২৪ তম প্রতীষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যার একগুচ্ছ লেখা-২

0

সংবাদপত্র ও জেমস অগাস্টস হিকি
পাভেল চৌধুরী
সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক জীবনের কথা কল্পনা করা যায় না। আধুনিক মানুষের প্রাতঃসাথি সংবাদপত্র। সংবাদপত্রে চোখ না রাখতে পারলে দিনের শুরুটাই যেন অপূর্ণ থেকে যায়। যে কারণে যত দিন যা”েছ সংবাদপত্রের প্রভাব প্রসার তত বাড়ছে, যেন একটা আতিœক সম্পর্ক গড়ে উঠছে মানুষের সাথে সংবাদপত্রের। যদিও এই সংবাদপত্র যে খুব প্রাচীন বিষয় তা কিš‘ না। ১৭০৯ সালে ইংল্যা-ে প্রথম নিয়মিত সংবাদপত্র প্রকাশ হতে শুরু করে। অবশ্য ষোড়শ শতকেও ইউরোপের কোনো কোনো দেশে সংবাদপত্র প্রকাশের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আসলে সংবাদপত্রের ইতিহাস মুদ্রণযন্ত্রের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ছাড়া সংবাদপত্রের প্রকাশ সম্ভব ছিল না। হালে বিশ^ব্যাপী যে ইন্টারনেটের প্রসার হলো তাতে সংবাদপত্রের প্রচার ও প্রসার যে কিছুটা হোঁচট খায়নি এমন না কিš‘ যতটা আশক্সক্ষা করা হয়েছিল ততটা না। সংবাদপত্রের আবেদন হ”েছ বহুমুখী, শুধু সংবাদ পরিবেশনই না; সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির প্রচার প্রসারও সংবাদপত্রের অন্যতম লক্ষ্য।
সাধারণভাবে বলা হয় বাংলায় প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্র ছিল সমাচার দর্পণ। শ্রীরামপুরের ব্যপিষ্ট মিশন সোসাইটি থেকে এটা প্রকাশিত হত। সাপ্তহিক। ২৩ মে ১৮১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। দাম; মাসিক ১ রুপি। মধ্যে সপ্তাহে ২ দিন, শনি আর বুধবারে প্রকাশিত হত, দাম দেড়রুপি মাসিক। ১৮২৯ সাল থেকে ইংরেজি বাংলা দুই ভাষাতেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। সম্পাদক র্ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। প্রচার সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০, তখনকার হিসেবে ভালই বলতে হবে। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বরে পত্রিকাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল সম্পাদকের স্বা¯ে’্যর অবনতি, কর্ম ব্যস্ততা। পত্রিকার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে পারছিলেন না তিনি। কিš‘ প্রকৃত ঘটনা হলো যে উদ্দেশ্যে পত্রিকাটা প্রকাশ করা হয়েছিল খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার, সেই উদ্দেশ্য তেমন ফলপ্রসূ হ”িছল না। মধ্যে রামমোহনের সাথে এক ধর্মীয় বাহাস পত্রিকাটিকে বিতর্কিত করেছিল।
কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেন গঙ্গা কিশোর ভট্টচার্য সম্পাদিত ‘বেঙ্গল গেজেটি’ সমাচার দর্পণের আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। বেঙ্গল গেজেটির কোনো কপি পাওয়া যায় না। ১১/৫/১৮১৮, ০১/০৭/১৮১৮ সালে প্রকাশিত ২টা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই পত্রিকা সম্পর্কে জানা যায়। সম্ভবত ১ বছর চলেছিল পত্রিকাটা, মাসে ২রুপি ছিল গ্রাহক চাঁদা। গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য ছিলেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কম্পোজিটর। কলকাতায় এসে ১৮১৬ সালে ফেরিস এ- কোম্পানির প্রেস থেকে তিনি সচিত্র বাংলা বই ‘অন্নদামঙ্গল’ প্রকাশ করেন। এটাই ছিল প্রথম সচিত্র বাংলা বই। কলকাতা শহরে দোকান খুলে বইয়ের ব্যবস্াও তিনি প্রথম শুরু করেন। ১৮১৮ সালে তিনি নিজেই ‘বেঙ্গল গেজেটি প্রেস’ নামে একটা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বেঙ্গল গেজেটি পত্রিকা। এরপর কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসে সেসব পত্রিকার বিশিষ্ট ভূমিকাও আছে। আঠারো শতকের বিশ/ত্রিশের দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত অন্যতম পত্রিকা সমূহ ছিল; ইংরেজি দৈনিকঃ বেঙ্গল হরকরা, ক্রানিকল, কলিকাতা গেজেট; সাপ্তাহিকঃ বেঙ্গল হেরাল্ড, লিটেরারী গেজেট, ওরিয়েন্টাল অবজর্বর; বাংলা সাপ্তাহিকঃ বঙ্গদূত, সমাচার চন্দ্রিকা, সম্বাদ কৌমুদি ইত্যাদি। মজার ব্যাপার সাপ্তাহিক দ্রব্যমূল্যের পত্রিকাও প্রকাশিত হত; কলিকাতা এক্সচেজ্ঞ প্রাইস কারেন্ট, কলিকাতা উইকলি প্রাইস কারেন্ট, ডোমেস্টিক রিটেল প্রাইস কারেন্ট, ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো বিশাল এই ভারতবর্ষে সর্ব প্রথম কে কোথা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিল? জেনে অবাকই হতে হয় শুধু ভারতবর্ষ না, গোটা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। পত্রিকার নাম ছিল ‘বেঙ্গল গেজেট’। প্রতি শনিবার পত্রিকাটা প্রকাশিত হত। প্রকাশক ছিলেন জেমস অগাস্টস হিকি।
