জননেতা তরিকুল ইসলামের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরন সংখ্যাার একগুচ্ছ লেখা-২

0

বন্ধু তরিকুল ইসলামের মানস গঠণের পরিপ্রেক্ষিত
ড. এ কে এম খায়রুল আলম

১. যশোরের কৃতী সন্তান ও আমাদের প্রিয়বন্ধু তরিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর । ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর তিনি ঢাকা অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি যখন ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে যাই তখন দেখি তরিকুল ইসলামের রাজনৈতিক দল বিএনপির অনেক নেতা ও কর্মী সেখানে ভিড় করে আছেন। বিএনপির সহাসচিব জনাব ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। সাতটি দশক ধরে তেজোদীপ্ত নাতিদীর্ঘ তরিকুল ইসলামের এই নির্বাক ও নিথর মরদেহ চারিদিকে শোকাবহ ও বেদনার্থ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সেখানে সেদিন সে মুহূর্তে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা প্রায় সকলে তরিকুলের জীবনের শেষার্ধের সঙ্গী সাথী। তার জীবনের ও মনন বিকাশের সৃজ্যমান প্রথম অধ্যায়ের বন্ধুদের মধ্যে তার স্ত্রী, সন্তান ও পরিজন ব্যতীত তেমন কেউ আমার নজরে পড়েনি।
আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি, ষাটের দশকে তরিকুল ইসলামের উঠতি জীবন, তার মানস গঠনের কাল । আমি তখন তার সহপাঠী । আমরা একঝাঁক সহপাঠী একটি দশকব্যাপী তখন যশোর শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের বিপ¬বের ঝড়ো হাওয়ায় উন্মাতাল সময়, সেই বিশ্ববিপ¬বের অংশীভাগী এক নতুন তরিকুল ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে।
এ সময় যশোরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ছিল ঊনিশ শতকীয় কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগৃতির ক্ষয়িঞ্চু ভাববিল্পবে কম্পমান কিন্তু বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র। শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দু-মুসলিমদের জন্য সম্মিলনী ইনস্টিটিউটশন, উচ্চবিত্ত নাগরিক ও শিক্ষিত আমলাদের জন্য জিলা স্কুল এবং গ্রামীণ ও নাপরিক নব্যমধ্যবিত্ত মুসলিমদের জন্য মুসলিম একাডেমি এবং মেয়েদের জন্য মোমিন গালর্স স্কুল (সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়)কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো যশোর এমএম কলেজ। অন্যতম ডিরোজিয়ান এবং বাংলার প্রথম আন্তর্জাতিকমনষ্ক মানুষ মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামে গৌরবান্বিত এ কলেজ। এ কলেজে বিশ্বখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা তিনটি পোট্রেট ছিল- মাইকেল মধুসূদন, কবি রবীন্দ্রনাথ ও কাজি নজরুল ইসলামের। শিক্ষক- শিক্ষার্থ্রীা মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুলের জন্ম ও প্রয়ান দিবসে এ ছবি মঞ্চসজ্জায় ব্যবহার করে অনুষ্ঠান আয়োজন করতো। এ কলেজের সবুজ বৃক্ষ ও তরুলতাগুল্মশোভিত কক্ষে শাপ ও বেজি নিয়ে শিল্পী সুলতান জীবন যাপন করতেন।শীতের সকালে সন্নাসীদের মতো লস্বা চূলের মাথা হেলিয়ে বাঁশীতে ইচ্চাঙ্গ সংগীতের সুর লহরীতে মগ্ন হতেন বিশ্ববরেণ্য শিল্পী এসএস সুলতান। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিল্প সাহিত্য,ইতিহাস দর্শ্ন বিষয়ে প্রাজ্ঞ ও সুপন্ডিত একঝাঁক শিক্ষক এ কলেজকে আলোকিত করে রাখতেন। এ কলেজকে কেন্দ্র করেই তাই ষাটের দশকের নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থ্রীা সহজেই নবযুগের জয়যাত্রা শুরু করে এবং এ কলেজকে ঘিরেই আবর্তিত হয় যশোর জেলার রাজনৈতিক. সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবন।
প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যশোর শহরের ও র্প্শ্বাবর্তী গ্রাম ও মহাকুমা শহর নড়াইল, মাপুরা ও ঝিনাইদহ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থ্রীা দলে দলে এম এম কলেজে ভর্তি হতো। এরাই এম এম কলেজে ষাটের দশকের ”নব্য ডিরোজিয়ান”। এরা স্টুয়াড্র্ মিল ও বেন্থামের যুক্তিবাদ নয়. বরং হেগেল. মার্ক্স ও এঙ্গেলস, লেনিন ও মাও সে তুং এর বিশ্ববিক্ষাস্নাত বিপ¬বীস্রোতে দীপ্যমান এক একজন জ্যোতিষ্ক। তরিকুল ইসলাম এদের মধ্যে অন্যতম। তরিকুলের জীবনাভিজ্ঞান গড়ে ওঠে ষাটের দশকের এ স্থানীয় ও বৈশ্বিক ভাববিল্পরের সরাৎসার আস্থস্ত করে।
ইতিহাসবেত্তারা বলে থাকেন যে,“বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ষাটের দশক বলতে ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ধরা যেতে পারে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে গণতন্ত্রের সকল সম্ভাবনাকেই রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সেটা ছিল শাসক শ্রেণির দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ। শুধু পাকিস্তানের শাসক শ্রেণিরই নয় এর পেছনে মদদ দাতা ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ষাটের দশকটি ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে তীব্র আক্রমনের সময়কাল। দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা করে মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা দেশের ধন সম্পদ লুণ্ঠন করা তাদের রণনীতির অংশ ছিল। পাকিস্তানও এ ধ্বংসযজ্ঞের শিকারে পরিণত হয়। এ দেশের নিপীড়িত মানুষও পাক-সামরিক শাসন-শোষণ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হয়। যশোরের প্রগতিশীল রাজনীতিক ও শিক্ষাথীরা এ আন্দোলনে আন্দোলিত ও ক্ষুদ্ধ অংশগ্রহণ করেন। ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৮-র সামরিক অভ্যুত্থান বিরোধী গণঅসন্তোষ , ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন এবং ৬৯-এর ১১দফা আন্দোলন সম্মিলিতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে রুপান্তির হয়।
যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ১৯৫৯ ও ১৯৬০-৬৩ সালে কলেজে তর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা এ ভাব-আন্দোলনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র রাজনীতিতে এ সময় আব্দুর রাজ্জাক খান, সৈয়দ আফজাল হোসেন, কাজী শহীদ, সৈয়দ আকরম হোসেন, সেলিমুল আযম, নুরুল ইসলাম,মাহমুদুর রহমান,আবদুল মতিন, রজব আলী প্রমুখ এবং সাংস্কৃতিক জগৎ আলোকিত করেন, সৈয়দ আকরম হোসেন, অশোক ঘোষ, বীথিকা ঘোষ , সুলতা ঘোষ , শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদ, মোহাম্মদ রফিক উজ্জামান প্রমুখ।অনেকের নাম আজ আমার মনে নেই।তবে একঝাঁক নক্ষত্রের মতো পুরাতন মাইকেল মধুসূদন কলেজের মামনে রাতের আলোকোজ্জল সঞ্চের উপস্থিতি এখনো আমার চোখে ভাসে। জলদগম্ভীরকন্ঠে যেন কেউ আবৃত্তি করছেন,‘ সন্যাসী উপগুপ্ত, মথুরাপুরের প্রাচীরের ধারে একদা ছিলেন সুপ্ত’ ‘আমি বর দিনু দেবী তুমি সুখী হবে , ভুলে যাবে সব্র্ গ¬ানি বিপুল গৌরবে”, অথবা উচ্চকিত স্বরে উন্মাতাল কোরাস ,” শুনছি শুনছি আমরা শুনছি! রুখে দাঁড়িয়েছে আফ্রো-এশিয়া ল্যাটিন আমেরিকা” অথবা ক্যাম্পাস ও রাজপথ কাঁপিয়ে কেউ ¯ে¬াগানে উন্মাতাল হচ্ছে,”দুনিয়ার মজদুর এক হও! মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক”! এই ছিল ষাটের দশকে যশোরের চালচিত্র। তরিকুল ইসলামসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবান্দোলনে বিশ্বাসী এ দশকের এক ঝাঁক তাজা প্রাণ এ সময় প্রতিনিধিত্ব করেছে যশোরের। মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুল এবং তিরিশোত্তর জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব-সুধীন্দ্র দত্তের কবিতা. নাট্য এবং সংগীত পুরাতন কলেজের চেরিবৃক্ষের ফুলেল শাখায় এখনো যেন দোলা দেয়।
পাকিস্তানের বাম আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদপুরুষ আব্দুল হকের বাড়ি যশোরে হওয়ায় এ বাস্তবতা এ কলেজের ছাত্রশিক্ষকদের মার্কসীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়ন কালেই আমাদের হাতে এসে পড়ে এঙ্গেলস এর ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি,পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’, নিহার রায়ের লেখা ‘ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, এমন কি সাড়া জাগানো কমিউনিষ্ট পার্টির ইশতেহার’. ইত্যাদি দুনিয়া কাপানো সব সাহিত্য।প্রফেসর আজীজুল হক ও প্রফেসর শরীফ হোসেনের কল্যাণে হাতের কাছেই আমরা পেয়েছি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দেশীয় জনসানুষসম্পৃক্ত ও গণমানুষের অস্তিস্ত রক্ষার লড়াইয়ে সংক্ষুব্ধ ও রক্তাক্ত মানুষের দলিল সব বিশ্বসাহিত্য।
