জননেতা তরিকুল ইসলামের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরন সংখ্যাার একগুচ্ছ লেখা-৩

0

সদয় মনের মানুষটি
সুলতান আহমদ

মনুষ্য চরিত্র বিশ্লেষণ করে এককভাবে একটি মাত্র সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কোনদিনই সম্ভব নয়। নানাভাবে নানাজনের সিদ্ধান্ত আসবে, জনাব তরিকুল ইসলাম বা তরিকুল ভাই-এর ব্যতিক্রম নয়। রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ঘুরতে গিয়ে সব মানুষের সাথে যে একই রকম আচরণ করতে পেরেছেন এমন নয়, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি বলবো, গড় বিচারে ফেলে তরিকুল ভাইকে মূল্যায়ন করতে হবে।
ব্যক্তিগত জীবনে আমার সাথে তাঁর সম্পর্ক ১৯৬৬ সালের জুলাই-এর দিকে। এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বই পড়ার সুযোগ পেতে যশোর ইন্সটিটিউট পাবলিক লাইব্রেরিতে আসা যাওয়া। ইন্সটিটিউট চত্বরেই তাঁর সাথে আমার পরিচয়। ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে পরামর্শ দিলেন। ‘হোস্টেল থেকে আড্ডাবাজ না হয়ে পড়াশুনায় মনোযোগ দিবে’ তারপর বিদায়।
বি.এ পরীক্ষা দিয়ে যশোর ইন্সটিটিউট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। দেখা হলে বলতেন, ‘এমএটা পড়লে না কেন ?“ কারণ বলতাম। দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতা বাড়লো সুমিত ও অমিত স্কুলে ভর্তি হলো। পারিবারিক পরিমন্ডলেও পরিচয় বাড়লো। ছেলেদের শিক্ষক। সম্বোধন করতেন, মাইডিয়ার সুলতান বলে। স্নেহের পাশাপাশি ভক্তিটাও প্রকাশ পেত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একই রকম সম্বোধন।
পেশাগত কারণে শিক্ষক সংগঠনের সাথে যুক্ত হলাম। ফলে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে সংগঠনের প্রয়োজনে যোগাযোগ রাখতে হতো। সংগঠনেরও স্বার্থে কখনও কখনও সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে হতো। এমন কি মিছিল-মিটিংও করা লাগতো। তরিকুল ভাইয়ের মধ্যে শিক্ষকদের প্রতি একটা বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ লক্ষ্য করতাম। তাই আন্দোলন সংগ্রামে স্বপ্রণোদিত হয়ে পরামর্শ দিতেন। কার সাথে কেমনভাবে কথা বলতে হবে, কিভাবে সমস্যা উপস্থাপন করতে হবে, তা শিখিয়ে দিতেন।
তাঁর কাছে কোন মানুষ কোন কাজ নিয়ে গেলে প্রথমে ধমকের সুরে কথা শুরু করতেন। কেউ কেউ ভয় পেয়ে চলে যেতেন। আবার কেউ কেউ অপেক্ষা করে সমস্যার কথা বলতে গেলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সমাধানের পথ বলে দিতেন অথবা নিজে দায়িত্ব নিতেন। এটা ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য।
তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও দেখেছি। কথায় কথায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতেন না। রাজনৈতিক প্রলোভনেও হঠাৎ করে ভুলতেন না। রাজনৈতিক মতাদর্শে যে কারোরই দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু তরিকুল ভাই এর যোগ্যতা ও সাফল্য সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ কম। রাজনৈতিক জীবন ছিল সোনালী ফ্রেমে আবদ্ধ। মানুষটি যা-যা করেছেন তা উল্লেখ করা আমার প্রয়োজন নেই। মৃত্যুর পর যশোরবাসী দেখিয়েছে এই মানুষটি কতটা প্রিয় ছিলেন, কতটা সদয় মনের মানুষ ছিলেন।

দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ আপোষহীন জননেতা তরিকুল ইসলাম
মোঃ তাইফুল ইসলাম টিপু

তরিকুল ইসলাম ছিলেন শতভাগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, সৎ ও সাচ্চা দেশপ্রেমিক জননেতা। শত নির্যাতনের মাঝেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন থেকেছেন তরিকুল ইসলাম। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আগত আস্থা ও বিশ্বাস এবং নেতা-কর্মীদের প্রতি কমিটমেন্ট তাঁর নেতৃত্বকে উদ্ভাসিত করেছে। তিনি দলমত নির্বিশেষে সর্বমহলে ছিলেন জনপ্রিয়। শুধু তাই নিয়, তিনি ছিলেন স্বাধীন মতপ্রকাশে বিশ্বাসী একজন সৃষ্টিশীল গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বও। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির হাতেখড়ি দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ তকিরুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন, ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি যখন বিলিন হবে দেশের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠাসহ শোষিত মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের পথও ততোটাই রুদ্ধ হবে।
একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ হওয়া যে কতো কঠিন তা তরিকুল ইসলাম-এর রাজনৈতিক জীবনাদর্শ বিশ্লেষণ করলে তা পড়তে পড়তে অনুধাবন করা যায়। একজন রাজনীতিবিদের যে সংজ্ঞা ও গুণাবলী থাকা দরকার ছিল তরিকুল ইসলামের মাঝে কোনটারই কমতি ছিল না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিই ছিল।
১৯৪৬ সালে ১৬ নভেম্বর তরিকুল ইসলাম যশোর শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ব্যবসায়ী আলহাজ্ব আব্দুল আজিজ ও মাতা গৃহিনী মোসাম্মৎ নূরজাহান বেগম দম্পতির সুযোগ্যপুত্র তরিকুল। স্ত্রী নার্গিস বেগম তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও যশোর সরকারি সিটি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ। ছাত্রজীবনে নার্গিস বেগম রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। কিন্তু বাঙালী বধূদের মতো স্বামী, সংসার আগলে রাখতে উচ্চশিক্ষিত নার্গিস বেগম বিয়ের পর আর সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেননি। কিন্তু স্বামী তরিকুলের মৃত্যুর পর নেতা-কর্মীদের চাপে তাকেও শেষ পর্যন্ত আজ আবারও সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরতে হয়েছে। তিনি বর্তমানে যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৬১ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, ১৯৬৩ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে আইএ এবং ১৯৬৮ সালে একই কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে তাঁর রাজনীতি শুরু। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন তিনি। তিনি ১৯৬৩ সালে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি তৎকালীন মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিপরীতে ফাতেমা জিন্নাহ-এর অনুকূলে জনমত সৃষ্টির জন্য অধ্যাপক শরীফ হোসেনের সহযোদ্ধা হিসেবে গ্রামে গ্রামে গমন এবং মানুষকে সংগঠিত করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই শোষিত ছাত্র-জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে সর্বোচ্চ বিলিয়ে দিতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। শোষিত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করতে গিয়ে কখনও ইটের ভাটায়, কখনও গরিব মানুষের কুঁড়ে ঘরে এবং কখনও কলার ভেলায় রাত্রি যাপন করেছেন। তিনি মাইলের পর মাইল ক্লান্তিহীনভাবে কর্দমাক্ত পথ পায়ে হেঁটেছেন। বিচিত্রময় রাজনৈতিক জীবনে তরিকুল ইসলাম বহুবার কারাবরণ করেন ও নির্যাতনের শিকার হন। যশোর এমএম কলেজে শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নিতে গিয়েও তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন স্থানীয় এমএনএ কর্তৃক দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় তরিকুল ইসলামকে বেশ কিছুদিন কারাবরণ করতে হয়। ১৯৬৮ সালে আইয়ূববিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁকে রাজবন্দি হিসাবে দীর্ঘ নয় মাস যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকতে হয়েছে। সাবেক পাকিস্তান আমল ও পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আইয়ূববিরোধী আন্দোলনসহ ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য পুলিশ কর্তৃক নির্যাতিত হন এবং বেশ কিছুদিন হাজতবাস করেন। জাতীয় রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রথম সারির নেতা। ১৯৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করেন তিনি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আহূত ফারাক্কা লং মার্চে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বীরত্বের সহিত দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করেন। ১৯৭৩ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তিনি তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৭৮ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি ফ্রন্টের হ্যাঁ/না নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। মরহুম মশিউর রহমান বর্তমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাপ (ভাসানী) বিলুপ্ত হলে তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির বৃহত্তর যশোর জেলা শাখার আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যশোর সদর নির্বাচনী এলাকা (যশোর-৩) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটিতে বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সারাজীবনই রাজনীতিতে গুরুত্ব দিয়েছেন তার প্রমাণ সেই সময় একটি দলীয় মিটিংয়ে দলের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, সবাই মন্ত্রী হতে চায়, দল করবে কে ? তখন তরিকুল ইসলাম দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি দল করতে চাই।’ ১৯৮২ সালের ৫ মার্চ বিচারপতি সাত্তার সাহেব-এর মন্ত্রী পরিষদে জনাব তরিকুল ইসলাম সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। নির্বাচিত একটি সরকারকে বন্দুকের নলের জোরে ১৯৮২ সালে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তরিকুল ইসলাম কারারুদ্ধ হন। দীর্ঘ তিন মাস তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে প্রতিদিন তাঁর হাত পা-বেঁধে ঝুলিয়ে তাঁর শরীরে প্রহার করা হতো। তাঁর চোখ মুখে গরম পানি ফেলে দেয়াসহ তাঁর সকল দাঁত উপড়িয়ে ফেলা হয়। শুধুমাত্র তরিকুল ইসলামকে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগদানে রাজি করাতেই এসব ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়। এই নির্যাতনের ভয়াবহতা এমনই ছিল যে, সেই সময় কারাগারে তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রথম দর্শনে তাঁকে চিনতে পর্যন্ত পারেননি। কিন্তু তিনি এতো নির্যাতনের পরেও তাঁর রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। অতঃপর তথাকথিত এরশাদ হত্যা প্রচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে দীর্ঘ নয় মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থাকেন। সেখানেও তাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন যে কয়জন নেতা দেশনেত্রী ও গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়াকে দল এবং দেশের প্রয়োজনে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে উৎসাহিত করেছেন তার মধ্যে তরিকুল ইসলাম অন্যতম। স্বৈরাচার এরশাদের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেকেই লোভ-লালসায় পড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন তরিকুল ইসলাম।
তিনি সকল ধরনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পাশে থেকে বিএনপির পতাকাকে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া অর্থাৎ দেশের সর্বত্র উড্ডীন রেখেছেন। ১৯৮৬ সালে তরিকুল ইসলামকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯০‘র গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরিকুল ইসলাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তরণের পর ১৯৯১-এর সংসদ নির্বাচনে তাকে ১০৩ ভোটে পরাজিত দেখানো হলেও পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে পুনঃগণনায় তিনি বিজয়ী হন। কিন্তু ওই নির্বাচনে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। সে সময় অনেকেই মন্ত্রী হওয়ার জন্য তদবিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এখানেও তরিকুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রম। কিন্তু তার অবদান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভুলে যাননি। তরিকুল ইসলামের প্রতি শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে তাঁকে ১৯৯১ সালে সরকারের সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ১৯৯২ সালে ওই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেন। এ সময়ে তিনি ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ঐ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালের উপনির্বাচনে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি যশোর-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। বিএনপির মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হলে তিনি বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের ৫ম কাউন্সিলে বিএনপির স্থায়ী কমটির সদস্য পদ পান। তিনি কখনোই পদের জন্য রাজনীতি করেনি। তার প্রমাণ, ১৯৮৮ সালে দলের চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁকে বিএনপির মহাসচিব হওয়ার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। ওই সময়ে তাঁর ঢাকাতে থাকা ও যাতায়াতের জন্য নিজের কোনো বাড়ি-গাড়ি না থাকায় তিনি সেই প্রস্তাব বিনয়ের সহিত প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও তরিকুল ইসলামের জন্য সেই ব্যবস্থাও করতে চেয়েছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। শীর্ষ নেতৃত্বকে ওয়াদা করে তিনি বলেছিলেন ‘আমি যেখানেই থাকি আমার উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবো।’
২০০৯ সালে জাতীয় কাউন্সিলের সময়ে তাঁকে আবারও মহাসচিব করার বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে তিনি অ্যাড. খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দলের চেয়ারপার্সনকে বলেছিলেন ‘দলের দুঃসময়ে খোন্দকার সাহেব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন বিধায় তাকেই যেন পুনরায় মহাসিচব করা হয়।
তরিকুল ইসলাম অনেক আগেই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। রাজনীতিতে অনেক জুনিয়র তাঁর চাইতে বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি তাতে দলের প্রতি কখনোই রাগ-অভিমান করেননি। সকল সময়ে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা ছিল বিধায় যখনই দলের সংকট দেখা দিয়েছে ঠিক তখনই সংকট মোকাবেলায় তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি যথাযথভাবে সংকট মোকাবেলা করে স্ব-স্থানে ফিরে গিয়েছেন। দলের প্রায় সকল সম্মেলনে তাঁকে দলের গণতন্ত্র সংশোধনে কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত করা হতো। তরিকুল ইসলাম সদালাপ ও জনবান্ধব নেতা ছিলেন। তিনি সারাজীবনই জনতার মাঝে থাকতে পছন্দ করতেন। সারাদেশসহ খুলনা বিভাগের এমন কোন ইউনিয়ন ও থানা নেই যেখানে তাঁর পদার্পণ ঘটেনি। তিনি শেষ বয়সে অসুস্থ অবস্থাতেও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি অধিকাংশ সময় যশোরে থাকতেন, দলের প্রয়োজনে ঢাকায় আসলেও কাজ শেষে আবার ফিরে যেতেন গ্রাম জনপদের মানুষের কাছে। তাঁকে কখনোই কোন ব্যক্তি বা বলয় প্রভাবিত করতে পারতেন না। তিনি নিজে যা ভালো মনে করতেন তা নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যরাও দলীয় সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। কর্মীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অগাধ। কাউকে কখনো কোন দায়িত্ব দিলে তাঁর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সার্বক্ষণিক খবর রাখতেন। দলের কোন নেতাকর্মীই তাঁর কাছে দূরের কেউ ছিল না, কারণ যিনি ভালো কাজ করতেন তাকেই তিনি সেই কাজের বিষয়ে যথাযথ মূল্যায়ন করতেন। তিনি সদা স্পষ্টবাদি নেতা ছিলেন। তিনি অকপটে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতাকর্মীদেরকে সত্য কথা বলতেন। দলের যে কোন নেতাকর্মীই বিপদে পড়লেই তাঁর কাছে ছুটে যেতেন, তিনি যথাযথ সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন। এই কারণেই তিনি বিএনপির সকল নেতাকর্মীর কাছে সম্মানের পাত্র ছিলেন। তিনি অনেক সময় প্রচন্ড রেগে যেতেন, নেতাকর্মীদেরকে শাসন করতেন আবার কিছুক্ষণ পরেই মনের গভীর থেকে মায়া মমতা দিয়ে আদর করতেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। তিনি সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরকে বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ রাখার কাজে ছিলেন দক্ষ সংগঠনের ন্যায় পারদর্শী। তিনি একজন নির্লোভ সাদামাটা প্রকৃতির নেতা ছিলেন। তিনি ৪ বার মন্ত্রী থাকার পরেও ঢাকা শহরে ১টি সীমিত আকারের ফ্ল্যাট ছাড়া কোন অফিস নেই। পারিবারিক ব্যবসা থাকার পরেও রাজনৈতিক কারণে সেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি একজন দূরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন, ১/১১’র তথাকথিত সরকার অনেককেই যখন কারাগারে নিয়েছিলেন তখন জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের সেই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করার কারণেই তাকে কারাগারে নেয়া হয়েছিলো। কারাগারে সকলেই যখন উদ্বিগ্ন তখন তিনি সকলকে বলতেন, সর্বোচ্চ ২ বছরের বেশি এই সরকার টিকে থাকতে পারবে না, ঠিক তেমনটাই হয়েছিল। তিনি স্বৈরাচারের নির্যাতনে শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হওয়ার পরও তাঁর মেধা ছিল অপরিসীম। কারণ একবার কোন কথা শুনলে সেটি আর ভুলতেন না এবং কোন কর্মীকে একবার দেখলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে রাখতে পারতেন। তিনি কখনোই স্বজননীতিকে প্রশ্রয় দিতেন না। সেটির উদাহরণ মিলে তাঁর ছেলেকে গত ২০১৬ সালের কাউন্সিলে পদ দেয়ার বিষয়ে তাঁর সম্মতি নিতে অনেক নেতাই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি সম্মতি দেননি। এমনকি তিনি তাদের বলেছেন, আমি এ বিষয়ে কাউকে বলতে পারবো না। পরবর্তীতে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং তার কনিষ্ঠ পুত্র অনিন্দ্য ইসলামকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন, কারণ তাঁকে কোন দায়িত্ব দিলে যে পরিমাণ খরচ হতো অন্যদের দায়িত্ব দিলে তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হতো। তিনি কখনোই অর্থের জন্য কারো কাছে মাথা নতো করেননি। অনেক সময় অর্থের অভাবে তাঁর চিকিৎসা বিলম্বিত হয়েছে, দলের চেয়ারপার্সন অনেক সময় তাঁর চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন, সেটিই তিনি বিনয়ের সহিত গ্রহণ করেননি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০১৫ সালের আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলে যে কয়কজন নেতা আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন তরিকুল ইসলাম ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম। তিনি সব সময় দলের কোন গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যাওয়ার আগে তৃণমূল থেকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সহিত আলাপ করে তাদের মনোভাব জানার চেষ্টা করতেন এবং মিটিংয়ে যে সকল মতামত উপস্থাপন করার চেষ্টা করতেন। তাঁর বাসা-বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সদালাপ ও চা পান ব্যতিত কেউ ফিরতেন না। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তথা জিয়া পরিবারের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল অপরিসীম। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখনও তিনি বিছানায় শুয়ে নেতাকর্মীদেরকে নেত্রীর জন্য কিছু করার পরামর্শ দিতেন। দেশনেত্রীর যেদিন মামলার তারিখ থাকতো সেদিন শুয়ে শুয়ে টেলিভিশনের দিকে লক্ষ্য রাখতেন, মাঝে মাঝে নেতা-কর্মী এবং আইনজীবীদের ফোন করে খবর নিতেন। যখন শুনতেন নেত্রীর জামিন হয়নি তখনই তিনি নীরব নিথর হয়ে যেতেন। অবশেষে নেত্রীকে শেষ বারের মতো মুক্ত না দেখার যন্ত্রণা নিয়েই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন তিনি। আজ দেশে বিভিন্নভাবে অনেকেই নেতা হচ্ছেন, কিন্তু তরিকুল ইসলামের মতো ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজপথে সংগ্রাম করে নেতৃত্ব সৃষ্টি এখন প্রায় বিলীনের পথে বিধায় রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের মধ্যে মমত্ববোধ এবং ভ্রাতৃত্ব নিঃশেষের পথে। আগামী দিনে তরিকুল ইসলামের মতো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি যতো বিলীন হবে দেশের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাসহ শোষিত মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের পথ ততো বেশি বিলীন হবে। তাই দেশ ও দলকে এগিয়ে নিতে তাঁর মতো একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ তৈরি করতে হবে। বারবার।
লেখক ঃ
মোঃ তাইফুল ইসলাম টিপু
সহ দপ্তর সম্পাদক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।

তিনি যশোরের তরিকুল ইসলাম
কাজী মুনিরুল হুদা

রাত প্রায় ৮টা। হঠাৎ মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নাম উঠেছে নার্গিস ভাবি। অধ্যাপক নার্গিস বেগম। বর্তমানে দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার সম্পাদক। স্মরণ করিয়ে দিলেন, সামনে লোকসমাজ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং তারপর সাবেক মন্ত্রী জননেতা তরিকুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী। এই উপলক্ষে লোকসমাজ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বেরুচ্ছে লেখা দিতে হবে। এক সময় লোকসমাজ পত্রিকায় প্রচুর লিখেছি। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়ে ক্ষুদ্র চিন্তায় যা ভাবতাম যা চিন্তা করতাম তাই লিখতাম। এখন বার্ধক্যে চিন্তা আছে, কিন্তু লেখার চর্চা নেই। পত্রিকার সম্পাদকের চাহিদাকে পাশ কাটানো যায়, কিন্তু বড় বোনতুল্য ভাবির অনুরোধতো এড়ানো যায় না, তাই অনেকদিন পর আবার কলম ধরতে হলো।

গণমাধ্যম এত শক্তিশালী যে অনেক ধনী ও সামরিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্র পর্যন্ত গণমাধ্যমের নামে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় ধনীদেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন এবং ওমান সামরিক ক্ষমতাধর সৌদি আরবের নেতৃত্বে ২০১৬ সালে কাতার অবরোধ করেছিল। দাবি ছিল কাতারের ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করা, কাতার থেকে ইরানের সামরিক প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করা এবং কাতার নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত ইলেকট্রোনিক মিডিয়া আল-জাজিরাকে চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে হবে।
আলজাজিরা সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনামূলক সত্য সংবাদ আরব রাষ্ট্রসমূহ ও মুসলমানদের স্বার্থে প্রচার করে আসছে। সৌদি জাট বহুদিন ধরে গোপনে আরব ভূখন্ড তথা ফিলিস্তিন জবরদখলকারী, লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনী মুসলিম হত্যাকারী অবৈধ ইহুদী রাষ্ট্রের সাথে আঁতাত করে আরব ও মুসলিম স্বার্থ নস্যাৎ করে আসছিল যা আলজাজিরা বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ করতে শুরু করলে সৌদি জোট ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অথচ, আজ দিবালোকের মত সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, সৌদি জোট মজলুম ফিলিস্তিনী ও বিশ্ব মুসলিম স্বার্থ ধ্বংসকারী ইহুদীবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের কাছে তথাকথিত বন্ধুত্বের নামে আত্মসমর্পণ করেছে।
বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। প্রতিবেশী কারও অধীনস্ত বাংলাদেশ নয়। বিশ্বে কারও তাবেদার বাংলাদেশ নয়। যদি তাই হয়, তবে এটাতো সত্য যে, অন্য সকলের থেকে বাংলাদেশ আলাদা। তার জনগণের চিন্তা বিশ্বাস আচার-আচরণ মুখের জবান ভাষা সংস্কৃতি প্রতিবেশীদের থেকে পার্থক্যশীল। পরিচয় আলাদা, জনমানুষের স্বার্থ আলাদা, বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড আলাদা। গোটা জাতির চাহিদা ভিন্ন। স্বাভাবিকভাবে বালাদেশের দর্শন, রাজনীতি ও জাতীয় স্বার্থ অন্য রাষ্ট্র থেকে ভিন্নতর। কথিত বন্ধুত্বের আচরণে জাতীয় স্বাতন্ত্র্য, স্বার্থ ও লক্ষ্য মুছে ফেলা যায় না।
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দর্শন ও রাজনীতি যত মজবুত ও প্রসারিত হবে, বাংলাদেশ তত নিরাপদ হবে। জননেতা তরিকুল ইসলাম তার এই বিশ্বাস আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অর্থাৎ তার মূল কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেয়া, জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, অত্র অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নসহ সার্বিক কল্যাণ এবং প্রতিপক্ষের মিথ্যা ও ভ্রান্ত প্রোগান্ডা মোকাবেলা করতে মিডিয়ার দুর্দান্ত ভূমিকার কথা মাথায় রেখে যশোর থেকে দৈনিক লোকসমাজ প্রকাশ করেছিলেন।