হিকির পত্রিকা প্রকাশের ১২ বছর আগে জনৈক ডাচ উদ্যোক্তা উলিয়াম বেন্টিস ভারত থেকে পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিল কিš‘ সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
জেমস হিকির জীবন কাহিনী খুবই বিচিত্র। ১৭৪০সালে আয়ারল্যান্ডে তার জন্ম। লন্ডনে তিনি মুদ্রাকর উইলিয়াম ফেডেনের সংস্পর্ষে আসেন এবং মুদ্রাযন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তারপর তিনি ব্রিটিশ আইনজীবী সার্জেন্ট ডেবির অধীনে চাকরি নেন।
১৭৭২ সালে হিকি কলকাতায় আসেন। তখন তিনি একজন চিকিৎসক আবার সমুদ্র উপকূলে ব্যবসাও করছেন। একসময় বিপুল পরিমাণ দায় দেনায় জড়িয়ে পড়েন তিনি, যার পরিণতিতে ১৭৭৬ সালে তাকে জেলে যেতে হয়। আর জেলখানা থেকেই ২০০০ রুপি দিয়ে তিনি একটা ছাপার যন্ত্র জোগাড় করেন। শোনা যায় জেলে বসে তিনি ছাপার অক্ষরও তৈরি করতেন। জেলখানা থেকে তিনি শুরু করেন ছাপার ব্যবসা। মূলত ফোর্ট উইলিয়মের নথিপত্রই তিনি ছাপতেন। ১৭৭৮ সালে তিনি তার পক্ষে ব্রিটিশ আইনজীবী এটর্নি উইলিয়ম হিকিকে নিযুক্ত করেন এবং জেল থেকে মুক্তি পান।
জেমস অগাস্টস হিকি ছিলেন খুব চড়া মেজাজের লোক। এটর্নি উইলিয়ম হিকির স্মৃতি কথা থেকে হিকির যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় তিনি ছিলেন উৎকেন্দ্রিক জেদি ধরনের, বেপরোয়াও।
২৯ জানুয়ারী ১৭৮০ সাল থেকে বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ হতে শুরু করে। ঠিকানা; ৬৭,রাধাবাজার, কলকাতা, ভারত। পত্রিকাটির ঘোষণা ছিল ‘সকলের জন্য উন্মুক্ত, কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়’ (ড়ঢ়বহ ঃড় ধষষ রহভষঁবহপবফ নু হড়হব)। ধনি গরীবের বৈষম্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির সম্প্রসারণ নীতি, কর বৃদ্ধির মাধ্যমে শোষণ, পদ¯’ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, এসবের বিরূদ্ধে বেঙ্গল গেজেট ছিল সো”চার। পত্রিকা চলছিল ভালই। সেই আমলে ৪০০ কপি ছাপা হত। পত্রিকা থেকে আয়ও খারাপ ছিল না কিš‘ জেমস হিকি এমন সব খবর পত্রিকায় পরিবেশন করতেন যাতে প্রায় সবসময়ই তাকে মানহানির মামলা মোকাবেলা করতে হত।
এর মধ্যে হিকির জন্য একটা অসুখকর ঘটনা ঘটলো। তিনি জানতে পারলেন যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনৈক কর্মকর্তা তার কাগজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। ক্ষুদ্ধ হলেন তিনি। অভিযোগ করলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাইমন ডুজ এবং গভর্ণর জেনারেলের পতিœ মেরিনা হেস্টিংস তার কাছে ঘুষ চেয়েছে।
মেরিনা হেস্টিংস ছিলেন খুবই উন্নাসিক ধরনের মহিলা; কেতাদুরস্ত, কর্তৃত্বপরায়ণাও। হেস্টিংসের পতিœ ুিহসেবে তিনি ছিলেন যথেষ্ট ক্ষমতাধর কিš‘ কলকাতায় বসবাসরত ইউরোপিয় মহিলা মহলে তার তেমন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আর ওয়ারেন হেস্টিংস ফোর্ট উইলিয়াম রেসিডেন্সের প্রথম গভর্ণর জেনারেল, তার দৌরাতœ ছিল সর্বজন বিদিত। হেস্টংসের সুপ্রিম কোর্ট কাউন্সিল হিকির পরিবেশিত খবরে প্রচ- ক্ষুদ্ধ হয়েছিল এবং পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে কাগজ বিতরণ বন্ধ ঘোষণা করেছিল কিš‘ তাতে হিকি নিরস্ত হলো না। স্বয়ং হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তিনি এবার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, আর দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ আনলেন। শুধু গভর্ণর জেনারেল হেস্টিংস না, অন্যান্য বৃটিশ কর্মকর্তারাও এই অভিযোগ থেকে বাদ পড়লো না। অভিযোগের তালিকায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে এবং প্রটেষ্টান্ট মিশনের নেতা জোহান জাকারিয়াস কারমেনজাবও যোগ হলো। হেস্টিংস আর কারমেনজারস সুপ্রিম কোর্টে হিকির বিরুদ্ধে ৩টে মানহনির মামলা করলেন।