ইতিহাসের এ কালপরিসরে তরিকুল ইসলাম ১৯৬১ সালে যশোর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ঊত্তীণ হয়ে যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সুজল পুর থেকে নূর মোহাম্মদ,সাত নম্বর দেওড়া ইউনিয়নের ছিলুম পুর থেকে খায়রুল আলম, নড়াইল রোডের ছাতিয়ান তলা থেকে আমজাদ হোসেন, লেবুতলা থেকে শরিফুল ইসলাম, শেখহাটি থেকে মান্নান,খড়কি থেকে মোহাম্মদ রফিক উজ্জামান, যশোর শহর থেকে কাজি নজমুস সাদাত. আবদুল জলিল, আতিয়ার রহমান,খালেদুর রহমান টিটো, শহরের ঘোপ থেকে তরিকুল ইসলাম, নার্গিস বেগম, পুরাতন কসবা থেকে মাহবুবুর রহসান খোকন প্রমুখ। এ ছাড়া শাহ মোহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ, রাজিয়া ইমাম, এনামুল হক,অসংখ্য তরুণ তাজা প্রাণের মেলায় কুখরিত হলো কলেজ প্রাংগণ ও ষশোর পাবলিক লাইব্রেরি। যশোরের মানুষের আধুনিক ভাব ও বৈপ¬বিক মানস গঠনে যশোর এম এম কলেজ, বি সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ এবং যশোর পাবলিক লাইব্রেরির ভূমিকা অপরিসীম। গ্রন্থাগারটি ছিল দেশি ও বিদেশি গ্রন্থে ঠাঁসা।রুশ, ফরাসি, ইংরেজি ও জার্মান সাহিত্যের ভারতীয় ও সোভিয়েত অনুবাদ গ্রন্থের ভান্ডারকে করে সমৃদ্ধ।ষাটের দশকে আমাদের সব থেকে বড় বিনোদন ছিল পঠন, লিখন ও আন্দোলন। এ গ্রন্থাগারে রক্ষিত প্রায় সব সৃজনশীল সাহিত্য আমরা পড়েছি। রচনা করেছি কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটক। মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে কিংবা অমর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরাই গীতিনাট্য ও গীতি নকসা রচনা করেছি। উপস্থাপক, গায়ক, অভিনেতা এবং পরিচালক আমরাই। শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদ,সোহরাব হোসেন,আজমলা বেগম, আশরাফ হোসেন সংগীতে আর আবৃতিতে মোহাম্মদ রফিক উজ্জামান ,রাজিয়া ইমাম, রেহেনা ইমাম, তরিকুল ইসলাম ও নার্গিস বেগম অংশ নিতেন। এ সত্য অনস্বীকায্র্ যে, ১৯৬১ সাল থেকে পুরো ষাটের দশক জুড়ে বিশ্বব্যাপী আথ্র্-সামাজিক-রাজনিতিক-সাংস্কৃতিক যে ভাবাদশ্র্ ও ভাববিল্পব সংঘটিত হয় তার তপ্তহাওয়া যশোরেও প্রবাহিত হয়। এ ভাববিল্পবের আগুনে তরিকুল ইসলামও পরিশুদ্ধ ও শক্তিমান হয়ে ওঠেন। তিনি ইতহাসজ্ঞান ও কালচেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ছাত্র আন্দোলনের প্রগতিশীল ধারায় যোগদান করেন। এক পর্যায়ে তিনি প্রগতিশীল ধারার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের জেলা ও কেন্দ্রীয় গর্যায়ের নেতৃত্ব পরিচালনায় অংশ নেন। এ পর্যায়ে যশোর কলেজের ছাত্র সংসদের জি এস নির্বাচিত হন। এ ভাবে তার রাজনীতি ও সংস্কৃতি উভয় ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও সৃজনশীলতা বিস্তৃত হতে থাকে।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও শিক্ষার অধিকার এবং বিশেষ করে পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির স্বার্থে প্রণীত গণবিরোধী সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল, আধুনিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় ঐতিহাসিক গৌরবময় ছাত্র আন্দোলন। পরবর্তীকালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছিল। এ আন্দোলনে ও মুক্তিসংগ্রামেও তরিকুল ইসলামের সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৯ সালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ঐক্যে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষিত হয়।১১ দফা ঘোষিত হওয়ার পরপরই ৯ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও মোজাফফর ন্যাপসহ আটটি রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ডেমোক্রাটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক)। তারা ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দাবি করে এবং দাবিগুলো বাস্তবায়নের পক্ষে গণআন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ‘ডাক’ভুক্ত উগ্র ডানপন্থি কয়েকটি সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির দেওয়া ১১ দফা কর্মসূচিকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের সকল এলাকায় স্বাধীনতার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান গড়ে ওঠে। এই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ। পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবিলার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু শত্রু সেনারা সংখ্যায় অনেক ও তারা ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, তাই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়। শীঘ্রই দেশের বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন মুক্তিসংগ্রামীদের একটি একক কমান্ডের অধীনে আনা হয়। তরিকুল ইসলামও ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
এখানেই তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
২.
এর পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বৃহত্তর জাতীয় রাজনীতিতে তরিকুলের ব্যতিক্রমী পথচলা। সূচনা হয় তার জীবনের দ্বিতীয় পর্বের । এমপি ও মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। যশোরের ঘেরা টোপ থেকে বেরিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে দীপ্ত পদচারণা শুরু হয়। তার জীবনের এ দুটি পর্ব সমান্তরাল ভাবে চলেনি, তার জীবন ছিল তরঙ্গসংক্ষুব্ধ ও দ্বন্দ্বমুখর। ষাটের দশকে যেমন তার জীবন ছিল মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষায় স্নাত হওয়ার মধ্যবিত্ত সংকটে দ্বিধান্বিত তেমনি সত্তর, আশি , নব্বই ও একবিংশ শতকের ক্ষমতার রাজনীতিতে সমৃদ্ধ তরিকুল ছিল অন্তর্দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত। তবে দুটি অধ্যায়ই তরিকুল ছিলেন জনমানুষসম্পৃক্ত,জনকল্যাণকামী ও বৈচিত্রময় জীবন-অভিসারী। তার জীবনের দুটি পব্ এ ছোট নিবদ্ধে ধারণ করা সদ্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র গবেষণা।
লেখক: প্রফেসর, গবেষক, সহপাঠী, বন্ধু

আমার স্মৃতিতে তরিকুল ইসলাম
একরাম-উদ-দ্দৌলা

মানুষের জীবনে ঘটনাবহুল স্মৃতির অভাব নেই। তবে একজন মানুষকে নিয়ে কখনো মধুর,আবার কখনো মান-অভিমান বেদনাবিধূর স্মৃতি মনে রাখার মত। আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছেন যে মানুষটি তিনি হলেন, রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে ও প্রগতিশীল চিন্তার একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব,সফল রাজনীতিক, সমাজসেবক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তরিকুল ইসলাম। যার সাথে ছিলো না আমার রাজনৈতিক আদর্শের মিল। তবুও সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তাঁর সাথে গড়ে উঠেছিল সখ্যতা। একাধারে তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক, বন্ধু ও সুহৃদ।
তরিকুল ইসলামের যখন রাজনৈতিক উত্থান শুরু তখন যশোরে এত সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের আধিক্য ছিল না। আমরা হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক এ পেশার সাথে যুক্ত ছিলাম। সে কারণে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে পেশার স্বার্থে তাঁর সাথে আমার সখ্যতা ও সম্পর্ক। একসময় সম্পর্ক গড়ায় বন্ধুত্বের ন্যায়। আমার পরিণয় সূত্রে তখন আমার বাসা ছিল ঘোপে তরিকুল ইসলামের বাসার কাছে। ফলে প্রায় সময়ই তার সাথে দেখা ও ভাবের আদান প্রদান হত। গণকণ্ঠ বন্ধ হলে ঢাকা থেকে যশোর ফিরেছি পুরাতন কর্মস্থল দৈনিক ঠিকানায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। তখন তরিকুল ইসলামও তাঁর নতুন দল বিএনপিতে বেশ ডাকসাইটে নেতা হয়ে উঠেছেন। ফলে ঘোপে থাকা ও স্থানীয় পত্রিকার কর্ণধার হিসেবে আস্তে আস্তে বেড়ে যায় সখ্যতার পরিধি। ফলে প্রায় সময়ে সকালে প্রাতরাশ একসাথেই হত। নিয়ে যেতেন তার কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সংবাদ পরিবেশনের জন্য। একজন রাজনৈতিক নেতা তৈরির ক্ষেত্রে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তরিকুল ইসলামের ক্ষেত্রে দৈনিক ঠিকানার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আর সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায় আমার কারণে।
তরিকুল ইসলামের শ্বশুর আমাদের অগ্রজ আব্দুল হাসিব ছিলেন একজন সাংবাদিক। একসময় যশোর থেকে প্রকাশিত হত সাপ্তাহিক সমীক্ষা সমাচার। তিনি ছিলেন ওই পত্রিকার সম্পাদক। পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে আমার সম্পাদনা ও প্রকাশনার অনুমতি মেলে দৈনিক কল্যাণ-এর। অফিস নিলাম প্রকাশনা শুরু করবো। কিন্তু যাদের নিয়ে প্রকাশনার কাজ শুরু করবো তারা বসবে কিভাবে। এগিয়ে এলেন তরিকুল ইসলাম। সমীক্ষা সমাচারের সকল আসবাবপত্র দিয়ে দিলেন দৈনিক কল্যাণকে। ১৯৮৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হলো আমার রাজনৈতিক গুরু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শহীদ মোশাররফ হোসেনের বাসভবনের নিচতলা থেকে একঝাঁক তরুণ সাংবাদিকদের সমন্বয়ে দৈনিক কল্যাণ-এর পথচলা। আর এর ফলে আরো ঘনিষ্ঠতা বাড়লো তরিকুল ইসলামের সাথে।
প্রায় প্রতিদিনই প্রকাশিত হতে থাকলো তরিকুল ইসলামের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের খবর। প্রতিদিন দেখা না হলেও একবার কথা হত। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তরিকুল ইসলামকে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে অনেক কাছ থেকে। বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন তরিকুল ইসলাম। তাঁর মধ্যে ছিলো মানবিক মূল্যবোধটা বেশি। গোপনে অনেক মানুষকে তিনি সাহায্য সহযোগিতা করতেন। আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগের কথা। আমার বড় মেয়ের বিয়ে। তরিকুল ইসলাম তখন সপরিবারে হজব্রত পালন করার জন্য পবিত্র মক্কায়। জানতেন আমার আর্থিক সংগতির কথা। দলীয় নেতাদের কাছে শুনেছেন আমার মেয়ের বিয়ের খবর। ওখানে বসেই ভালো অংকের একটি অর্থ আমাকে দেলোয়ার হোসেন খোকনের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে ওকে বলে দিয়েছিলেন একরাম কিন্তু খুব অভিমানী ছেলে হয়তো নিতে চাইবে না। তবুও তুমি ওকে বলবে বড়ভাই হিসেবে মেয়ের বিয়ের উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। যেটা আমৃত্যু আমার মনে থাকবে।
