কোরবানিতে যা জানতেই হবে

0

নাজমুল হাসান সাকিব
কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরবানি করা ওয়াজিব, এর গোশত বিতরণ করা ও খাওয়া সুন্নত। ঈদুল আজহার নামকরণই করা হয়েছে এ মহান ইবাদতের নামে। আল্লাহ তায়ালা এ দিনে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি কোরবানি করারও হুকুম দিয়েছেন,‘সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামাজ পড় ও কোরবানি দাও।’ (সূরা কাউসার: ০২)। প্রথমে নামাজের হুকুম, তারপর কোরবানির। যেন বলা হচ্ছে- ‘নামাজের মাধ্যমে প্রথমে আল্লাহতায়ালার সামনে আত্মনিবেদিত হও, তারপর সে আত্মনিবেদনের নিদর্শন স্বরূপ কোরবানি কর।’
কোরবানি কী?
‘কোরবানি’ কোরবান শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো- নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা। পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, ‘আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের আশায় নির্দিষ্ট দিনে পশু জবাই করা।’
কোরবানির ফজিলত
হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা (সাহাবিগণ) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোরবানির হাকীকত কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এটি তোমাদের পিতা আদম আ:-এর সুন্নত’। সাহাবিগণ বললেন, এতে আমাদের কী লাভ? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (কোরবানির পশুর) ‘প্রতিটি লোমের বিনিময়ে তোমাদেরকে একটি করে নেকী দেয়া হবে’। সাহাবিগণ বললেন, ভেড়ার ক্ষেত্রেও কি একই বিধান? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, এরও প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী দেয়া হবে’। (মেশকাত: ১/১২৯)
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি না করা
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বে যে ব্যক্তি এই মহান ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদিস শরিফে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরবানি করার সামর্থ্য রাখে কিন্তু কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ : পৃ. ২২৬, হা. ৩১২৩)।
কার ওপর কোরবানি ওয়াজিব?
প্রত্যেক স্বাধীন, মুসলমান, মুকীম যারা কোরবানির দিনগুলোতে নেসাব পরিমাণ মালের মালিক তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩৩৬)।
ওয়াজিব হওয়ার সময়
কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার সময় হলো- কোরবানির দিন। গ্রামবাসীদের জন্য সূর্যোদয়ের পর আর শহরবাসীদের জন্য ঈদের নামাজের পর। সুতরাং যে ব্যক্তি কোরবানির দিনসমূহকে এমতাবস্থায় পাবে যে, ওয়াজিব হওয়ার শর্তসমূহ তার মাঝে বিদ্যমান, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৮)।
নেসাব
স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) তোলা। আর টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নেসাব হলো- এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হওয়া। সোনা ও রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া: ১৭/৪০৫)।
কোন পশু দিয়ে কোরবানি করবেন?
কোরবানির জন্য নির্ধারিত পশু ছয়টি। যেমন : গরু (গাভী, ষাঁড়, বলদ) মহিষ, ভেড়া, ছাগল (খাসী, পাঠা) দুম্বা ও উট। এই ছয় প্রকার গৃহপালিত পশু কোরবানি করা জায়েজ। এছাড়া অন্য কোনো হালাল প্রাণী (হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি) কোরবানি করা জায়েজ নেই। (আল বাহরুর রায়েক : ৮/৩২৪)।
কোন পশু দ্বারা কোরবানি করা উত্তম?
গরু, মহিষ, উট, ছাগল ভেড়া ও দুম্বা; এই ছয় ধরনের পশু কোরবানি করা জায়েজ। সামর্থ্য অনুযায়ী এই ছয় প্রকারের যেকোনো পশু কোরবানি করলেই কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। তবে উত্তম হলো- হৃষ্টপুষ্ট পশু কোরবানি করা। প্রথমে উট বা ভেড়া তারপর গরু তারপর ছাগল। (শরহে মুখতাসারিত তহাবী : ৭/৩২৬) তবে গরুতে সাতজনে শরীক হওয়ার চেয়ে ছাগল একা কোরবানি করা উত্তম যখন মূল্য বরাবর হবে। (ফতোয়ায়ে শামী : ৯/৫৩৪)।
পশুর বয়স
গরু ও মহিষের দুই বছর, উটের পাঁচ বছর আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার এক বছরের কম হলে এর দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ হবে না। ছয় মাসের ভেড়া ও দুম্বা মোটা তাজা হওয়ায় দেখতে যদি এক বছরের মনে হয়, তাহলে ছয় মাসের ভেড়া, দুম্বাও কোরবানি করা জায়েজ। কিন্তু দেখতে যদি নাদুস-নুদুস না হয় তাহলে এগুলোও এক বছরের পূর্বে কোরবানি করা জায়েজ নেই। (ফতোয়ায়ে শামী : ৯/৫৩৪, শরহে মুখতাসারিত তহাবী : ৭/৩২৬) উল্লেখ্য, ছাগলের এক বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কোরবানি জায়েজ নেই। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৯৬)।
কখন কোরবানি করবেন?