বাংলাদেশে এখন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা, চর্চা ও প্রচারণা চলছে। জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী সকল কর্মকান্ড প্রতিরোধ-চেতনার যে মশাল লোকসমাজ গত ২৪ বছর জ্বালিয়ে রেখেছে তা আজকের ঝঞ্ছা বিক্ষুপ্ত দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশে বাতিঘর হয়ে পথ দেখাচ্ছে। এটাইতো তরিকুল ইসলামের দূরদৃষ্টির ফসল। তরিকুল ইসলামের এই ইতিবাচক কাজকে স্বীকার ও প্রশংসা না করলে দেশের প্রতি আমাদের নিজেদের ভালোবাসাকে ছোট করা হবে।

সারাদেশে আজ অসহিষ্ণু পরিবেশ। এর প্রধান কারণ অসহনশীল নেতৃত্ব। নেতারাই অস্থির ও উত্তেজিত। নেতা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। সবাইকে সাথে নিয়ে চলা, সবার মাঝে সমন্বয় করে ঐক্যগড়া এবং সবার প্রতি সহনশীল থাকা তার নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য।
জননেতা তরিকুল ইসলামকে কখনও দেখিনি, যারা তার বিরোধিতা করেছে তাদের প্রতিশোধ নিতে বা তাদের বিরুদ্ধে চরম কোন ব্যবস্থা নিতে। সহকর্মীদের মধ্যে চক্রান্তকারী ও বিরোধীতাকারীরা যতবার অপতৎপরতা চালিয়েছে এবং তারপর যারা বুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে, ততবারই তরিকুল ইসলামকে ক্ষমা করতে দেখেছি। সমকালীন রাজনীতিতে এই গুণ বিরল বটে। দলমত নির্বিশেষে বন্ধুদের প্রতি তার দুর্বলতা সর্বজনবিদিত।
যশোরের মানুষ রাত ১২টায়ও দেখেছে শহরের কোন অঞ্চল তা চাঁচড়া হোক বা রেল বাজার, চৌরাস্তা, হাইকোর্ট মোড়, নিউমার্কেট, আর এন রোড, গাড়িখানা, চিত্রার মোড়, দড়াটানা, হাসপাতাল মোড়, অথবা বকচরসহ শহরের বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়কের পাশে কোন দোকানে বা প্রশ্বস্ত কোন জায়গায় তরিকুল ইসলাম বসে আছেন এবং তাকে ঘিরে সেই রাতের মানুষ আলাপচারিতা করছে। না সেগুলো কোন মিটিং, নয়, মিলন সমাবেশ।
তরিকুল ইসলাম মন্ত্রী থাকুন বা এমপি থাকুন। দলের কেন্দ্রীয় নেতা থাকুন বা না থাকুন অথবা পৌর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করুন বা না করুন শীত হোক, গ্রীষ্ম হোক, অথবা বর্ষাবাদল তাকে সব সময় মানুষের সাথে মানুষের মাঝে মেলামেশা করতে দেখা গেছে। আমৃত্যু তার এই স্বভাব বদলায়নি। এমনকি দেশে যত রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে, সন্ত্রাসবা নাশকতা চলেছে, সব সময়ই মানুষের মাঝে ঘন্টার পর ঘন্টা তার খোলামেলা অবস্থান আমাদের দৃষ্টি কেড়েছে। এর জন্য সাহস লাগে। একেই সাংসিকতা বলে। জননেতা তরিকুল ইসলামের এই সাহসিকতার জন্ম মানুষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থেকে।

মাত্র একযুগ আগের কথা। যশোরের রাজনৈতিক অঙ্গনের সকল দল তথা ডানবাম মধ্যম ও ইসলামী দলের নেতা-কর্মীরা যে কোন সামাজিক, রাজনৈতিক অঙ্গনে একসাথে বসতেন। কথা বলতেন। এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সহঅবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হতো এবং হয়েছে। রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকুন, না থাকুন এ বিষয়ে সব সময় অপরিসীম আন্তরিক ভূমিকা পালন করেছেন।
এর জন্য একজন মানুষের মধ্যে যে গুণটি প্রয়োজন হয় তা সহমর্মিতা মানুষ মানুষের জন্যে সেটি তার ভেতরে ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শত্রুতা থাকেনি, থাকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা। সেখানে ঘৃণা বা হিংসা বিদ্বেষের স্থান নেই। সেখানে রাষ্ট্র গঠন ও জাতি কল্যাণে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য বর্তমান রাজনীতি শত্রুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষের ওপর রচিত করা হয়েছে।
ব্রিটিশ ভারতে যশোর বাংলার প্রথম জেলা হিসেবে সৃষ্টি হয় ১৭৮১ সালে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই শ বছর আগে। তখন বৃহত্তর খুলনা জেলা ছিল যশোর জেলার অন্তর্গত। বাংলার প্রথম জেলা যশোরের তখনকার ভৌগোলিক এলাকা ছিল বর্তমান যশোর জেলা (ভারতের বনগাঁ মহাকুমাসহ) বর্তমান ঝিনাইদহ জেলা, মাগুরা জেলা ও নড়াইল জেলা (ফরিদপুর জেলার বর্তমান আলফাডাঙ্গা থানাসহ) এবং বর্তমান খুলনা জেলা, বাগেরহাট জেলা ও সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়ে বৃহৎ ভূখন্ড। যার পরিচালনা কেন্দ্র ছিল যশোর শহর।
যশোর শহরে ইংরেজী ১৮৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর জিলা স্কুল। ১৮৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাবলিক লাইব্রেরি। অ্যাডভাকেট বার অ্যাসোসিয়েশন ১৭৮৪ সালে যশোর শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। যশোর পৌরসভা ঘোষিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৪ সালে।
সুপ্রাচীন বৃহৎ এই জনপদ ঐতিহ্যবাহী ও বর্ধিষ্ণু যশোর জেলা ব্রিটিশ আমল থেকেই এর ঐতিহ্যের সাথে উন্নয়নের একটা ঘাটতি ছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হবার পর যশোর অভিভাবক ও নেতাশূন্য হয়ে আরও অবহেলিত হয়ে পড়ে। প্রাচীনতম জেলা হিসাবে সকল সরকারি বিভাগীয় অফিস ছিল যশোরে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণবঙ্গের সকল প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকান্ড হবার কথা যশোরকে কেন্দ্র করে। তা হয়নি। কারণ, আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। ইতিহাসের এই শিক্ষার/অভিজ্ঞতা যশোরবাসী প্রায়শ উপলব্ধি করে।
জনাব খান এ সবুর ছিলেন পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী খুলনার অধিবাসী। তিনি সরকারি ক্ষমতায় খুলনাকে বিভাগ বানালেন। খুলনায় বিশাল শহর গড়ে তুললেন। যশোর থেকে প্রায় সকল সরকারি বিভাগীয় অফিস খুলনায় স্থানান্তর করলেন। মিল কলকারখানা খুলনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে লাগলো। এই অবস্থা চললো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে যশোরে কোন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। ইতিহাসের এই আলোচনা খুলনার প্রাপ্তি বিদ্বেষ ও ঈর্ষা থেকে নয় যশোরের মর্যাদা ও উন্নয়নকে বহাল রেখেই খুলনা গড়ে তোলা যেতো, তাহলে আমরা এই অঞ্চলে অন্তত দুইটা সমৃদ্ধ জনপদ পেতাম।