শুধু তাই নয়, ১৯৮৪ সালের কোনো একদিন দুপুরে কি কাজের জন্য যেন আমার বাসায় লোক পাঠালেন। বাসা থেকে জানালো বাসায় নেই পাশে ফুপা শ্বশুর বাড়ি গেছে টিভি দেখতে। তখন টারজান সিরিজটা বেশ জনপ্রিয় ছিল। আর এটা দেখতে দেখতে আমার নেশা ধরে গিয়েছিল। দুদিন পরে দেখি চৌরাস্তার পিপলস রেডিও টিভি দোকানের লোক আমার বাসায় ১৭ ইঞ্চি সাদা কালো ফিলিপস টিভি নিয়ে হাজির। তখন রঙিন টিভির আধিক্য ছিল না। ওদেরকে না বলা বা টিভি ফিরিয়ে দেয়ার সাহস হয়নি। তখন কম বেতনে ঠিকানায় নির্বাহী সম্পাদক। টিভি কেনার সামর্থ ছিলো না। যেটার অভাব পূরণ করেছিলেন তরিকুল ভাই। তাই কেন জানি না তার ওপর আমি কিছুটা দুর্বল ছিলাম।
রাজনীতি করতে গিয়ে তরিকুল ইসলামকে অনেক জেল-জুলুম, নিপীড়ন ভোগ করতে হয়েছে। যা কিনা আমার দৃষ্টিতে অন্যায় ভাবে। তরিকুল ইসলাম আমাকে অনেকটা নির্ভর করতেন। যার ফলশ্রুতিতে আমার বাসা নিরাপদ মনে করতেন রাজনৈতিক আশ্রয় হিসেবে। জানতেন পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে অন্তত আমার বাসায় পুলিশি অভিযান হবে না। তখন এরশাদের স্বৈরশাসন চলছে। তরিকুল ইসলাম পা ভেঙে অসুস্থ। হঠাৎ আঁচ করতে পেরেছেন রাতে গ্রেফতার হতে পারেন। রাত তখন ১২টা। সবে অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি। একজন লোক এসে জানালো তরিকুল ভাই আপনাকে ডাকছেন। কাছাকাছিই বাসা। দ্রুত ছুটলাম। পৌঁছালাম তরিকুল ভাইয়ের বাসায়। বললেন আঁচ করছি গ্রেফতা হতে পারি। এদিকে পা ভাঙা। দোতলা থেকে অনেক কষ্টে ক্রাচ ও আমার ঘাড়ে ভর দিয়ে নামলেন। ওই অবস্থায় আমার বাসায় নিয়ে এলাম। আমার ভাড়া বাসা। স্ত্রীকে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য ঘরে যেতে বললাম। তরিকুল ইসলাম রাতে খুব একটা ঘুমাতেন না সেদিন বুঝলাম। নির্ঘুম রাত কাটলো আমাদের। দেশ-রাজনীতি, সমাজ নিয়ে নানা কথা হলো। ভোর রাতে তরিকুল ভাইয়ের বাসায় পুলিশি অভিযান হয়েছিল। কিন্তু আমার বাসায় থাকার কারণে ওই যাত্রা তিনি বেঁচে যান। সেই থেকে তরিকুল ইসলাম আমাকে একজন বিপদের বন্ধু হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। আর আমৃত্যু সেটা ভেবে গেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে।
অনেকে বলে থাকেন দীর্ঘদিন তো সাংবাদিকতা করছেন কিন্তু কিছুই তো করতে পারলেন না। সারাজীবন ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে গেলেন। কিন্তু ওই যে কেন জানি খুব কাছের মানুষ যখন মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন তখন দূরে সরে আসতে হয়েছে। ফলে সম্পর্কের খাতিরে ক্ষমতাবানকে দিয়ে সুফল ভোগ করতে পারিনি। এমন ঘটনা তরিকুল ভাই যখন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। আমার পত্রিকার টেলিফোন বিল বকেয়ার কারণে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু কোনদিন যাইনি তার কাছে। না যাওয়ার কারণও ছিল। শংকরপুর আমার পৈত্রিক ভিটা। তার দলের ওই এলাকার নেতাকর্মীদের কারণে আমার দুই ভাইয়ের পরিবারকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে শহরের ঘোপে ভাড়া বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। অবশ্য ওই নেতার দুই ভাই ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর আবার দুই ভাইয়ের পরিবার পৈত্রিক ভিটায় ফিরে যায়। একটু অভিমানও ছিলো। তাঁর দুজন বিশ্বস্ত সহচর সহিদুল হক চাওয়া ও স. ম. আলী কাঁচা এখন যারা বেঁচে নেই। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় আমাকে সার্কিট হাউজে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু ওই যে অভিমান। নিয়ে যেতে পারেনি। টেলিফোন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পত্রিকার প্রকাশনা চালিয়ে গেছি। আবার যখন মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় নিয়েছেন। এসেছেন আমার দপ্তরে। বুকে বুক মিলিয়ে অভিমান ভুলে পূর্বের মধুর সম্পর্কে ফিরে গেছি। যা কিনা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। তরিকুল ভাই ছিলেন সাংবাদিক বান্ধব। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে মফস্বল শহরের সাংবাদিকদের সাথে ছিল তার মধুর সম্পর্ক। তিনি তথ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময় সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড ও পত্রিকার বিজ্ঞাপনের হার বাড়িয়ে সাংবাদিকবান্ধব নেতা হিসেবে সাংবাদিকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে জেলা শহরের সংবাদপত্রগুলোকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করার মানসে বিভিন্ন দিবসে তথ্যমন্ত্রণালয় কর্তৃক বরাদ্দকৃত ক্রোড়পত্র বিতরণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল স্বীকারযোগ্য। সংবাদিক হত্যার বিচারের দাবিতেও তিনি ছিলেন সবসময়ই সোচ্চার।
প্রাণখোলা মানুষ ছিলেন তরিকুল ভাই, যারা তার সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছে একমাত্র তারাই বলতে পারে তরিকুল ইসলামের হৃদয়ে বিশালতা। তিনি মন্ত্রী হওয়ার আগে যাদের সাথে যেভাবে মিশতেন, মন্ত্রী হওয়ার পরও তাদের সাথে সেই সব স্থানে গিয়ে সময় কাটাতেন। অনেক সময় তিনি একা একাই গ্রাম গঞ্জে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতেন। গ্রামের চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে সবার খোঁজখবর নিতেন। যশোরের উন্নয়নে তাঁর অবদান অস্বীকার করা যাবে না। তাঁর আমলের উন্নয়ন আজও কালের সাক্ষী হিসাবে রয়েছে। যশোরের উন্নয়নে তরিকুল ইসলামের অবদান অপরিসীম। যশোর মেডিকেল কলেজ, যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও করোনারি কেয়ার ইউনিট, বিভাগীয় কাস্টমস অফিস, বেনাপোল স্থলবন্দর, যশোর মডেল পৌরসভার উন্নয়নে তিনি অবদান রেখেছেন। জননেতা তরিকুল ইসলাম নিজস্ব পত্রিকা লোকসমাজ প্রকাশ করলেও পূর্বের ন্যায় অন্য পত্রিকায় তার কর্মকান্ডের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে কল্যাণকে প্রাধান্য দিতেন বস্তুনিষ্ঠতার কারণে। একজন পত্রিকাসেবি হিসেবে আমার প্রেস ক্লাবে সভাপতি হবার পেছনে তার অবদান ছিল।
খাপছাড়া লেখার পরিধি আর না বাড়িয়ে এইটুকুই বলা যায়, নিন্দুকেরা তরিকুল ইসলাম সম্পর্কে যে যাই বলুক না কেন আমার দৃষ্টিতে তরিকুল ইসলাম ছিলেন একজন জনদরদী, পরোপকারী, নিষ্ঠাবান, সমাজহিতৈষী রাজনীতিক। যেটা প্রমাণও হয়েছে তার মৃত্যুর পর ঈদগাহে নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল থেকে। তাকে একনজর দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে এত সাধারণ মানুষ এসেছে যা অকল্পনীয়। সকাল থেকে মানুষের ঢল নামে তরিকুল ভাই বাড়িমুখো। জনস্রোত এত বেশি ছিল যা নিয়ন্ত্রণ করতে দ্রুত বাড়ি থেকে পার্টি অফিসে না নিয়ে যশোর ঈদগাহে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও ছিল জনতার উপচেপড়া ভিড়। তরিকুল ভাইকে একনজর দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে সব বয়সের সাধারণ মানুষ উম্মাদের মতন ছুটেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুল হাতে মানুষকে রাস্তার ওপর অপেক্ষা করতে দেখেছি। রাজনৈতিক নেতার প্রতি সাধারণ মানুষের এত নিবীড় ভালোবাস বা ভক্তি শ্রদ্ধা তা তরিকুল ভাইয়ের জানাজায় যারা না এসেছে তার কোনো দিন বুঝবে না। যে দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষের সাথে তরিকুল ইসলামের কত গভীর ছিল নাড়ির টান। অনেক বয়স্ক অচল মানুষকেও আমি জানাজায় উপস্থিত থেকে কাঁদতে দেখিছি। আমার প্রায় ৫৩ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে ঈদগাহে তরিকুল ইসলামের জানাজায় দলমত নির্বিশেষে মানুষের অংশগ্রহণ অতীতে চোখে পড়েনি। যা ইতিহাস হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি যশোরবাসী তথা মানুষের ভালোবাসায় চির জাগরুক হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ধরে। পরম করুণাময় তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কল্যাণ,সভাপতি যশোর সংবাদপত্র পরিষদ ও সাবেক সভাপতি প্রেস ক্লাব যশোর।

জননেতা তরিকুল ইসলাম : একটি নাম, একটি আদর্শ
অধ্যাপক মশিউল আযম

আজ ৪ নভেম্বর, যশোরসহ দক্ষিণবঙ্গ তথা দেশবাসী গণমানুষের কাছে একটি শোকের দিন, বেদনার দিন, স্বজন হারানোর দিন। গত ২০১৮ সালের এ দিনে দু বছর আগে আমাদের সকলকে কাঁদিয়ে শোক সাগরে ভাসিয়ে প্রিয়জন নেতা তরিকুল ইসলাম না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সেখান হতে কেউ কোনদিন আর ফিরে আসে না।
ওইদিন বিকেল ৫টায় ঢাকা অ্যাপোলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর এই মৃত্যু সংবাদ শোকবার্তাটি মুহূর্তের মধ্যে বাতাসের বেগে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথেই ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার নেতাকর্মীরা হাসপাতালে দ্রুত ছুটে যান। আবার অনেকে পরিবার-পরিজনদের সমবেদনা জানাতে আসেন যশোরে শহরের তাঁর বাসভবনে।
পরদিন ৫ নভেম্বর একটি বিশেষ বিমানযোগে মরদেহটি ঢাকা থেকে যশোর আনা হয়। যশোর বিমানবন্দরে লাশটি গ্রহণের জন্যে হাজার হাজার ভক্ত ও কর্মী ভিড় জমান। অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে সেদিন বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙে পড়ে। সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। ফলে, নিরাপত্তা রক্ষা দায়িত্ব পালনে কর্মীদের খেতে হয় হিমশিম। সেখান হতে লাশটি গ্রহণ শেষে একটি গাড়িবহর শোভাযাত্রা সহকারে তাঁর বাসভবনে আনা হয়। সেখানেও আপোষমান ছিলেন শোকার্ত হাজার হাজার ভক্ত ও কর্মী। সকলে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে সৃষ্টি হয় এক শোকার্ত পরিবেশ।