সুপ্রিম কোর্ট মনোনিত ১২জন জুরির নানা রকম বিচার বিবেচনায় ৩টে মামলাতেই নির্দোষ ঘোষিত হলো হিকি। কিš‘ জুরিদের এই রায়ে অনা¯’া জানালো সুপ্রিম কোর্ট। অতঃপর পুণরায় নতুন করে জুরি মনোনিত করা হলো এবং ৪ দিনের শুনানি শেষে ৩টে মামলাতেই দোষী সাব্যস্ত করা হলো হিকিকে। ১৭৮১ সালে আবার তাকে জেলে যেতে হলো।
কিš‘ হিকি দমবার পাত্র ছিলেন না। জেল থেকেই তিনি তার সংবাদপত্র প্রকাশনার কাজ অব্যাহত রাখলেন এবং যথারীতি হেস্টিংস ও অন্যান্য বৃটিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ করতে লাগলেন। হেস্টিংস নতুন করে হিকির বিরুদ্ধে কেস সাজালো এবং ৩০ মার্চ ১৭৮২ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হিকির প্রেস বন্ধ করে দেওয়া হলো।
১৭৮৪ সালে জেমস অগাস্টস হিকি জেল থেকে মুক্তি পান। এবারও তার আইনজীবী ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এটর্নি উইলিয়াম হিকি। উইলিয়াম হিকি ছিলেন ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণির মানুষ। তার সাথে জেমস হিকির সামাজিক অব¯’ার তুলনা হয় না। জেমস হিকির আচরণে একাধিকবার তিনি চরম বিরক্ত হয়েছেন, মামলা চালাতে অস্বীকৃতিও জানিয়েছেন কিš‘ শেষ পর্যন্ত তাকে বিমুখ করতে পারেননি। জেমস হিকিকে তিনি প্রতিভাবান মনে করতেন। সেই সাথে মনে করতেন উ”ছৃঙ্খল, অপরিণামদর্শীও।
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর জেমস অগস্টাস হিকি সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে ৩ বছর জেলে থাকায় তার স্বা¯’্য ভেঙে পড়েছিল আর সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছিলেন তিনি। ১৮০২ সালে চীনের পথে এক নৌযানে তার মৃত্যু হয়। জেমস অগাস্টস হিকির কোনো ছবি পাওয়া যায় না তবে পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু সংগ্রহশালায় বেঙ্গল গেজেটের কয়েকটা পাতা আর হিকির স্বাক্ষর সংরক্ষিত আছে। আমরা অবশ্যই জেমস অগাস্টস হিকির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো, কলকাতা থেকে এশিয়া মহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন বলে শুধু না, তিনি পরাক্রম ব্রিটিশ অভিজাত শাসকদের অন্যায় কার্মকা-ের বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতায় কলম ধরেছিলেন, সমাজ বিকাশের ধারায় সেটা অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই।

ধর্ষণের ভয়াবহ সংস্কৃতি
মো. সাখাওয়াত হোসেন
সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে একটি আলোচিত এবং ভয়ংকর প্রত্যয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ধর্ষণের ভয়াবহতায় ভয়ের সংস্কৃতি জনমনে উদ্বেগ এবং আতংকের সৃষ্টি করেছে; কেউই ভয়ের বাইরে নয়। প্রত্যেক পরিবারই তাদের নারী সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত। বাসার বাইরে অবস্থানকালে প্রত্যেকেই ভয়ে তটস্থ থাকেন, তবে ইদানীংকালে গৃহেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে যেটি সভ্য রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জাজনক ও অপমানের। ধর্ষকদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রও ভয়ংকর সংকট ও তদসংশি¬ষ্ট পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হিমশিম অবস্থায় রয়েছে। ভয়ের সংস্কৃতি চতুর্দিকে আবদ্ধ করে সমগ্র বাংলাদেশকে একটি চরম অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে ধর্ষকচক্র ও তাদের দোসররা। এ থেকে উত্তরণে সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়েই ধর্ষকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫ শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ৭২৭টি এবং নারী ধর্ষণের মামলা ছিল ৩ হাজার ৯০০টি। বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ২০১৯ সালে ধর্ষণের কারণে ১২ শিশু এবং ২৬ জন নারী মারা যায়। ২০১৮ সালে ১৪ শিশু ও ২১ নারী মারা যায়। সুতরাং পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ভয়ংকর অবস্থার দিকে ধাবমান হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুণ হয়েছে (ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ও