যশোরের সন্তান তরিকুল ইসলাম ১৯৭৯ সালে প্রথমবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে যশোর একজন উন্নয়নকামী বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতার দেখা পেলো। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জনাব তরিকুল ইসলাম ৩ দফায় মোট ৫ বার বাংলাদেশে মন্ত্রীত্ব করাকালীন প্রতিদিন যশোর জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নে সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এই উন্নয়ন প্রশাসনিক ও কাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন।
উন্নয়নের খুব সংক্ষিপ্ত বিবরণ
আমি যখন ঢাকায় গেছি, থেকেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। তারা যখন পরিচয় পেয়েছে আমি যশোরের সন্তান তখন প্রথমেই যার কথা জানতে চেয়েছে তার নাম তরিকুল ইসলাম। কয়েকবার বিদেশ যাওয়ারও সুযোগ হয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশীরা আমার বাড়ি যশোরে জেনে তরিকুল ইসলামের কথা জানতে চেয়েছে। আসলে তরিকুল ইসলামের পরিচিতি সারা জীবন মানুষের সাথে পরিচয় সহযোগিতা সহমর্মিতা বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের কারণে হয়েছে। মানুষের পাশে থাকাই ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। কোন সন্দেহ নেই। তরিকুল ইসলাম দীর্ঘকাল দক্ষিণ বাংলার ইতিহাসে ও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।
যশোরের রাজনীতিতে বিগত এক শতাব্দীর ফ্রেমে জাতীয় পরিচয় নিয়ে ৩ জন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের নাম লিখতে গেলে অবশ্যই তরিকুল ইসলামের নাম উচ্চারিত হবে। তাকে যশোরের কৃতী সন্তান সম্ভাষণের ন্যায্যতা আছে।
তরিকুল ইসলাম স্থায়ীভাবে জাতীয় নেতাদের কাতারে থাকার সুযোগ পেয়েও থাকতে চাননি। বিষয়টি আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি যশোরের তরিকুল হিসেবে থাকতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। এই প্রসঙ্গে কবি মধুসূদনের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি ইউরোপে বসবাস করার জন্য বিদেশ পাড়ি দিলেন। ইংরেজি ভাষার বড় কবি হবেন। থাকলেনও বেশ কিছুকাল। কিন্তু বিদেশতো আপন নয়। ফিরে এলেন বাংলায়। মানুষ শুধালো মাইকেল মধুসূদন জবাবে তিনি বললেন, আমি মাইকেল মধুসূদন নই। আমি শ্রী মধুসূদন দত্ত। তরিকুল ইসলামের ক্ষেত্রে এটিই প্রযোজ্য। তিনি যশোরের তরিকুল।

‘তুমি আছো হৃদয়ে’
মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী বেগম

তরিকুল ইসলাম শুধু একটি নাম নয়। একটি প্রতিষ্ঠান। শ শ, লক্ষ কোটি মানুষের মনের মধ্যে, কাজের মধ্যে বিলীন হয়ে আছেন এই মানুষটি। কান পাতলেই ইট, কাঠ, পাথর, বালি, আকাশে-বাতাসে, মানুষের হৃদয়ের ধুক-ধুকানীতে শুধু এই মানুষটির নামই শোনা যাবে। তরিকুল ইসলাম, তরিকুল ইসলাম, তরিকুল ইসলাম।  কোথা থেকে শুরু করবো, কোথা গিয়ে শেষ করবো, কিছুই জানি না। কারণ তরিকুল ইসলাম এর শুরু আছে, শেষ নাই। কোন কাজটির কথা বলবো, কোন কাজটি বাদ দেবো, তারতো শেষ নাই। তরিকুল ইসলামের মতো মানুষদের তো শেষ নাই। বাহ্যিক জীবনে আল্লাহর নিয়মে মৃত্যুর মাঝে জীবন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার কর্মময় জীবন পেছনে চলতেই থাকে।
আমার কাছে আমার তরিকুল ভাই, আমার। আমার মনে হয় যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে তরিকুল ভাই তাদের নিজেদের ভালোবাসার বন্ধনে ছড়িয়ে আছে। তাদের দৃষ্টিকোণে, আমি ফেরদৌসী বেগম ছিলাম তরিকুল ভাই-এর বড় ভাই নুরুল ইসলাম সাহেবের শালার বউ। আমাকে স্নেহ করতেন, আদর করতেন। আমি রাষ্ট্র বিজ্ঞানে বিএ, অনার্স, এমএ পাশ ছিলাম। একজন গৃহিনী ছিলাম। তরিকুল ভাই তার সুক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন যে, এই শিক্ষিত মেয়েটি দেশের, সমাজের কিছুতো কাজে লাগাতে পারে। তাই তিনিও নার্গিস ভাবি আমাকে জাতীয়তাবাদী দলের মাধ্যমে দেশ ও সমাজের মঙ্গলের কাজে জড়িত করেন নিয়োজিত করেন। যিনি, দেশের মঙ্গল চান, মানুষের মঙ্গল চান, তিনি যেভাবেই হোক যার মাধ্যমে হোক সেটা মানুষের ভালোর জন্যই করেন।
তিনি ছিলেন দক্ষিণবঙ্গের রাজনৈতিক অঙ্গণের সিংহ পুরুষ। তাইতো স্বাধীনতার ঘোষক, জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপযুক্ত ব্যক্তিকেই নিজের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের তরিকুল ভাইকে খুঁজে নেন। তরিকুল ভাই ছিলেন জিয়াউর রহমানের বিশ্বস্ত সাহসী, সুদৃষ্টি সম্পন্ন, সাহসী সিপাহসালার, শক্ত খুঁটি। দক্ষিণ বঙ্গের জাতীয়তাবাদী দলের ছাদ। যতদিন জিয়াউর রহমান জীবিত ছিলেন ততদিন তরিকুল ইসলাম যোগ্য নেতা হিসাবে সকল ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে কাজ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন রাজপথের লড়াকু সন্তান, সময়ের সাহস্যী নেতা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বন্দী হওয়ার পর এই নেতার ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মুখের কাঁচা দাঁতগুলোতে একটি একটি করে সাঁড়াশী দিয়ে টেনে উপড়িয়ে ফেলেছিল। কি অমানসিক যন্ত্রণা, কষ্ট সহ্য করেছেন, আমার নেতা, ভাবতে গেলে গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে শিহরে উঠে, দু চোখ পানিতে ভরে যায়। হৃদয় ফেটে যায়, নেতা চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে, ব্যথা থেকে গেছে আমাদের মাঝে, জনতার মনে।
প্রেসিডেন্ট জিয়া শহীদ হওয়ার পর জাতীয়তাবাদী দলকে শক্তভাবে ধরে রাখার জন্য,রাশ টেনে ধরার জন্য সিনিয়র যে নেতারা অল্প বয়সী জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সামনে নিয়ে আসেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত করেন তাদের মধ্যে তরিকুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম একজন নেতা।
অনেক আন্দোলন, অনেক লড়াই, মিছিল মিটিং বিপদ-আপদে বেগম জিয়ার পাশে ছায়ার মত থেকেছেন। যখন বিএনপির যৌবনকাল পূর্ণ ক্ষমতায়, সরকারি দল তখন বেগম জিয়া এই নেতাকে সম্মানিত করেছেন, মূল্যায়ন করেছেন, বিশ্বাসের বড় জায়গা ভেবেছেন, বিশ্বস্ত কান্ডারী হিসাবে বারবার মন্ত্রিত্বে আসীন করেছেন। আমার মনে আছে, টাউন হলের ময়দানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে নির্বাচনের আগে ধানের শীষ তুলে দিয়ে আমার নেতার হাতে ‘বলেছিলেন আমার বিশ্বস্ত, স্নেহের তরিকুল ইসলামের হাতে আমি ধানের শীষ তুলে দিলাম, আপনারা বিজয়ী করে আনেন, যে পদ আপনারা চাইবেন আমি সেই পদই দেব, এই আমার অঙ্গীকার।’ কথাটি আজও কানে বাজে।