বাদআসর যশোর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ওই জানাজায় শরিক ও তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার মুখখানি শেষবার দেখতে তাঁরা যশোর শহর অভিমুখে ছুটতে থাকেন। মানুষের ঢল নামে। সকাল ১০টার পর হতেই খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হাজার হাজার কর্মী-ভক্তরা তাঁর ঘোপের বাসভবন ও শহরে জমায়েত হতে থাকেন। চারিদিকে, লোকে লোকারণ্য। শহরটি সেদিন পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। জনতার ভিড়ে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যানবাহনের প্রচন্ড চাপে সেদিন শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অচল। কেননা, তরিকুল ইসলামের জানাজাটি ছিল যশোর জেলার স্মরণকালের ইতিহাসে বৃহত্তম জানাজা। ঈদগাহে কানায় কানায় পূর্ণ হবার পর তা ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী দক্ষিণে সার্কিট হাউজ, পূর্বে প্রধান ডাকঘর, উত্তরদিকে দড়াটানা, পশ্চিমে শিল্পকলা একাডেমি ও সিভিল সার্জন অফিস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ওই নামাজে জানাজায় শরিক হতে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মঈন খান, নিতাই রায় চৌধুরীসহ অনেকেই।
এরপর যশোর শহরের কারবালা গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই মহান নেতা। তিনি কত বড় মাপের নেতা ছিলেন, কতটা মাটি ও মানুষের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি ছিলেন, সেদিন কার জনসমাগমনেই তা প্রমাণিত হয়েছে দেশবাসীর কাছে।
১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ আব্দুল আজিজের ঘরে ও মা নুরজাহান বেগম এই শিশুটির জন্ম দেন। তাদের ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় অর্থাৎ সেজো। শৈশবকালে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন যশোর জেলা স্কুলে। ১৯৬১ সালে সেখান হতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর যশোর এমএম কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৬৬ সালে একই কলেজ হতে অর্থনীতিতে অনার্সসহ স্নাতক পাশ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন।
যশোরের এই কৃতী সন্তান তরিকুল ইসলাম ষাটের দশকে ছিলেন এদেশের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা। তিনি সে সময় হতে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে এক বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ভাসানী ন্যাপে যোগদান করেন এবং এদেশের প্রাচ্য রাজনীতিবিদ মজলুম জননেতা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে দেশব্যাপী রাজনীতিক কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যাপৃত করেন। এ সময় তিনি নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কৃষক সংগঠনেরও নেতৃত্ব প্রদান করেন। ‘৭০-এর নির্বাচনোত্তর উত্তাল আন্দোলনমুখর দিনগুলোতে তিনি বৃহত্তর যশোর জেলায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠন হিসেবে জাতির প্রান্তিলগ্নে গুরু দায়িত্ব পালন করেন।
এদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি একটি শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি দাবি আদায়ের সংগ্রামে তাঁকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। বলাবাহুল্য দক্ষিণবঙ্গের আর কোনো নেতাকে বারবার ও দীর্ঘ সময় কারাভোগ ও নির্যাতন সইতে হয়নি। ১৯৬৬ সালে এমএম কলেজে ছাত্রদের সরকারবিরোধী নেতৃত্বদানে তৎকালীন এমএনএ আহম্মদ আলী সরদারের দায়েরকৃত মামলায় জেলখানায় যান। এরপর ১৯৬৮ সালে আয়ূব সরকারবিরোধী ও ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন সময়ে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্যে পুলিশি নির্যাতন হাজতবাস করতে হয় তাঁকে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে ১৯৬৬-৬৮ সালে রাজবন্দী হিসেবে রাজশাহী ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর সাথে কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র নেতারাও গ্রেফতার হন এবং জেল খাটেন। ওই সময়ে শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ আব্দুল হাই, অধ্যাপক শরীফ হোসেন, অধ্যাপক গাজী লুৎফর হোসেন, অধ্যাপক তরিবর রহমান ও অধ্যাপক আবু তাহের। ছাত্রনেতাদের মধ্যে তরিকুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ, আমজাদ হোসেন, খালেদুর রহমান টিটো, গোলাম মোস্তফা, এনামুল হক, আসাদুজ্জামান, আব্দুল মতিন, জাকারিয়া মিলন, সিরাজুল ইসলাম বুলবুল।
এরপর বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরও ৬/৭ বারের বেশি সময় দায়েরকৃত মামলার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭৫ সালে ৭ই এপ্রিল বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। ওই সময়ে একই সাথে তাঁর দুই বন্ধু মাহবুবুর রহমান ও মাস্টার নূর জালালকেও আটক করা হয়। তিন মাস কারাভোগের পর মুক্তিলাভ করেন।
১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এবং ১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসে আবারও বিশেষ বাহিনীর হাতে তিনি আটক হন। ওই সময় দীর্ঘ তিন মাস ধরে নিখোঁজ থাকেন। তাঁকে ওই সময়ে বন্দি অবস্থায় নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। তথাকথিত এরশাদ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে নয় মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অবশেষে তাঁকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেয়া হয়। ওই সময়ে তাঁর সাথে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন আলী রেজা রাজু, অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক শেখ আব্দুল ওহাব, অধ্যাপক ইয়াকুব, অ্যাড. কাজী মুনিরুল হুদা, অ্যাড. ইসহক, আব্দুস সালাম আজাদ, ইউসুফ আলী, শাহীন, আবু মোর্ত্তজা ছোট, কচি ও মিনু।
পরবর্তীকালে ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। দীর্ঘ ১৮ মাস কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেন। এরপর ২০০৯ সালের পর তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। এমনকি ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা তাঁর পিছু ছাড়েনি। জেলখানা ও মামলাই ছিল জীবনে তাঁর একমাত্র নিত্যসঙ্গী।
তরিকুল ইসলাম তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিযাত্রার একটি উল্লেখযোগ্য দিনগুলোর মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি গঠন প্রক্রিয়ায় ভাসানী ন্যাপ প্রধান মশিয়ার রহমান যাদু মিয়ার সাথে তিনিও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৮২ সালে ৫ মার্চ সড়ক ও রেল মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯১ সালে সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, ১৯৯২ সালে একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী। ওই সময়ে ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, পরবর্তীতে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
পরবর্তীকালে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর খাদ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য এবং পরিবেশ ও মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতি দল পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর যোগ্যতা, মেধা প্রজ্ঞা ও বিচক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্যে ১৯৮৩ সালে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও একই সময়কালে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মত গুরু ও একই সময়কালে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মত গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়। তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী, হক কথায় পারঙ্গম ও জনদরদী রাজনীতিক। আমৃত্যু পর্যন্ত তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষমতা ও দূরদর্শীতার কারণে তিনি দলের নীতিনির্ধারণ কমিটির অন্যতম ছিলেন। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও অনেক সিনিয়র নেতাদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সকলেই তার মতামতকে খুবই গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিতেন।
এবার আমি তরিকুল ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক কিছু লেখনী লিখে রেখে যেতে চাই। যা সবই একটি জীবন্ত ইতিহাস। কোন কল্পনা-প্রসূত বা গল্পকাহিনী নয়।এটি তুলে না ধরলে সবই অজানা থেকে যাবে আগামী প্রজন্মের কাছে। তা সম্ভবপর হয়েছে বিভিন্ন কারণে। ষাটের দশক হতে খড়কীতে থেকে যশোর মুসলিম একাডেমি স্কুল, এমএম কলেজের ছাত্র হিসেবে পড়াশুনা, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও উন্নয়ন কর্মী হিসেবে আমার বিচরণ ছিল সব মহলে। ফলে, এই মহীরুহকে খুব কাছ থেকে সুদীর্ঘকাল দেখার ও সান্নিধ্য লাভের বহুবার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া তাঁর সহধর্মীণীর সাথে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। নার্গিস বেগমের বাবা তাঁর শ্বশুর আব্দুল হাসিব ছিলেন আমার অগ্রজ সাংবাদিক। তাঁদের বড় ছেলে সুমিত আমার বড় মেয়ের সাথে মোমিন গার্লস স্কুলে শিক্ষক আব্দুল ওহাব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তেন। নানা সুবাদে উভয় পরিবারের মাঝে ছিল আমার ঘনিষ্ঠতা ও যাতায়াত। ছোট ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নানা কারণে আমার প্রতি তাঁর দুর্বলতা রয়েছে। আমাকে সব সময় চাচা হিসেবে সম্বোধন করে খুবই শ্রদ্ধাভরে বিনয়ের সাথে কথা বলেন। সাংবাদিক হিসেবে জেলার বিভিন্ন স্থানে তাঁর সর সঙ্গী বহুবার হয়েছি। সার্কিট হাউজ, রেস্টহাউজ প্রভৃতি স্থানে তিনি নিজে খাবার টেবিল হতে উঠে এসে খোঁজ নিতেন আমরা ঠিকমত খাবার খাচ্ছি কি না ?
একটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। আমাদের এলাকায় দৌলতদিহি গ্রামের আব্দুল হাই তরফদার ছিলেন তাঁর একজন নিবেদিত প্রাণকর্মী ও ভক্ত। শীতকাল একদিন বিকেলে চুড়ামনকাটি বাজারে তাঁকে ছুটাছুটি করতে দেখি। বললাম : কি ব্যাপার এত অস্থির মনে হচ্ছে কেন আপনাকে ? তিনি খোলামেলা বললেন, নেতা সন্ধ্যারস খেতে চেয়েছেন। গ্রাম থেকে সন্ধ্যা রস নিয়ে শহরে তাঁর বাসায় যেতে হবে। আবার আমার ছাত্র সাতমাইলের ডা. আবু তোহাকে অনেকবার দেখেছি ঢাকা ও যশোরের বাসভবনে। ডায়াবেটিসের ওষুধ, গাছ বয়ে নিয়ে যেতে। একজন নেতার প্রতি ওই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না।
১৯৯৪ সালে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। কর্মবীর মুন্সী মেহেরুল্লাহর ১৩৩তম জন্মবার্ষিকীতে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ওই বছরই ঝাউদিয়া মেহেরুল্লাহ একাডেমি হতে ছাতিয়ানতলা গ্রামের মুন্সী মেহেরুল্লাহর মাজার পর্যন্ত পাকাকরণের ব্যবস্থা করা হয়।
পরবর্তী বছর ১৯৯৫ সালে কর্মবীর মেহেরুল্লাহর ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ জুন এই মহান ব্যক্তির ওপর বাংলাদেশ টেলিভিশনে মেহেরুল্লাহ স্মরণে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আলোচক হিসেবে তরিকুল ইসলাম, ড. শমসের আলী, অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ুমসহ আমারও অংশ নেবার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণে এর তিন দিন আগে আমাকে যশোরে ফিরে আসতে হয়। কেননা, ঢাকা টেলিভিশন থেকে কবি আব্দুল হাই শিকদারের নেতৃত্বে মেহেরুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ টিভিতে ধারণ করা হবে। আরও আমাকে আগে সার্বিক যোগাযোগ ও কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত রাখতে হবে। অবশেষে তরিকুল ইসলাম আমার হাতে সেদিন অনুষ্ঠানের পূর্বেই কয়েকটি স্মারক খাম তুলে দেন। আমি সেগুলি সংশ্লিষ্ট মহলে পৌঁছে দিই। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেদিন স্মারক ডাক টিকেটের উদ্বোধন করেন। আগে আব্দুল হাই শিকদার বিভিন্ন এলাকা ও মহলে গিয়ে মেহেরুল্লাহর উপর চিত্র ধারণ করেন। এখানে আমার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। আব্দুল হাই শিকদার পরে এটি প্রকাশিত হয় এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকারে আমার নামটি কথিকা শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করেন। তাঁকে সার্বিক সহযোগিতার জন্যে।
ওই সময় জনগণের সুবিধার্থে তরিকুল ইসলাম চূড়ামনকাটি ইউনিয়ন পরিষদ পোস্ট অফিস সংলগ্ন একটি কার্ডফোন বুথ স্থাপন করেন। সেখানে পাঁচ টাকার কয়েন ওই বক্সে ফেললেই টেলিফোনে সেবা পাওয়াতে আর্থিক সাশ্রয় ও সময়ের অপচয় হতে রেহাই পান ও উপকৃত হন।
একটি স্মৃতির কথা উল্লেখ না করলে নিজের কাছে আমি অপরাধী থেকে যাবো। আয়ূব সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফলে ছাত্র সংসদের নেতা, কলেজের শিক্ষকসহ অনেকেই গ্রেফতার হন। (যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি এই লেখার মধ্যে)। আমি ছিলাম ছাত্র সংসদের সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদক। বিতর্ক সম্পাদক উজির আহমেদ খাঁন ও ক্রীড়া সম্পাদক আতাউল হক মল্লিক। আমাদের তিনজনকে যেতে হয়নি। তরিকুল ইসলাম যশোর জেলখানা হতে আমাকে একটি চিরকুটে লিখেন ; ছাত্র সংসদকে চলমান রাখতে হবে। এতে কোন শিথিলতা যেন না আসে। এই চিঠিই আমাকে সাহস অনুপ্রেরণা জোগায়। ছাত্র সংসদের সকল কর্মকান্ড ঠিকমত পরিচালনা ও চলমান রাখি। ওই সময়ে যশোর পূর্বাঞ্চল প্রেস হতে ছত্র সংসদের বার্ষিক ম্যাগাজিন ছাপা হয়। ২৬৭ পৃষ্ঠার এই বার্ষিক ম্যাগাজিনটি যশোর এমএম কলেজের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ম্যাগাজিন হিসেবে পরিগণিত হয়। বার্ষিকীর জন্যে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ টাকা ব্যয় করি ছাপার কাজে। এটি সম্ভব হয়েছিল তরিকুল ইসলামের ছোট একটি চিরকুটের কারণেই।
ঢাকা মিন্টো রোডে মন্ত্রীপাড়া মন্ত্রীরা থাকেন। আমি সকাল নয়টার আগেই বাসায় পৌঁছে যেতাম। তার একান্ত সচিব হাফিজ আমাকে সরাসরি মন্ত্রীর বেড রুমে নিয়ে যেতেন। অনেকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। আমি আবার মন্ত্রীর গাড়িতেই সচিবালয়ে ঢুকতাম। কলেজ বাঁচাতে শেখা ও বিভিন্ন কাজ সেরে যথন বাইরে ফিরতাম তখন সচিবালয়ে দীর্ঘ লাইন। অপেক্ষাগারে সাক্ষাত, প্রার্থীদের ভিড়। আরেকটি ঘটনা তরিকুল ইসলামের ওপর তার কথা বর্ণনা না করে পারছি না। ১৯৯৬ সাল বিএনপি তখন ক্ষমতায়। আমি তখন যশোর জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি কাজী শওকত শাহী সম্পাদক। আমাদের শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা, দাবি ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা বন্ধ করে রাজপথে নামি।
আমাদের দাবির প্রতি কোন সাড়া পাচ্ছিলাম না সরকারের কাছ থেকে। যশোরের শিক্ষক সমাজ শিক্ষক ফেডারেশনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের কাছের মন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে বিষয়টি প্রথমে তাঁকে জানাতে ও বোঝাতে হবে। যশোর মুসলিম একাডেমীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাই। তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দেন। ধৈর্য ধরে আমাদের সকলের বক্তব্য শোনেন এবং কথা দেন আমাদের এই দাবিগুলো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, অথচ, তিনি আমাদের কাছে আসবেন, আমাদের পাশে থাকবেন। আমরা তা ভাবতেও পারিনি। একমাত্র তরিকুল ইসলামের উদার মনের মানুষের পক্ষ সেটি সম্ভব। আমরা সফল হয়েছিলাম আমাদের পেশাগত কিছুটা আর্থিক সুবিধা লাভ করি। ওই সময়ে তিনি ব্যক্তিগত তহবিল ২৫ হাজার টাকা অনুদান হিসেবে শিক্ষক সমিতিকে প্রদান করেন।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি এখনও এলাকার মানুষে ভোলেনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন দূরবর্তী এলাকার ভোটারদের আনা নেয়ার জন্যে একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করা হয়। তরিকুল ইসলাম ছিলেন সেই নির্বাচনের একজন প্রার্থী। ভোটারদের বহনকারী ট্রাকটি মেহেরুল্লাহ নগর, রেলস্টেশনের রেলক্রসিং পার হওয়ার মুহূর্তেই হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক ওই মুহূর্তে খুলনা থেকে রাজশাহীগামী ট্রেনটি রেলক্রসিং অতিক্রম করছিল। ট্রেনের ধাক্কায় ট্রাকটি উল্টে পড়ে। দ্রুতগামী মেল ট্রেনের চালক ট্রেনের বাঁশি বাজালেও তাতে কাজ হয়নি। দুইজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। নিহতদের মধ্যে ছাতিয়ানতলা গ্রামের জহুরুল আজিজের ছেলে যশোর এমএম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রওশন আজিজ ও দৌগাছিয়া গ্রামের খোরশেদ আলীর ছেলে ৭ম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল হক। দুর্ঘটনায় ৫/৬ জন আহত হয়। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই তরিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছান। তিনি বলেন, আমার ভোটের দরকার নেই। আহতদের আগে বাঁচান। চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব ও ব্যয়ভার তিনি বহন করেন। শোকার্ত পরিবারের সমবেদনা জানাতে ছুটে যান তাদের বাড়িতে।
২০০৩ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তরিকুল ইসলাম আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনুষ্ঠানস্থলে মঞ্চে মন্ত্রীর আসনের পাশেই আসন গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল বারী। ওই বিষয়টি নিয়ে তখন সকল মহলে মুখরোচক, আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তাহলে আব্দুল বারী দলত্যাগ করে বিএনপিতে যাচ্ছেন ? ওই অনুষ্ঠানে তিনি তরিকুল ইসলামের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, তরিকুল ইসলাম শুধু যশোরের মন্ত্রী নন, তিনি দেশেরও একজন মন্ত্রী। ফলে, তাঁর পাশে বসা যায়। এ না হলে তরিকুল ইসলাম। রাজনৈতিক অঙ্গণে তিনি ছিলেন এক আলাদা জগতের ভিন্ন ধর্মী মানুষ, খাঁটি পরীক্ষিত একজন রাজনীতিবিদ।
১৯৯৬ সাল প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে তিনি মহাব্যস্ত। এর মাঝে আগেরদিন রাতে সাংবাদিক হারুন জামিলকে দাওয়াতপত্র পাঠানো হয়েছে কি-না ? শত ব্যস্ততার মাঝে কিভাবে সম্ভব ? এটি তরিকুল ইসলামের পক্ষেই শোভা পায়।
তাঁর শরণাপন্ন হয়ে কোন সাহায্য ও সহযোগিতা চেয়ে কাছে গেলে কাউকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়নি কখনও। দলমত নির্বিশেষে এমনকি পিয়ন, আয়া, মালী, পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেছেন। তিনি বলতেন, এরা কোথায় যাবে, আমার কাছে এসেছে বড় আশা নিয়ে। পরিশেষে আমাকে বলতে হয়, তরিকুল ইসলাম এদেশে বারবার জন্মে না। তাঁর মত প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ, নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী জনদরদী নেতা দেশে একবারই জন্মে।
মো. মশিউল আযম
প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক ও উন্নয়ন কর্মী।

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ মরণে তাই তুমি করে গেলে দান
মোঃ মকবুল হোসেন

শেষ পর্যন্ত রণাঙ্গনে ছিলেন তরিকুল ইসলাম। ৬০’র দশকে বিশ্বব্যাপী উত্তাল রাজনীতির দিনে সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতিতে হাতে খড়ি। সরকারি এম.এম কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জি.এস, তারপর এগিয়ে যাওয়া। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও মানবমুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন। লড়াই সংগ্রামের পথ অতি দুর্গম। তারপরও তিনি জীবনে আদর্শচ্যুত হননি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, এরশাদ শাহীর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন ভাবে লড়াই করেছেন, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। নেমে এসেছে জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাচন। আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে তিনি লড়াই করেছেন। বিশ্বাস ও দৃঢ়তার সাথে কাজ করেছেন মানুষের জন্য। বহুবার জেল খেটেছেন। দেশ, জাতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার একটি প্রখর চেতনা এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হতেন তিনি।
ইংরেজিতে যাকে বলে ‘প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’- এ বিশ্বাস করতেন। নির্মোহ, সৎ ও সরল জীবন যাপনের সাথে উচ্চতর জীবন বোধের সমন্বয় ঘটেছিল তরিকুল ইসলামের মধ্যে। তাঁর আলাপচারিতায় ও সাংগঠনিক তৎপরতায় আমরা তাঁর সে জীবন বোধের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। সভ্যতার বিকাশে মানুষের কোন কর্মতৎপরতা বা গুণাবলী সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিল যা, এখনো মানুষের সমাজকে সমৃদ্ধ করে চলেছে?