শিশু)। ২০১৮ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৩২টি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিসংখানের মাধ্যমে জানা যায়, ২০১৯ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৯০২টি এবং ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৩৫৬টি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে গড়ে ৮৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, এক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ। ২০১৯ সালে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১ হাজার ৩৮৩ শিশু। কাজেই, বাংলাদেশে ধর্ষণের ভয়াবহতার পরিস্থিতি স্পষ্ট করার জন্য উলে¬খিত সংখ্যাগুলোই যথেষ্ট। এখানে স্পষ্টত উলে¬খ করার বিষয় হচ্ছে, ধর্ষণের সংখ্যা ও এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যাও কিন্তু ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় ধর্ষণ নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে, কেন ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত, কারা ধর্ষকদের মদদ দিচ্ছে, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আদৌ কি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয় গবেষণা থেকে উঠে আসলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেকাংশে সম্ভব হবে।
ভারতীয় গণমাধ্যম জানায়, ঘন্টায় প্রতি ৪ মিনিটে ভারতে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের হাতে মার খান সে দেশের নারীরা। সেখানে শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের পাশাপাশি পণ্যের জন্য অত্যাচার, নারী পাচারের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। এছাড়া পরিসংখান থেকে জানা যায়, প্রতি ২ থেকে ৩ দিনে নারীদের ওপর হয় এসিড আক্রমণ, প্রতি ১ ঘন্টা ১৩ মিনিটে পণ্যের জন্য অত্যাচারে মৃত্যু হয় নারীর। প্রতি ১৬ মিনিটে ধর্ষণের শিকার হয় নারীরা, প্রতি ৬ মিনিটে শ¬ীলতাহানি হয় তাদের। এ কথা নিদ্বির্ধায় বলা যায়, ধর্ষণের ঘটনা প্রকৃতঅর্থে বৈশ্বিক প্রপঞ্চ, প্রত্যেক সমাজে অন্যান্য অপরাধের ন্যায় ধর্ষণের ঘটনাও দেদারছে ঘটে চলছে। পাঠকদের জন্য এখানে একটি বিষয় উলে¬খ করার প্রয়োজন রয়েছে সেটি হচ্ছে পুলিশ নথিতে, পত্রিকার পাতায় কিংবা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখানের মাধ্যমে ধর্ষণের প্রকৃত চিত্র কিন্তু উঠে আসে না। এর বাইরেও অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলছে যেগুলো নানাবিধ কারণে জনসম্মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। অপরাধবিজ্ঞানের ভাষায় সেটিকে ডার্ক ফিগার অব ক্রাইম বলে। ডার্ক ফিগার অব ক্রাইমের কারণে অপরাধের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের গ্রহণীয় ব্যবস্থা আলোর মুখ দেখছে না। জনগণকে সচেতন করে যে কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার মাধ্যমে প্রকৃত চিত্রের আলোকে সরকারের গ্রহণীয় ব্যবস্থা ধর্ষণসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।
পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই ধর্ষণের ঘটনা যে কাউকে আতংকিত করে তুলবে। সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি উলে¬খযোগ্য শিরোনাম হলো, যশোরের শার্শায় ধর্ষণের দায়ে গৃহকর্তার ছেলে গ্রেফতার; লক্ষ্ণীপুরের রামগতিতে বিধবাকে দল বেঁধে ধর্ষণ, ৫ দিনের রিমান্ডে সোহেল-জামাল। সোনারগাঁয়ে চাচাতো ভাইয়ের হাতে ধর্ষণের শিকার শিশু, প্রেমের নামে শিক্ষিকাকে ধর্ষণ; বিয়ের ভয়ে পালিয়েছেন শিক্ষক। ছাত্রীকে দফায় দফায় ধর্ষণের কথা স্বীকার করলো সেই মাদরাসা সুপার। সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণ; এ সংক্রান্ত শিরোনামে বাস্তবতার প্রতিচিত্র উঠে আসে। আপনি, আমি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারব না অমুক বয়সের পুরুষেরা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত; কেননা সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো বিশে¬ষণ করলে দেখা যায়, বৃদ্ধ, যুবক, ধর্মীয় শিক্ষক, ধর্মীয় গুরু, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণ করে হত্যা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিগত কয়েকদিনে সাধারণ জনগণকে বেশ পীড়া দিচ্ছে। এর থেকে আশু মুক্তি ব্যতিরেকে সমাজ কাঠামোর ইতিবাচক পরিবর্তন আনা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