যতবার সাবেক এই তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণবঙ্গে এসেছেন, ক্ষমতায় থেকে বা বিরোধী দলে থেকে ততবার তরিকুল ভাইকে বিশ্বাস করতেন ভরসা পেতে, নিরাপদ মনে করতেন, তাই, খুলনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা ঘুরে যশোর সার্কিট হাউজে এসে রাত কাটতেন। তরিকুল ইসলামের যশোরকে তিনি নিরাপদ আশ্রয় মনে করতেন। সরকারি দলের মন্ত্রী থাকাকালে কোনদিন তিনি কোন অন্যায় কাজ করেন নাই। আওয়ামী লীগ এর কোন নেতা বা ছাত্র লীগ যুবলীগ কাউকেই তিনি ক্ষমতার জোরে ক্ষতিগ্রস্ত করেন নাই, মামলা, হামলা দিয়ে ঘরছাড়া করেন নাই। আমার মনে আছে, একদিন তার খুব কাছের একজন বলেছিলেন ভাই ওমুক আমার ক্ষতি করেছে, আপনি ওর চাকরিটা নষ্ট করে দেন।
ভাই বলেছিলেন, আমি কারুর পেটে লাথি দিতে পারবো না। নেতা বরং কত লোকের চাকরি দিয়েছেন তা গুণে শেষ করা যাবে না। আমার মনে আছে, একদিন আমাদের ২ নং ওয়ার্ডের হৃদয়ের বই-এর সরকারি প্রাইমারি স্কুলের চাকরি দেওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়ে তার বাড়ি থেকে কাগজপত্র এনে স্কুলের চাকরি দেন। আমার নেতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। উন্নয়ন, অবদান এর কথা বলে শেষ করা যাবে না। তাই ওইদিকে যাওয়ার সাহস আমার নেই। ভাই যখন মন্ত্রী থাকতেন তখন আমাদের মহিলা দলের অনেক মজা হতো। কারণ, ভাই-এর পিছে পিছে একখানা সরকারি গাড়ি করে আমরা ভাই সেখানে যেতেন মহিলাদল আবদার করে সেখানেই যেত, সাগরদাঁড়ি মাইকেল-এর বাড়ি, নড়াইল সুলতানের মেলা,
খুলনা, যশোর সব জায়গা মহিলা দল, একবার ভাবি বোর্ডের কাজে বরিশাল গেলেন, আমরা আব্দার করে ভাইকে রাজি করে কুয়াকাটা পর্যন্ত বেড়াতে গেলাম। খুব মজা ছিল, বিরোধী দলে থেকেও ভাই আমাদের নিয়ে। অনেক গল্প করতেন, নাস্তা খাওয়াতেন, ভাবিতো ছিল, কিন্তু ভাইতো ভাই-ই-, মনে পড়ে ঘোপের বাদল বলেছিল, আমাকে ভাবি, তরিকুল ভাই মন্ত্রী থাকাকালে আমি একটা কাজে মন্ত্রীর ঢাকার বাসায় গিয়েছিলাম, ভাই আমাকে দেখে, তখন সকাল, বল্লেন আয় আমার সাথে নাস্তা খা। নাস্তা খেয়ে ভাই আমাকে ভাই-এর মন্ত্রীর গাড়ি করে সচিবালয়ের মন্ত্রীর অফিসে নিয়ে কাজ করে দিয়েছিলেন। এতো বড় মন, এতো উদার কয়জন মানুষ হয়। ভাই এর অভাব পূরণ হবে না, তাই এর অভাব থেকেই যাবে নাকি ? অনিন্দ্য ইসলাম অমিত আমাদের সেই অভাব পূরণ করবেন। ‘অমিতের মধ্যে এই অল্প সময়ে আমরা আল্লাহর রহমতে ভাই-এর অনেকখানি দেখতে পেয়েছি। দোয়া করি, আল্লাহর কাছে অমিতের জন্য। জনমানুষের নেতা হোক, গরিব দুঃখীর নেতা হউক, অসুস্থদের পাশে থাকুক, দেশ গড়তে এগিয়ে চলুক। সাথে সুমিত ও ভাবি দুইজনই থাকুক।’
আমার নিজের আর একটি মনের কথা বলি, যেটা আমাকে অনেকখানি সুস্থ করে তুলেছিল। ১/১১ এর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলো। আমরা বিএনপি হেরে গেলাম। ভাই হারলো। তারপরই উপজেলা নির্বাচনে আমি ভাইস চেয়ারম্যান ইলেকশান করলাম। ১ লক্ষ ২৫ হাজার ভোট পেলাম, কিন্তু আমাকে জিততে দিল না। খুব কেঁদেছিলাম, ভাই আমাকে কাছে বসিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তুমি কাঁদবে না। তুমি ১ লাখ ২৫ হাজার জনগণের প্রতিনিধি। তারা তো তোমায় ভোট দিয়েছে।’ এই কথাটি বলার জন্য আর কি ভাইকে পাবো? এখনও ভাই-এর বাড়ি আগের মত যাই। কিন্তু ভাই নাই, ভালো লাগে না।
সামনে এখন নতুন প্রজন্ম শক্ত হাতে দলের হাল ধরবে। অনেকটা সামনে তারা এগিয়েও গেছে। জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান নতুন প্রজন্ম এবং পার্টির শক্ত হাতে পার্টির হাল ধরেছেন। যার ধমনীতে বইছে দুই প্রধানমন্ত্রীর উত্তপ্ত উষ্ণ রক্তধারা। তাকে ঠেকাতে এমন শক্তি স্বৈরাচার, অবৈধ, অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক আওয়ামী সরকারের সাহস কি ? ভাবাই যায় না, তাই তারুণ্যের অহঙ্কার, সময়ের সাহসী সন্তান নতুন প্রজন্মের সিপাহসালার তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশ ইনশাআল্লাহ সামনে এগিয়ে যাবে নতুন গণতন্ত্রের দিকে। যে গণতন্ত্র দেশের মানুষকে দেবে শান্তি, ন্যায্য বিচার। যে গণতন্ত্র দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বতা রক্ষা করবে। তরিকুল ভাই-এর যশোর থেকে নেতৃত্ব গড়ে তুলবে আমাদের সকলের নয়নের মনি, তরিকুল ইসলাম ও নার্গিস বেগম সুযোগ্য কনিষ্ঠ পুত্র যার ধমনীতে বইছে এই দুই নেতার উষ্ণ রক্তের ধারা সেই সুবক্তা সাহসী রাজপথের লড়াকু সৈনিক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।
আমার কেন যেন মনে হয় খুব কম সময়ের মধ্যে তরিকুল ভাই অসুস্থ হলেন এবং একেবারে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। সবাইকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে। এখনও মনে হয়, আমি ভাইকে হসপিটালে লাইফ সার্পোটে যখন ছিলেন দেখে, কত ভাই, ভাই, করে ডেকেছিলাম। কিন্তু আর কোন সাড়া দিলেন না। আমি আদর করে হাত কপালে একটু ছোঁয়া লাম। এই শেষ। তার পরদিন বিকালে ভাই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। পরদিন ভাইকে নিয়ে সবাই যশোরে চলে আসলাম। যশোরবাসী তখন অভিভাবকহারা চিরতরে।
আজ দেশের এই বিশৃঙ্খলার মুহূর্তে এই ধর্ষণের প্লাবনে ভাইকে নতুন করে মনে হচ্ছে। ভাই যশোর ছাড়া বেশিদিন ঢাকাতে থাকতে পারতেন না। ভাবি বলতো, আপনার ভাই ঢাকা থেকে যশোর এয়ারপোর্টে নেমেই বলতো আমাকে বটতলায় আরা মেডিক্যালে নামিয়ে দিবে। এখানে নেমে শান্তি পেতেন। কিন্তু এই তরিকুল ভাই মা-বোনদের সব সময় ইজ্জত করতেন। সব নেতাকর্মীদের নিয়ে বসে থাকতেন গোল হয়ে। আসরে আমি, শেলী, সুফিয়া আনু আমরা মাঝেই সালাম দিতে যেতাম। গেলে আদর করে বলতো, তোমরা বাসায় যাও, তোমার ভাবির কাছে।
আজকে নারীর সম্মান কোথায় ? নারীকে সেভাবে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করে আবার কেটে চার টুকরো করছে, গলা টিপে অ্যাসিড দিয়ে মেরে ফেলছে নারীর সম্মানকে দেবে একবার বলে যান তরিকুল ভাই। আমাদের।
মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী বেগম
সভানেত্রী নগর মহিলা
যশোর।

আমার চোখে জননেতা তরিকুল ইসলাম
মো. শহীদ আনোয়ার (অ্যাড.)

