’র পণ্য নিয়মিত বিক্রি করা হচ্ছে। সকল শ্রেণির মানুষ এসব পণ্য ক্রয় করতে পারবেন। সবাইকে লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া গত এক মাসের বেশি সময় অনলাইন মাধ্যমেও টিসিবি’র পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।