অপরাধবিজ্ঞানের একটি তত্ত্বে জানা যায়, তিনটি উপাদানের সমন্বয় হলেই যে কোন একটি অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। বর্তমানের ধর্ষণের সংস্কৃতি থেকে এ তিনটি ঘটনারই ফলাফল পাওয়া যায়। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো; অপরাধ সংঘটনে আগ্রহী ব্যক্তি, উপযুক্ত লক্ষ্য নির্ধারণ, অপরাধীকে প্রতিহত করার জন্য উপযুক্ত সুরক্ষা প্রদানের ব্যর্থতা; এ তিনটি উপাদানের উপস্থিতিই কার্যত যে কোন ধর্ষণ ঘটনার ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন শিশু-কিশোর পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, কিন্তু বর্তমানের যে সমাজ চিত্র-সমাজ নিরীক্ষার চিত্র দেখা যায় সেখানে দেখা যায়, শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই বিপথগামী হচ্ছে। অর্থাৎ সমাজ এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে যেখানে শিশুদের নেতিবাচক পথে যাওয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে যার প্রেক্ষিতে শিশু-কিশোররা নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। একজন অপরাধী অপরাধ করার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে যখন তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ক্রমান্বয়ে প্রোথিত হয় এবং সে অপরাধ সংঘটনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পায় অর্থাৎ পুরো সমাজটা একটা ভীতিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে নিপতিত হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতির সঞ্চার হয়। প্রকৃত অর্থে মনোজাগতিক, শারীরবৃত্তীয়, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, পিয়ারগ্রুপ সর্বোপরি একটি সামাজিক কাঠামো উঠতি বয়সি যুবকদের অপরাধে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। বিশেষ করে স্কুলিং পদ্ধতি, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারের সৃষ্টি, সামাজিক বিধি-নিষেধের অবক্ষয়, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সামাজিক স্তরায়ন, বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি কারণগুলো মূলত একটি মানুষকে অপরাধী হতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে।
আমরা জানি অপরাধ প্রতিকারের চেয়ে অপরাধ প্রতিরোধ উত্তম। যদি সামগ্রিক পরিবেশ এমন করে তৈরি করা হয় যেখানে নারীদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়, নারীদের ইজ্জত, মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় তাহলে নারীর বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের অপরাধের সহিংসতা ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। কিন্তু পরিবেশ এমন করে প্রস্তুত করা রয়েছে যেখানে ধর্ষকরা নানাভাবে ধর্ষণ করার সুযোগ পাচ্ছে এবং সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত বিদ্যমান পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছে। কাজেই, অপরাধী জেনে বুঝে, লাভ-ক্ষতির তুলনামূলক বিশে¬ষণ করেই অপরাধ সংঘটনের দিকে পা বাড়ায়, সেক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনের সুযোগ নষ্ট করে দিতে হবে। অপরাধীরা যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, লক্ষ্যচ্যুত হয় সে ব্যাপারে সকলকে সচেতন করার পাশাপাশি সমন্বিত ব্যবস্থাও বহাল রাখতে হবে। অপরাধে উদ্বুদ্ধরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাদের কর্ম পরিকল্পনা পরিচালনা করার চেষ্টা করে থাকে যাতে করে খুব সহজেই টার্গেটকে ঘায়েল করতে পারে বিশেষ করে নিজের করায়ত্বে আনার প্রয়াসে দীর্ঘদিন ধরে সুনিপুন ছক কঁষে থাকে।