এই প্রশ্নের জবাবে নানা মুনির নানা মত থাকতে পারে। একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলাকে সামনে রেখে মানুষের ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক কর্মতৎপরতাই সম্ভবত মানব সভ্যতার বিকাশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে। তরিকুল ইসলাম যে চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়ে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে গেছেন তা ছিল সার্বজনীন কল্যাণ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। আমাদের তাঁর চেতনাকে ধারণ করতে হবে। আড়াই হাজার বছরেরও আগে, খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে জন্মগ্রহণকারী চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াসের শিষ্যরা কনফুসিয়াসের কাছে জীবন ও জগতের অনেক চিরন্তন প্রশ্নের জবাব জানতে গিয়ে কনফুসিয়াস যে জবাব দিয়েছিলেন তাঁর একটি সংকলন তা ‘এনালেক্টস’ নামে পরিচিত। কনফুসিয়াসের ‘এনালেক্টস’ বিশেষ বহুল পঠিত গ্রন্থগুলোর অন্যতম। শিষ্যরা কনফুসিয়াসের কাছে তাঁর মূল শিক্ষা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি হিউম্যানিটি, লয়ালটি, রিসিপ্রোসিটি এবং রিচুয়াল। এই চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেন। একজন শিষ্য তাঁর সকল শিক্ষাকে এবং কথায় বা একটি মাত্র শব্দের মাধ্যমে জানতে চাইলে যে, শব্দটি পাওয়া যায়, তা হচ্ছে ‘রিসিপ্রোসিটি’। এর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় কনফুসিয়াস বলেন। “চবৎযধঢ়ং ঃযব ড়িৎফ ‘জবপরঢ়ৎড়পরঃু’: উড় হড়ঃ ফড় ঃড় ড়ঃযবৎং যিধঃ ুড়ঁ ড়িঁষফ হড়ঃ ধিহঃ ড়ঃযবৎং ঃড় ফড় ঃড় ুড়ঁ” অর্থাৎ- তুমি অন্যের প্রতি এমন আচরণ করো না, যা তুমি অন্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা কর না। আবার অষ্টাদশ শতকের জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের নৈতিক দর্শনের মূল কথাই হচ্ছে, “তুমি এমনভাবে কাজ কর যাতে তোমার কাজের ইচ্ছাটি সার্বজনীন প্রাকৃতিক আইনে পরিনত হতে পারে”। সকল মহাপুরুষ আমাদের যেভাবে চিন্তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন তা, মানব কল্যাণের চিরন্তন পথ। কাজেই এই পথ হচ্ছে পারস্পারিক কল্যাণ ও ন্যায়বোধের পথ কনফুসিয়াসের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে- ‘রিসিপ্রোসিটি’। গত ৪ নভেম্বর ২০১৮ সালে তরিকুল ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালে তরিকুল ভাই বেঁচে থাকলে তাঁর কাছ থেকে জনগণের ইচ্ছা আকাঙ্খার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়তো বেরিয়ে আসতো। তিনি শুধু সিদ্ধান্ত দিয়েই সমাজের প্রতি ও দলের প্রতি কর্তব্য শেষ করতেন না। সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েও তিনি এই ক্রান্তিকালে দলকে সংকট উত্তরনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেন।
তরিকুল ভাই ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব মন্ত্রী, এম.পি, পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকার পরও ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে পারস্পারিক সৌহার্দ ও কল্যাণের জন্য তিনি জনপ্রিয়তায় ছিলেন শীর্ষে।
জীবনে তাঁর কাছাকাছি সুদীর্ঘ পথ চলার অবকাশ আমার হয়েছে। ক্ষুদ্র এই নিবন্ধে কী অর্ঘ আমি তাঁকে নিবেদন করব ? তিনি ছিলেন অনুকরণীয় এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যাঁর ঔদার্য, উষ্ণতা ও আন্তরিকতা ছিল সাধারণের অনেক উর্ধ্বে যাঁর সান্নিধ্য মানুষের পারস্পারিক সম্পর্কের গুণমানকে করতো উত্তোলিত। সুখদায়ক সময়ের সঙ্গী তিনি ছিলেন দুর্দিনের বন্ধু। সারা জীবন তিনি মানুষের ভিড়ে কাটিয়েছিলেন। তাঁর চির বিদায়ে, গভীর বেদনায় আজ কলম ধরেছি। তরিকুল ভাইয়ের মতো নেতা হয়তো দক্ষিণ, পঞ্চিমাঞ্চলে আর জন্ম হবে না। যাঁরা ছিলেন তাঁর বন্ধু, রাজনৈতিক সহকর্মী, ভক্ত, অনুরাগী তাদের এই অনন্য সাধারণ মানুষটির সঙ্গলাভ ছিল এক বিরল সৌভাগ্য। এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিকগুলো আলোচনা আমার সাধ্যের মধ্যেই সীমিত। টলস্টয়ের কথায় ‘জীবন শিল্পের চেয়ে মহান’ এতবড় মাপের মানুষ যিনি একটা ঐতিহাসিক সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তাঁকে সামগ্রিক উপলব্ধী নিয়ে অনুধাবন করতে গেলে যে দক্ষতা ও সময় প্রয়োজন ছিল তার অধিকারী আমরা ছিলাম না। তিঁনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু যে নীতি ও আদর্শ রেখে গেছেন ভক্ত, অনুরাগী ও দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য, যুগ যুগ ধরে প্রতিফলিত হবে বিশ্ব মানবতার মাঝে। মহাকবির ভাষায়-
‘সেই ধন্য নরকুলে
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদা
সেবে সর্ব্বজন।’
লেখক: উপাধ্যক্ষ, যশোর কলেজ, যশোর

আমাদের তরিকুল ভাই
আবু সালেহ

তরিকুল ভাইকে হারিয়ে আমরা বৃহত্তর যশোর তথা-খুলনা বিভাগের অধিবাসীরা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছি। তাঁর মতো বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্বদানকারী নেতা ওই অঞ্চলে কবে যে পূরণ হবে তা ভাবা যায় না। বিগত কয়েক দশক জুড়ে তাঁর নেতৃত্ব ছিলো অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক, সমাজ পরিবর্তনের সা¤্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও লুটেরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াইয়ের। প্রকৃত জাতীয়তাবাদের ধারক হয়েছিলেন তিনি। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের শ্রদ্ধা ও আস্থাভাজন ছিলেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিকদলের নেতা-কর্মীদের কাছেও তিনি শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। সর্বদলীয় ও সর্বজনপ্রিয় এমন জননন্দিত নেতার অভাব সহজে কি পূরণ হয়? এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিলো তাঁর। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গ্রেফতারী পরোয়ানা, হামলা-মামলা জেল জুলুম ছিলো তাঁর জীবনের নিয়মিত ঘটনা। এসবের কারণে তিনি গণমানুষের অতি বিশ্বস্ত ও আশা আকাংখার প্রতীক হয়েছিলেন।
তরিকুল ভাই ছাত্র অবস্থাতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ষাটের দশকের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। এক ঝাঁক মেধাবী, আত্মপ্রত্যয়ী, বিনয়ী, ভদ্র, স্মার্ট, পড়–য়া, সমাজ সচেতন, সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী ও সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী ছাত্রের যৌথ বা সমন্বিত নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়নকে জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত করেছিলেন। তরিকুল ভাই এই সংগঠনে তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
প্রগতিশীল রাজনীতির উজ্জল নক্ষত্র কমরেড আবদুল হক যশোর অঞ্চলে বিপ্লবী রাজনীতির যে বীজ রোপন করেন তাকে পল্লবিত বিস্তৃত করেছিলেন তরিকুল ভাইয়েরা।
জনাব শামসুজ্জামান মানিক, নূর মোহাম্মদ, শহীদ মাশুকুর রহমান তোজো, শহীদ শান্তি, শহীদ আসাদুজ্জামান আসাদ, খালেদুর রহমান টিটো, আমজাদ হোসেন প্রমুখ এগিয়ে নিয়েছিলেন বিপ্লবী রাজনীতির সেই ধারা ও বিপ্লবী বহরকে। যশোর হয়ে ওঠে বিপ্লবী রাজনীতির অটল দূর্গে।
মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অগ্রগামী ও সাহসী সৈনিক ছিলেন তারা।  বিশ্বে বিপ্লবী রাজনীতির নেতৃত্ব ভেঙে পড়লে সেই সোচ্চারিত রাজনীতি স্তিমিত হয়ে যায়। এদেশে তথা যশোরেও তার প্রভাব পড়ে।
মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে গঠিত হয়েছিল। সা¤্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও লুটেরা পুঁজিবাদ বিরোধী এই দলকে বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মিত্র দল হিসেবেই মনে করে। শুধু তাই নয়, এ দলের সংগেও তারা জড়িত হয়। হসাধারণের দৃষ্টিতে ন্যাপকে অনেকে কমিউনিস্ট পার্টি বলেই চিহ্নিত করে। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো বিরূপ মন্তব্য ও প্রচার চালায়। যার ফলে ন্যাপ সাংগঠনিকভাবে আর এগোতে পারছিলো না।
একটি প্রকৃত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল চূড়ান্ত সাফল্যের কাছাকাছি এসেই দুর্বল হয়ে যায়। বিপ্লবীরা সশস্ত্র বিপ্লবের নামে ন্যাপ পরিত্যাগ করে। এ সময়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের উত্থান হয়।
তরিকুল ভাইয়েরা তখন বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হন। এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নতুন উদ্যম ও সাহস নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পতাকাকে উর্ধে তুলে ধরেন।
মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাপও নেতৃশূন্য হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মশিয়ূর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সকল কর্মকান্ড স্থগিত করে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ও পরে জাতীয়তাবাদী দল গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই দলের প্রধান নেতা হন। দ্বিতীয় প্রভাবশালী নেতা হন জনাব মশিয়ূর রহমান যাদু মিয়া।
মওলানা ভাসানী বিভিন্ন সময়ে বলতেন, ন্যাপ ভেঙে দিয়ে একটি পিওর ন্যাশনালিস্ট পার্টি গঠন করার। আমাদের কাছেও তিনি বলেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে ন্যাপ এর নেতৃত্ব না থাকায় বা ব্যর্থতায় তিনি এ কথা বলেছিলেন। তাঁর পরামর্শ পর্যালোচনা করেই ন্যাপ মূখ্য ভূমিকা নিয়ে জাতীয়তাবাদী দল গঠনে অবদান রাখে। তরিকুল ভাই শহীদ জিয়ার সরাসরি আমন্ত্রণে জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন এবং মন্ত্রী হন।