আমাদের আপা নার্গিস বেগম টেলিফোনে আমাকে জানালেন, তরিকুল ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একটা স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। আমাকে একটা লেখা দিতে হবে। তাঁর অনুরোধেই আমার এই প্রচেষ্টা।
স্কুল জীবন থেকেই আমি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। ১৯৬৫ সালের দিকে আমি, তোতা, ধীরা, অশোক চক্রবর্তীসহ আরও অনেকে যখন সম্মিলনী ইন্সটিটিউশনে নবম শ্রেণিতে পড়ি, ওই সময় যশোর এমএম কলেজ থেকে একদিন আমাদের স্কুলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) নেতা মোস্তফা ভাই, শহীদ দীপু ভাই, শহীদ নজরুল ভাই, শহীদ মানিক ভাইসহ আরও অনেকে এসে আমাদেরকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) সম্মিলনী ইন্সটিটিউশন ইউনিটে সংগঠিত করেন। সেই থেকে আমার ছাত্র রাজনীতি শুরু। ১৯৬৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা পাশ করার পর আমরা এমএম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ১ম বর্ষে ভর্তি হই এবং ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) কর্মী হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় থাকি এবং সংগঠনের প্রতিটা কর্মসূচিতে অংশ নিতে থাকি। আমরা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শুনি তরিকুল ভাই, টিটো ভাই, আসাদ ভাই, নূর মোহাম্মদ ভাই, মতিন (মুনির) ভাই, শরীফ স্যার, হাই স্যারসহ আরও অনেকে যশোর সেন্ট্রাল জেলে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে বন্দী আছেন আমি ১৯৬৭ সালের দিকেই জানতে পারি, তরিকুল ভাই ১৯৬৩ সালে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, আব্দুল মতিন (মুনির) ভিপি। তখন যশোর এমএম কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর নেতৃত্ব দিতেন নার্গিস আপা, দীপু ভাই, মোস্তফা ভাই, নজরুল ভাইসহ অনেকে। তরিকুল ভাইয়েরা ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে জেলখানা থেকে বের হন। তখন আমরা সবাই তরিকুল ভাই, টিটো ভাই, এনামুল ভাই, আসাদ ভাইদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হই এবং ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসাবে কাজ করতে থাকি। ১৯৬৯ সালে এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ভিপি হিসাবে আসাদ ভাই, প্রো-ভিপি হিসাবে আমি এবং জিএম হিসাবে জাকারিয়া মিলন ভাই নির্বাচিত হই।
আমাদের ওপরের নেতৃত্বে তরিকুল ভাই, নার্গিস আপা, নূর মোহাম্মদ ভাই, মতিন (মুনির) ভাই, দীপু ভাইসহ আরও অনেকে ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করার সময় আমি, তোতা, ধীরা, অশোক চক্রবর্তী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত হই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমি মনিরামপুর ঝাঁপার দিকে চলে যাই। তরিকুল ভাই টিটো ভাই, ফিরোজ ভাই কলকাতায় চলে যায়। নূর মোহাম্মদ ভাই, দীপু ভাই, বিমল বিশ্বাস পুলুম অঞ্চলে গিয়ে পাক আর্মিকে প্রতিরোধ করার জন্য সংগঠিত হয়ে রাজাকার ও পাক আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা সকলে যশোরে ফেরত আসি। তরিকুল ভাই, টিটো ভাই, আলমগীর সিদ্দিকীসহ তখন অনেকে ন্যাপ (ভাসানী) করতেন। আমি, তোতাসহ অনেকে ন্যাপ-এর সাথে সম্পর্কিত ছিলাম। ১৯৭২ সাল থেকে টিটো ভাই, তরিকুল ভাইদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা আরও গভীর হয়। তখন যশোরে কমিউনিস্ট পার্টি শক্তিশালী থাকলেও তারা সবাই গোপনে ছিলেন। তখন তরিকুল ভাই, টিটো ভাই, আলমগীর সিদ্দিকী, আফসার সিদ্দিকী আমাদের নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালে আমার বাবা পাক আর্মি কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে শহীদ হলে আমি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্ক থাকলেও তখন তরিকুল ভাই, টিটো ভাইদের সাথে আমরা বেশি সম্পর্ক রাখতাম। ১৯৭৪ সালের দিকে যশোর পৌরসভার নির্বাচন আসলে তরিকুল ভাই ভাইস চেয়ারম্যান এবং আফসার আহমেদ সিদ্দিকী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিন করেন। আমরা তরিকুল ভাই ও আফসার আহমেদ সিদ্দিকীর পক্ষে কাজ করি। আফসার আহমেদ সিদ্দিকী খুব মারজিনাল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও তরিকুল ভাই ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বািচত হন। ১৯৭৭ সালে আবার পৌর নির্বাচন হলে তরিকুল ভাই এবং আফসার আহমেদ সিদ্দিকী উভয়েই চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করেন। আমরা সবাই বিশেষ করে আলমগীর সিদ্দিকী, টিটো ভাইসহ কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে তরিকুল ভাইয়ের সমর্থনে নির্বাচন করি। নির্বাচনে তরিকুল ভাই বিপুল ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এইভাবে তরিকুল ভাই ছাত্রজীবন থেকে আস্তে আস্তে জনগণের নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগ এর বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করলে আমরা ভাসানী ন্যাপসহ সবাই জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দেই এবং জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করি। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে তরিকুল ভাই বিএনপিতে যোগদান করেন এবং টিটো ভাই গণতান্ত্রিক পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরিকুল ভাই যশোর সদর আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান সামরিক ক্যুতে মৃত্যুবরণ করলে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তরিকুল ভাই এ সময় সাত্তার সাহেবের অধীনে প্রতিমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্যু করলে সাত্তার সাহেবের পতন হয়। এর কিছুদিন পর এরশাদের খুনের চেষ্টা মামলায় তরিকুল ভাইকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে এবং দীর্ঘদিন তাঁর কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। সে সময় বিবিসিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত খবর প্রচার করে। এর পর পরই সেনাবাহিনী তরিকুল ভাইকে জেলে দিয়ে দেয়। ১৯৮৪ সালের কিছু আগে উনি জেল থেকে মুক্ত হন।
এইভাবে তরিকুল ভাই যশোরের একজন জনপ্রিয় জননেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। জনগণের সাথে বিবরণ করেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় গেলে তরিকুল ভাই বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৮০ সালের দিকে তরিকুল ভাই যখন এমপি তখন আমরা আরএন রোডে সন্দীপন পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় তরিকুল ভাই মুখ্য ভূমিকা রাখেন। সন্দীপন পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রদানের সময় তরিকুল ভাই আমার স্ত্রীকে ওই স্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত করেন। ১৯৯২ সালের দিকে আমরা আরএন রোডের কিছু ব্যক্তি যশোর কলেজ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু সরকারী সহযোগিতা ছাড়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলে তরিকুল ভাইকে বলি। আমরা নার্গিস আপাকে সভাপতি করে নতুন করে কলেজ কমিটি করি। যশোর কলেজের নিজস্ব কোন জায়গা না থাকায় তরিকুল ভাই আনছার অ্যাডজুটেন্ট অফিস উঠায়ে ওখানে যশোর কলেজের জন্য বরাদ্দ দেন। আমরা নার্গিস আপার নেতৃত্বে যশোর কলেজ পরিচালনা করতে থাকি। যশোর কলেজ ভবিষ্যতে জায়গার সংকুলান হবে না বলে তরিকুল ভাই যশোর বাসটার্মিনালের অদূরে যশোর কলেজের জন্য একটি জায়গা ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। তরিকুল ভাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অত্র এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তার সময়কালে এক সাথে প্রায় তিন শতাধিক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠা এমপিওভুক্ত হয়েছে। যশোর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত ও নির্মাণ কাজ তার সময়কালে শুরু হয়েছিল। যশোর মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্তটিও তার সময়কালে হয়েছে। যশোর কালেক্টরেট ভবনটি পূর্বের নকশা অনুযায়ী ২য় তলায় সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা বা উদ্যোগ যেটাই বলি না কেন সেটা কিন্তু তরিকুল ভাইয়ের চিন্তার ফসল।
লেখক: সমাজ সেবক