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভিক্টিম নিজে নিজেকে সুরক্ষা প্রদানে নানাবিধ কারণে ব্যর্থ হয়ে থাকে। সুরক্ষার অপ্রতুলতা থাকায় অপরাধীরা সুযোগ বুঝে তাদের অপকর্ম সাধন করে থাকে। তাছাড়া নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল থাকায় ধর্ষকেরা সুযোগ নিয়ে থাকে, তবে বর্তমানে গণধর্ষণের সংখ্যাও কিন্তু ক্রমান্বয়ে বেড়েই যাচ্ছে। ধর্ষকরা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট, তাদের কোন জাত-পাত নেই, তারা সমাজের কীট। সে ক্ষেত্রে ক্রাইম ম্যাপিং-এর সহায়তায় ভিক্টিম স্পট সুনির্ধারণ করে ভিক্টিমের সুরক্ষায় সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণই পারে ধর্ষকদের রুখে দিতে। প্রত্যেক পাড়া মহল¬ায় অপরাধ প্রতিরোধের নিয়ামকগুলো বিশেষ করে লাইটিং, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আরেকটি বিষয় আলোচনায় রাখা যায় সেটি হচ্ছে ধর্ষকরা কিন্তু ভিন গ্রহের কেউই নয়। প্রত্যেক পরিবার হতে পারে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কেননা পরিবারের দায়িত্ব শিশুদের সামাজিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সকল অনাচার, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তোলা।
পরিশেষে বলতে চাই, ধর্ষণকে একটি সামাজিক ব্যধি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে; ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষিতা নারীদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষা প্রদানে সকলকে একযোগে কাজ করার মানসিকতা বপন করতে হবে। ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করে খুব দ্রুততার সহিত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিচার নিশ্চিত করে অন্যদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণু নীতি ধর্ষকদের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। অর্থাৎ ধর্ষকের বিচার হতেই হবে, এরা রাষ্ট্র ও জাতির জন্য কলঙ্কের অধ্যায় টেনে আনে। সমাজে সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের অপরাধের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে ধর্ষকরা। কাজেই, যে কোন মূল্যে রাষ্ট্র থেকে ধর্ষকদের নাম চিরতরে মুছে দিতে হবে।

খবর শুনবেন? ভাল খবর?
শাম্মী আক্তার
যেকোনো পণ্যের মিস ব্র্যান্ডিং বা মিস লেবেলিং ভোক্তার জন্য ক্ষতিকর কারণ, এর মাধ্যমে ভাল লেবেলিং এর আড়ালে ভোক্তাকে নিম্নমানের পণ্য দেয়া হয়। তেমনি প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় কোনো রাজনৈতিক দলের লেবেল ব্যবহার করে যখন কেউ নিজের অপকর্ম, কুকর্ম আড়াল বা জায়েজ করতে চায় তখন সেটা সাধারণ মানুষের জন্য অস্বস্তি বা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্যে ভেজাল বা মিস ব্র্যান্ডিং রোধে যেমন বিভিন্ন রকমের কার্যক্রম পরিচালিত হয় তেমনি বর্তমান পেক্ষাপটে মানুষের মধ্যে ভেজাল মানুষ, দূষিত মানুষ খুঁজে বের করার জন্য আরও সুক্ষ্ম পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিযান চলমান থাকা প্রয়োজন।
বিশেষভাবে অভিশপ্ত ধর্ষণ যে এলাকায় সংঘটিত হবে সেই এলাকার প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও ধর্ষণ প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। ধর্ষক নির্মূলকারী সেল গঠন করতে হবে। কোনো পাপীষ্ঠ ধর্ষক কোনোভাবেই যেন রাজনৈতিক পরিচয়ের বদৌলতে পরিত্রাণ পেয়ে না যায়।
ইদানীং মনে হয় কিছু অমানুষ রাজনীতির সৌন্দর্য, রাজনীতির সংজ্ঞা, রাজনীতির মূলমন্ত্রটাই পাল্টে দিতে চাচ্ছে। মানুষের জন্য রাজনীতি, মানুষের কল্যাণে রাজনীতি এটাই তো মূলনীতি। এর থেকে বিচ্যুতি মানে তো মানুষের দুর্ভোগ। ছোটবেলায় জনপ্রতিনিধি বাবাকে দেখেছি আমাদেরকে কম সুযোগ দিয়ে বাড়ি থেকে টাকা পয়সা নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে। তখন থেকেই জেনেছি একজন রাজনীতিবিদ, একজন জনপ্রতিনিধির কাজ কী, তারা কেমন। যে নিজের ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে ি জনমানুষের কল্যাণে কাজ করে তাকেই তো রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধি বলে।
যাইহোক, কিছু মানুষের অপকর্মের জন্য আসলে রাজনীতি না জনপ্রতিনিধির সংজ্ঞা বা আদর্শ পাল্টে যাবে তা ঠিক নয় বরং আরও জোরালভাবে মূল আদর্শকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যেতে হবে। ছোটবেলায় ভাবতাম রাজনীতিবিদেরা সব সময় সাদা পোশাক পরে কারণ তারা অন্যদের থেকে আলাদা, তারা ভাল। কিন্তু কোথায় সেই সাদা পোশাক? আর কত দাগ, কত কাদামাটি লাগলে সেটা ফেলে নতুনভাবে নতুন সাদা জামা পরবে তারা?