অপরদিকে খালেদুর রহমান টিটো বেগম জিয়ার আমন্ত্রণে বিএনপিতে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পরে তরিকুল ইসলাম ও খালেদুর রহমান টিটো যশোরের রাজনীতিতে উজ্জল তারকা হিসেবে জনপ্রিয় হন।
যশোরের রাজনীতির অঙ্গনে ঐতিহাসিক তিন বন্ধুর একাত্মার শক্তি সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে আশা আকংখার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই তিন বন্ধু হলেন, জনাব নূর মোহাম্মদ, তরিকুল ইসলাম ও খালেদুর রহমান টিটো। এই ত্রিশক্তির রাজনৈতিক শক্তি যশোর তথা খুলনা অঞ্চলে কিংবদন্তীর শক্তিতে বিস্তৃত হয়েছিলো। কমরেড আমজাদ হোসেন ক্রমেই তার বিপ্লবী রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তাঁর নেতৃত্বেই ৭০ দশকের কিছু পূর্বে বিপ্লবী রাজনীতির সর্বপ্রথম শ্রেণি সংহার সূচিত হয় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের চাঁদ আলিকে জীবন দন্ড দেওয়ার মধ্য দিয়ে। আমজাদ ভাই পরে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে। এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতি, কৃষক আন্দোলন, সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে লেখা তার রচিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে।
যশোরের ছাত্র ইউনিয়ন কার্যকর ও বিস্তৃত করতে আর একজন নেতা- কমরেড শামসুজ্জামান মানিকের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। তিনি দিনাজপুরের অধিবাসী ছিলেন। পিতার কর্মস্থল যশোর। সেই সুবাদে মানিক ভাই যশোরের ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনিও এখন নিষ্ক্রিয়। তবে লেখালেখিতে রয়েছেন। অনেক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা তার এক মহামূল্যবান গবেষণাধর্মী ঐতিহাসিক গ্রন্থ। নূর মোহাম্মদ ভাই যশোর ত্যাগ করেছেন সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। নিরব নিভৃতেই এখন ঢাকায় বসবাস করছেন। অসংখ্য বই রয়েছে তার কালেকশনে। অধিকাংশ সময়েই বই পাঠে নিমগ্ন থাকেন। আমি তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলাম বা আছি। সবার প্রতিই আমার রয়েছে অটুট শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তারাও আমার খোঁজ খবর রাখেন।
তরিকুল ভাই, আমজাদ ভাই ও টিটো ভাই ঢাকায় এলেই আমাদের বাসায় আসতেন। রাজনৈতিক সহকর্মীর খোঁজ খবর নেয়া তাদের চরিত্রের প্রধান গুন ছিলো। বিএনপির রাজনীতিতে তরিকুল ভাই জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে পরিণত হয়েছিলেন। প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবেও সফল ছিলেন তিনি। তিনি জাতীয়তাবাদী দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন।
ষাটের দশকে নার্গিস আপা ঢাকার প্রগতিশীল রাজনীতিতে একজন আলোচিত জনপ্রিয় ও নিবেদিত প্রান সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি তরিকুল ভাইয়ের সহধর্মিণী।
প্রগতিশীল রাজনীতির অংগনে তরিকুল ভাই এক অবিসংবাদিত ও কিংবদন্তী নেতা ছিলেন। তাঁকে সবাই ভালোবাসতো। সাধারণ কর্মীদের কাছেও তিনি ছিলেন বন্ধুর মতো। তার সাথে অনেক স্মৃতি রয়েছে আমার। সেই বিপ্লবী রাজনীতির শুরু থেকে তাঁর তিরোধান পর্যন্ত কতো যে স্মৃতি তা লিপিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করছি।
তখন তিনি মন্ত্রী। আমাকে ফোন করলেন, হুজুরের ওখানে যাবেন। হুজুর মানে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে সন্তোষে যাবেন। আমি গিয়েছিলাম। সে যে কি আবেগ হুজুরকে নিয়ে। আমি বহুদিন সার্বক্ষণিকভাবে মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সহকারী হিসেবে ছিলাম। আমার কাছে খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করছিলেন বিভিন্ন প্রসঙ্গের কথা। এক পর্যায়ে তাঁকে সন্তোষের একটি ঘটনার কথা বললাম। ঘটনাটি ছিলো, বাকশাল গঠনের সময়ে মওলানা ভাসানীর কথা। মওলানা ভাসানী বাকশাল গঠনের তীব্র বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করলেন। আমরা ঢাকা থেকে কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা সন্তোষে যাই। উদ্দেশ্য বাকশাল গঠন সম্পর্কে তাঁর অবস্থান জানা। যে কজন ছিলেন, তার মধ্যে সর্বজনাব আলমগীর সিদ্দিকী (যশোর), রাশেদ খান মেনন, সিরাজুল হক মন্টু ও আমি (আবু সালেহ)।
বাকশালে যোগদান করার জন্য আমাদের ওপর খুব চাপাচাপি হচ্ছিলো। আজাদ সুলতান ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক। তৎকালীন সরকার আজাদ সুলতানের কাছ থেকে আমাদের সকলের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সরকারি গোয়েন্দাদের হাতে দেয়। নাম-ঠিকানা অনুযায়ী এক গভীর রাতে আমার বাসায় একদল রক্ষী আসে। আমি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম তারা সশস্ত্র। বিলম্ব না করে বাড়ির পেছন দিয়ে দৌড়ে পালালাম। এতে আমি আহতও হলাম। বাসা ছেড়ে পলাতক হলাম। পলাতক জীবন অবশ্য এর আগেও অনেক হয়েছে। সোজা নয়াটোলা মধুবাগে সিরাজুল হক মন্টু ভাইয়ের বাসায় গেলাম। ভাবি বললেন, সন্ধ্যায় কারা যেন এসেছিলেন। তাই তিনি অন্যত্র সরে গেছেন। এভাবে নূর মোহাম্মদ খান (খান ভাইয়ের) মোহাম্মদপুরের বাসায় গেলাম। তিনি বললেন আমিও এরকম একটা কিছুর আশঙ্কা করছি। সিদ্ধান্ত হলো, কেউ বাকশালে যাবো না। ইতোমধ্যেই হাজী মোহাম্মদ দানেশ, আবদুল করীম (করীম ভাই), আজাদ সুলতান বাকশালে যোগদান করেছেন। তাঁরা বলে বেড়াচ্ছিলেন, মওলানা ভাসানী বাকশালে যোগ দেবেন। বিষয়টি খটকা লাগলো। স্থির করলাম সন্তোষে গিয়েই জানি কথাটি সত্য কিনা। সন্তোষে গিয়ে দেখি আলমগীর সিদ্দিকী ভাই মেনন ভাইসহ আরও কয়েকজন হুজুরের কাছে বসা। হুজুর বিভিন্ন বিষয়ে সকলের পরামর্শ দিচ্ছিলেন। আলমগীর সিদ্দিকী ভাইকে তিনি বললেন, আলমগীর তুমি বাকশালে যোগ দাও। আমি মুজিবরকে চিনি। কোনো বাম কর্মীদের জীবন্ত রাখবে না। এঁদের বাঁচাতে হবে। যশোর বাম রাজনীতির ঘাঁটি। মুজিবরের নজরে তা আছে। তরিকুল টিটোদের রক্ষা করতে হবে। মনে করলে তুমিও যোগ দাও। আগে নিজে বাঁচো, কর্মীদের বাঁচাও। মেনন ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, মেনন, তুমি বাকশালে যোগ দিও না। মেনন একদিনে তৈরি হয়নি। আরও কয়েকজনকে এভাবে পরামর্শ দিচ্ছিলেন হুজুর। এক পর্যায়ে আমি হুজুরকে বললাম, হুজুর ঢাকায় শুনতে পেলাম আপনি বাকশালে যোগ দিচ্ছেন এ খবরে জনগন ছি ছি করছে। এ কথা বলার সাথে সাথে হুজুর রাগে গর্জে উঠলেন। বললেন, তুমি আমাকে জনগনের ভয় দেখাও, আমি রাজনীতি বুঝি না। এ দেশের জনগণকে আমি সতেরোবার করে চিনি। হাটায়ে চিনি, শোওয়ায়ে চিনি, কা’ৎ করে চিনি, উপুর করে চিনি, বসায়ে চিনি। জনগনের কথার উপর নির্ভর করে রাজনীতি করলে কোনোদিন কামিয়াব হবে না। খাল এমনভাবে কাটতে হবে যাতে উৎস থেকে স্বাভাবিক ভাবেই সে খালে পানি আসে। তা না হলে কলসি ভরে ভরে খালে পানি ঢাললে সে পানিতে খাল ভরবে না। সাঁতারও কাটতে পারবে না। তেমনি তোমার নেতৃত্ব এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে তখন যাতে তারা তোমার কথা শোনে। তাদের কান ধরে যে দিকে টানবে সেদিকে যাবে। তবে রাজনীতি ও কৌশল ঠিক রাখতে হবে। আজ জনগণ ছি ছি করছে আগামীকালই তারাই এসে ফুলের মালা দেবে। হুজুর আমাদের সাবধানে থাকতে বললেন। আলমগীর সিদ্দিকী ভাইকে বললেন, তরিকুল ও টিটোদের সাবধানে রেখো। খুব ভালো ছেলে তারা। একথা শুনে তরিকুল ভাইয়ের চোখ বেয়ে পানি নেমে এলো।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধেও তরিকুল ভাইয়ের ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের সংগী সাথীরা স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকদের হাতে শহীদ হন। এদের মধ্যে তোজো ভাই (টিটো ভাইয়ের বড় ভাই) শান্তি, আসাদ, (ড. মনিরুজ্জামানদের ভাই) প্রমুখ। তাঁরা শহীদ হওয়ায় তরিকুল ভাইয়েরা ভালো মতই ধাক্কা খেলেন। যারা শহীদ হলেন তারা সকলেই ছিলেন অসম সাহসী ও যোদ্ধা। রাজনীতিতেও জনপ্রিয় ছিলেন।
তারপরও নূর মোহাম্মদ ভাই, তরিকুল টিটো ভাইয়েরা কলিগঞ্জের একটি স্কুলে এসে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও হতাশ না হয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ক্যাম্প করেন। কালীগঞ্জ এলাকাটি ছিলো পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল) এর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। নেতা ছিলেন আমজাদ ভাই। এ ছাড়া ছিলেন কমরেড ওয়াজেদ। বাকশালী আমলে গুম ও নিহত আমজাদ (কুলারহাট) সহ আরও অনেকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমরেড আবদুল মতিনের স্ত্রী কালীগঞ্জেই অবস্থান করেন। বৃহত্তর যশোর জেলা তথা খুলনা বিভাগে জননেতা তরিকুল ইসলাম সকল শ্রেণিপেশার মানুষের অবিসংবাদিত ও কিংবদন্তিতূল্য নেতা ছিলেন। নিজ দল ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছেও ছিলেন বিশেষভাবে শ্রদ্ধা ও আস্থাভাজন। রাজনীতি ছাড়াও সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, সমাজ বিপ্লব ও জনগনের সার্বিক মুক্তি প্রতিষ্ঠায় আজীবন লড়াই করেছেন। আপোষহীন নেতা হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একান্ত অনুসারী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছেও তিনি খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সকল কর্মকাণ্ড স্থগিত করে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ও পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী দল গঠন হলে এক পর্যায়ে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরাসরি আমন্ত্রণে এ দলে যোগদান করেন এবং তার মন্ত্রিসভায় রেল প্রতিমন্ত্রী হন।
এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিলো তাঁর। ষাটের দশকে যে কয়েকজন সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে যশোর ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন জনাব শামসুজ্জামান মানিক, নূর মোহাম্মদ, খালেদুর রহমান টিটো, শান্তি, আসাদুজ্জামান আসাদ, আমজাদ হোসেন প্রমুখ।
মেধাবী, ভদ্র, বিনয়ী, সমাজ সচেতন, নিষ্ঠাবান, কর্তব্যপরায়ন তৎকালীন উল্লেখিত ছাত্র নেতাদের প্রতি যশোরের ছাত্র সমাজ, রাজনৈতিক নেতা কর্মী, ট্রেড ইউনিয়নসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। অতিদ্রুত যশোরে ছাত্র ইউনিয়নের শক্তিশালী ছাত্র সংগঠনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তরিকুল ইসলাম এ সংগঠন প্রতিষ্ঠায় বিকাশে ও সম্প্রসারিত করতে বিশেষভাবে অবদান রাখেন। যশোর অঞ্চলের মানুষ রাজনৈতিক ও সমাজ সচেতন। প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিতে আস্থাবান। সেই ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই এখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। বিদ্রোহী হয়েছে। নীল বিদ্রোহ হয়েছে বৃহত্তর যশোরের বিভিন্ন অঞ্চলে। তরিকুল ভাইয়ের মৃত্যুতে শুধু যশোর অঞ্চল নয় বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জানিনা এ ক্ষতি কবে, কতদিনে পূরণ হবে।
লেখকঃ
একুশে পদকপ্রাপ্ত ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ছড়াকার, সিনিয়র সাংবাদিক ও মওলানা ভাসানীর সাবেক সার্বক্ষণিক একান্ত রাজনৈতিক সহকারী।

মহাপ্রাণের মহাপ্রয়াণ
আশরাফ হোসেন

মরণ, মৃত্যু, প্রয়াণ ও মহাপ্রয়াণ এই চারটি শব্দের আভিধানিক অর্থ অভিন্ন হলেও প্রায়োগিক বিচারে ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করে। কিছু কিছু মৃত্যু চলে যাওয়া নয়, বরং অমরত্ব দান করে। তখন তা মহাপ্রয়াণ হিসাবেই মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। যাকে স্মরণ করে আমার এই ছোট্ট চারণ-প্রয়াস তার মৃত্যু আমার কাছে মহাপ্রয়াণ তো বটেই। এমন একজন মহাপ্রাণ মানুষের এই চলে যাওয়াকে লোকান্তরিত না বলে লোকের আত্মরোস্থিত অনন্তকালের প্রেরণা হিসাবেই বিবৃত করা যায়।
আমি প্রয়াত জননেতা তরিকুল ইসলামের কথা বলছি।
আমি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে যাশারের সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত থেকে যশোরের রাজনীতি কাছ থেকে দেখেছি যদিও সরাসরি সম্পৃক্ত হইনি কখনো। আমার সাংস্কৃতিক পরিক্রমায় রাজনীতি না থাকলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের আর্মিবাদ ও প্রেরণর আমাকে এগিয়ে দিয়েছে পদে পদে। চলার সে পথে আমার বাতিঘর ছিলেন তরিকুল ইসলাম।
সংস্কৃতি কোনো রাজনীতি বিচ্ছিন্ন চর্চা নয়। রাজনৈতিক দর্শন বিবর্জিত কোনো সংস্কৃতি চর্চা নিছকই বিনোদনের ভাড়ামী ছাড়া আর কিছু নয়। তা বলে একজন সংস্কৃতিবান রাজনীতিবিদ তার রাজনৈতিক দর্শনকে কখনো উলঙ্গভাবে সংস্কৃতি চর্চার ওপরে চাপিয়ে দেন না। অকুন্ঠ সহযোতিার পরও তাঁর এই নির্ভার উপস্থিতি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে সংস্কৃতি কর্মীদের। তাঁর এই কৌশলী মুন্সিয়ানা আমাকে বার বার মুগ্ধ করেছে। তাইতো আমার কাছে তিনি যত বড় রাজনীতিবিদ ততো বড় সংস্কৃতিবান পুরুষ।
১৯৬৭ সালে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যশোরের উচ্চ শিক্ষার একমাত্র বিদ্যাপীঠ মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ছাত্র আন্দোলনের সে এক স্বর্ণময় যুগ। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন তখন ছিল প্রগতিশীল ছাত্র সমাজের একমাত্র ছাত্র সংগঠন আর এই সংগঠনটিই ছিল যুব সমাজের মননে প্রগতি ভাবনার উন্মেষ ঘটানোর একমাত্র সুসংগঠিত মঞ্চ। যশোরের সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হতো এই সংগঠনের নেতৃত্বে। একগুচ্ছ আদর্শবান প্রগতিশীল ছাত্র নেতার সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা আলোকিত হলাম অসাম্প্রদায়িকতা আর প্রগতিশীল চেতনায়। আমাদের সামনে যে সকল ছাত্র নেতার দেখা পেলাম তাদের মধ্যে একবারে সামনের কাতারে ছিলেন তরিকুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ, খালেদুর রহমান টিটো, নার্গিস বেগম, আসাদউজ্জামান, নজরুল ইসলাম, মানিকসহ উজ্জ্বল একঝাঁক আদর্মদীপ্ত ছাত্রনেতা।
আমি যেহেতু গানের মানুষ তাই অতি অল্পদিনেই এইসব নেতৃবৃন্দের নজরে পড়তে বিলম্ব হয়নি। প্রয়াত শিল্পী শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদ ও মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান ছিলেন কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রাণপুরুণ একই সাথে ওই সব মহিরুহ ছাত্র নেতাদের ঘনিষ্ট বন্ধু। স্বাভাবিকভাবেই তাদের নজরে পড়ে গেলাম। সত্যি বলতে আমার সাংস্কৃতিক চৈতন্যের ভিত তৈরি হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন করতে গিয়েই। মনে পড়ে, তখন কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। গণসঙ্গীত ও গ্রন্থনার সম্মিলনে কী অপূর্ব সব গীতি নকশা পরিবেশিত হবো। গ্রন্থনায় অংশ নিতেন রফিক ভাই, তরিকুল ভাই, নার্গিস আপা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এখনকার ছাত্র নেতাদের মধ্যে এই সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততার নমুনা খুঁজে পাব কী ?
সুরবিতান সে সময় ছিল সঙ্গীত শিক্ষা ও চর্চার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। প্রতি সন্ধ্যায় আমাদের গানের আসর বসতো সেখানে। অবাক করা তথ্য দিই, সেই আসরের নিয়মিত শ্রোতা থাকতেন ওই সব নেতৃবৃন্দ। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে আলোকিত হলেও কখনোই তাঁদের রাজনৈতিক মতাবদ চাপিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রভাবিত করতে চাননি। এর সার্বজনীন তাকে ্রপ্রশ্নবিদ্ধ করতে চাননি। এখানেই তাঁদের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় মেলে। অমন নেতৃত্ব এখন বিরল।
১৯৮০ সালের কথা। আমি তখন সুরবিতান সঙ্গীত একাডেমির সহ-সাধারণ সম্পাদক। আগেই বলেছি, এই ধরনের সামাজিক-সাংসঋতিক সংগঠনে রাজনীতি উলঙ্গ চর্চা আমি সমর্থন করি না এবং মেনে নিতেও পারি না। সে সময়ে সুরবিতানের শীর্ষ নেতৃত্বের মস্তিষ্কে এই দুর্র্মতি হঠাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সুরবিতানের নিয়মিত পাঠ্যক্রমে তার অনুসৃত রাজনৈতিক আদর্শ নির্ভর একটি ক্লাস সংযুক্ত করতে হবে। প্রতিবাদ করলাম। সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকেই সমর্থন দিলো। অবস্থা বেগতিক দেখে ওই শীর্ষ নেতা আমাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলেন এবং তার ভাবনার সাথে সহমত না হলে পদত্যাগ করতে বললেন। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে পদত্যাগ করে চলে এলাম।
সংগঠনহীন থাকা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল। মনস্থির করলাম ভিন্ন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলবো। হ্যামিলনের বংশীবাদককে বাঁশিতে ফু দেওয়া লেগেছিল অনুসারী সংগ্রহের জন্য, আমার তাও লাগেনি। দলে দলে সুরবিতান ত্যাগ করে ছাত্র-ছাত্রীরা আমার পিছনে সমবেত হলো। স্বাভাবিকভাবেই আমার উপরে একটি চাপ সৃষ্টি হলো ওদের আশ্রয় দেবার জন্য একিট সংগঠন গড়ে তুলবার। পরিতোষ গুহ নামের এক সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। তার অব্যবহৃত একটি বড় ঘর সাময়িকভাবে খুলে দিলেন আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করলাম, ‘কিংশুক সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্র। শুরু করলাম কিংশুকের কার্যক্রম। আলাদা একটি ভবন ভাড়া নিয়ে স্থানান্তরের এক পর্যায়ে হঠাৎ একদিন ডেকে পাঠালেন তরিকুল ভাই। আমার কাছে সকল বৃত্তান্ত শুনে শুনে কিছুক্ষণ স্থির থাকলেন। তারপর বললেন, অত টাকা ভাড়া দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো কি সহজ কাজ ? একটু অপেক্ষা করে আমি দেখছি ভবনের ব্যবস্থা করা যায় কি-না। মনে হলো কোনো দেবদূত হাজির হয়েছেন আমার সামনে। তারপরও ইতস্থতায় চুপ করে ছিলাম। বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। নিমেষেই বুঝে নিলেন আমার সংশয়ের হেতু। জিজ্ঞাসা করলেন, কী ভাবছো ? সংকোচ নিয়ে বললাম, ভাই, আপনিও তো রাজনীতিবিদ। ভাবছি- যে মতান্তরের কারণে আমার সুরবিতান ত্যাগ, আবার তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না তো। উনি আমার পিঠে স্বস্নেহে হাত রেখে বললেন, আমার রাজনৈতিক অবস্থান এত ঠুনকো নয় যে তোমার এই ছোট্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পাততে হবে। তোমাকে ভালোবাসি, গান ভালোবাসি, তাই এই তাগিদ অনুভাব করছি। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন। বাকিটা ইতিহাস। তাঁর ঐকান্তিক বদান্যতায় কিংশুক আজ ফুলে ফলে পল্লবিত মহিরুহ। আমৃত্যু কথা রেখেছিলেন। কোনদিন তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে কিংশুককে সম্পৃক্ত করার সামান্য চেষ্টাও করেননি। তাই তিনি কিংশুকের কাছে বরণীয়, চির স্মরণীয়।
তাঁর মহাপ্রয়াণের দ্বিতীয় বর্ষে হৃদয়ের গভীরে তাঁকে স্মরণ করি, ধারণ করি। প্রার্থনা করি, আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
লেখক: সম্পাদক, কিংশুক সঙ্গীত একাডেমি