এইসব নোংরা দাগ পরিষ্কার করার জন্য প্রয়োজন বেশি বেশি শুদ্ধি অভিযান। পাশাপাশি যারা রাজনীতি বা জনপ্রতিনিধির প্রকৃত আদর্শ ধারণ করে বা সে অনুযায়ী কাজ করে তাদেরকে যথাযথভাবে সামনে তুলে ধরতে হবে যাতে করে অন্যরা আলোড়িত হয়, উদ্বুদ্ধ হয়। দূষিত ভেজাল মানুষের ভিড়ে যেন চিরাচরিত মূলনীতি হারিয়ে না যায়। এটা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে নইলে বিশেষভাবে “জেড জেনারেশন” এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরা খারাপ বা ভুল পথ বা পন্থাকেই সঠিক মনে করবে।
অন্যদিকে গন্ধযুক্ত রাজনীতিবিদ নামধারী মানুষের এই রাজনীতিবিদ লেবেল নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে রাজনীতির প্রকৃত সৌন্দর্য, প্রকৃত মর্মার্থ রক্ষা পাবে। জনকল্যাণের পরিবর্তে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের রাজনীতির ছায়াতলে স্থান দেয়া যাবে না। রাজনীতির প্রকৃত আদর্শ সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়োজন সুন্দর মনের জনহিতৈষী মানুষ।
আমার মেয়ের দাদা, নানা, বাবা সবাই যেহেতু এই পথের ফেরিওয়ালা তাই মাঝে মাঝে মেয়েকে রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এই যেমন রাজনীতিবিদ মানে কী, তারা কী করে, সংসদ ভবনে হাসিনা দিদারা (সে এভাবে সম্মোধন করতেই পছন্দ করে) কী করে ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মানে, রাজনীতিবিদের দ্বারা সমাজে যখন ভাল ভাল গল্প তৈরি হবে, তাদের দ্বারা ভাল ভাল কাজ হবে তখন শিশুদের মনে এগুলো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান পরিবেশ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়াতে শুধু মন খারাপ করা খবর, দুশ্চিন্তার খবর! কেমন যেন একটা অস্থির উদ্বেগপূর্ণ সময়! কিছু মানুষের মনে হচ্ছে মানুষ পরিচয় ভাল লাগছে না। তারা একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে খারাপের প্রতিযোগিতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা!
বিষয়টা অনেকটা এরকম। অমুক তমুককে ঠকিয়ে ১০ লাখ টাকা লোপাট করেছে তো আমি কম যাব কেন আমার তো আরো বেশি ক্ষমতা আমি তো বিশাল কিছু আমি করব ২০ লাখ টাকা লোপাট। একটা বাজে দৃষ্টান্ত আরেকটা খারাপ ঘটনার ইন্ধন দিচ্ছে। এ যেন খারাপের দুষ্টচক্র। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির বিধানই এই দুষ্টচক্রকে ভাঙতে পারে। তবে অবশ্যই তা হতে হবে খুব তড়িৎ। অন্যদিকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যেটা তা হচ্ছে যৌন নির্যাতন। এটা মনে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে হয়ে যাচ্ছে। যেমন আজ গণমাধ্যম যদি খবরে দেখায় অমুক মেয়ে বা শিশুকে ঘরের মধ্যে অমুক ধর্ষণ করেছে ব্যাস তাতেই শুরু হয়ে যায় আর এক জঘন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ব্যাপারটা অনেকটা এমন। ধুর! ওই ছোকরা ওকে একা ঘরের মধ্যে ধর্ষণ করেছে ব্যাপার না। আমাকে চেন? আমি অমুকের অমুক! আমার কত দলবল! কত ক্ষমতা! আমি করব খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়! গণধর্ষণ! (উহ! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে! আমি তো মেয়ে, মেয়ের মা!)
মানুষ অবাক হয়ে দেখবে আর বলবে ওরে বাপরে ছেলেটার কত সাহস রে বাবা! এটাই তো চাই। আমি তো বীর। তারপর গণমাধ্যম ফলাও করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমাকে দেখাবে, মানুষ দেখবে আমার ক্ষমতা। আমি তো হিরো। সেক্সুয়াল বস! ফাঁকফোকর দিয়ে বের হতে পারলেই পরবর্তীতে ক্ষমতাধর পরীক্ষায় পাসকৃত লাইসেন্সওয়ালা ধর্ষক!
কী হচ্ছে এসব! সৃষ্টির সেরা জীব “আশরাফুল মাখলুকাত” আজ যেন সৃষ্টির সবচেয়ে “ভয়ঙ্কর নিকৃষ্টতম প্রাণী”তে রুপান্তরিত হয়েছে। কী অশুভ! আচ্ছা আমরা তো পচনশীল জিনিস বিভিন্ন উপায়ে সংরক্ষণ করি আবার কোনটা বেশি পচে গেলে সেটা ফেলে দেই। মানুষের পচন রোধের ফর্মুলা ঠিক আছে তো? নাকি আরো ডোজ বাড়ানো প্রয়োজন? একেবারে নষ্ট হয়ে যাওয়া, পচে যাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে কী করা উচিত? তাদেরকে সমাজে বাঁচিয়ে রাখা কি নিরাপদ হবে? ক্রস কন্টামিনেশন বলে তো একটা ব্যাপার আছে।
আচ্ছা গণমাধ্যম যদি এইসব সমাজ বিনষ্টকারী ঘটনা না দেখায় তাহলে কি তাদের টিআরপি অনেক কমে যাবে? যদি এমন হয় গণমাধ্যম এইসব অমানুষদের নোংরামি, বিকৃত কর্মকাণ্ড দেখাবে না তাতে তো বিকৃত মানুষের বিকৃত মনোবাসনা অনেকাংশে পূর্ণ হবে না (প্রয়োজনে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে সহায়তা দেবে সরকার)। এতে করে ধর্ষণের শিকার হওয়া মানুষটা মানুষের কটুক্তি থেকে রক্ষা পাবে এবং স্টিগমাটাইজেশন একটু হলেও কম বোধ হবে।
কারণ এই পৈশাচিক বিষয় যত সামনে আসবে অন্যান্য দূষিত মস্তিষ্ক তত বেশি উজ্জীবিত হবে, প্রলুব্ধ হবে ভাববে এই সমাজে এসব হরহামেশাই হয় (একমাত্র অন স্পট সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানই এই চক্র বন্ধ করতে পারে)
মনে হতে পারে তাহলে গণমাধ্যমের কাজ কী হবে? গণমাধ্যম পর্দার বাইরে থেকে গোপন উইং বা সোর্স হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সহায়তা করবে। প্রয়োজনে আলাদা ইউনিট থাকবে তাদের যেটাকে বলা যেতে পারে “গোয়েন্দা গণমাধ্যম”। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা গণমাধ্যমের তড়িৎ কার্যক্রমের ফলাফল হেডলাইন আকারে মানুষ জানবে এবং সতর্ক হবে।
এই সকল বিষাদময় খবরের পরিবর্তে আমরা দেখতে চাই মন ভাল করা খবর, আশা জাগানিয়া খবর, উৎসাহব্যঞ্জক খবর। আমার মাথায় আসে না ২৪ ঘন্টা গণমাধ্যমকে কেন চলমান থাকতে হবে? এর কি কোনো বাধ্যবাধকতা আছে? প্রতিটা দিন সকাল সকাল শুরু হয়ে যায় ব্রেকিং নিউজ! (মনে হয় ঘরের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে)। এই ধর্ষণ, এই চুরি-ডাকাতি, এই মারামারি, এই পুলিশের তাড়া, ইত্যাদি। এভাবেই দিনের শুরু! এভাবেই দিনের শেষ। একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে না দেওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকে চলতেই থাকে।
অবাক লাগে কারণ ভাল কাজ তো অনেক হচ্ছে, অনেক। ভাল খবর, ভাল গল্পও অনেক আছে। সেসব তো দেখি না বারংবার প্রচার করতে। হৃদয়ে গেঁথে দিতে!
এমন কি হতে পারে না? সবার সকাল শুরু হবে সুন্দর সুন্দর অনুপ্রেরণাদায়ী, মানসিক শক্তি জাগানিয়া খবর দিয়ে! বিষয়টা এমন এগুলো দেখে কেউ বলবে দেখো দেখো অমুক কী ভাল কাজ করছে/করেছে। আমিও করতে চাই এমন ভাল কাজ। কী দারুণ দিনের শুরু তাই না?
গণমাধ্যমের কাজ যেমন সমাজের দর্পণ হিসেবে ভূমিকা রাখা তেমনি মানুষের ভাবনার ভিত মজবুত করা, তাদের চিন্তাকে নাড়িয়ে দেয়া। আমরা তো আশা করতে পারি সেটা হবে অবশ্যই ধনাত্মক। মোদ্দা কথা হচ্ছে যে জিনিস ছোট বড় সবাই দেখে সেটার সময় নিয়ে, ধরন নিয়ে, বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক বেশি পর্যালোচনা এবং সঠিক পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। যাইহোক, ভালভাবে যেতে হলে বহুদূর, পরিবর্তন প্রয়োজন আমূল। শুরু হক ভালোর চক্র, ধনাত্মক চক্র। ছুঁয়ে যাক সবাইকে। পৃথিবী হোক সবার জন্য নিরাপদ।