কোরবানি করার মোট সময় তিন দিন। যেমন: ১০, ১১ ও ১২ ই জিলহজ। এই তিন দিনের রাত ও দিনের যেকোনো সময় কোরবানি করা যাবে। (শরহে মুখতাসারিত তহাবী : ৭/৩৩৩)।
কখন করা উত্তম?
কোরবানির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে কোরবানি করা বৈধ হলেও প্রথম দিনই ঈদের নামাজের পর কোরবানি করা উত্তম। অনুরূপ রাতের তুলনায় দিনে কোরবানি করা উত্তম। (খুলাসাতুল ফতোয়ায়ে: ৪/৩১১)।
সাত শরীক ও বেজোড় সংখ্যা
শরীয়তের দৃষ্টিতে একটি গরু, মহিষ বা উটে সর্বোচ্চ সাত অংশীদার মিলে কোরবানি করতে পারবে। এর চেয়ে বেশি অংশীদার হলে কারো কোরবানি সহিহ হবে না। সাতের নিচে দুই-চার বা ছয় ভাগেও কোরবানি দিতে পারবে। এতে বেজোড় সংখ্যা হওয়া জরুরি নয়। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৮৭)।
কোরবানি করার পদ্ধতি
জবাই করার সময় সুন্নত হলো- পশু-পাখির মাথা দক্ষিণ দিকে করে নিজে কিবলামুখী হয়ে জবাই করবে। এর বিপরীত হলেও তার গোশত খাওয়া জায়েজ। জবাইয়ের সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে খুব ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করবে। গলায় চারটি রগ আছে। শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও দুটি রক্তনালী। যেকোনো একটি বাদ পড়লেও পশু হালাল। কিন্তু তিনটির কম কাটা হলে পশু মৃত ও হারাম বলে সাব্যস্ত হবে। (হিদায়া : ৪/৪২১, বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৬০) ।
নিজের পশু নিজইে জবাই করা
নিজের কোরবানির পশু নিজ হাতে কোরবানি করা মুস্তাহাব। কারণ, নবীজি সা: নিজ কোরবানির পশু নিজ হাতেই জবাই করতেন। কিন্তু ব্যক্তি যদি অন্য কাউকে জবাই করার অনুমতি দেয় তাহলে তার জবাইও যথেষ্ট হবে। (শরহে মুখতাসারিত তহাবী : ৭/৩৪৫)।
গোশত বিতরণ
কোরবানির সবটা গোশত নিজে খাওয়ার এবং অন্যকে খাওয়ানোর জন্য উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এ যেন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। নবীজি সা: এক হাদিসে ইরশাদ করেন- ‘তোমরা খাও, জমা করে রাখ এবং দান-খয়রাত কর।’ (বুখারী : ৫৫৬৯)। ‘কোরবানির গোশত তিন ভাগ করা মোস্তাহাব। তার একভাগ নিজেরা খাওয়া, আরেকভাগ আত্মীয়-স্বজনদের দেয়া আর বাকী এক ভাগ গরীব-মিসকীনদের। তবে ইচ্ছা করলে সম্পূর্ণ গোশত নিজেও রেখে দিতে পারবে, আবার চাইলে সদকাও করে দিতে পারবে’। (ফতোয়ায়ে শামী : ৯/৫৪২)।
কোরবানির কাজা আদায়
কোরবানির পশু ক্রয়ের পর ১২ ই জিলহজের মধ্যে কোরবানি করতে না পারলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি পশুই ক্রয় না করে এবং এভাবে কোরবানির সময় শেষ হয়ে যায় তাহলে তার ওপর কোরবানির যোগ্য একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর উভয় ব্যক্তি যথাসময়ে কোরবানি না করার কারণে তওবা-ইস্তেগফার করবে। (তুহফাতুল ফুকাহা : ৩/৮৩)।
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কোরবানি
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তার নেসাব পরিমাণ সম্পত্তি থেকে ঋণের অংশ আলাদা করার পর যদি নেসাব কমে যায় তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। কিন্তু যদি ঋণের টাকা আলাদা করা সত্ত্বে নেসাব বাকী থাকে, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (আহসানুল ফতোয়া : ৭/৫০৭)।
গরীবের কোরবানি
গরীব ব্যক্তি যদি কোরবানি করার নিয়তে পশু ক্রয় করে তাহলে তার উপর কোরবানি ওয়াজিব হয়ে যায়। এমনকি ওই নির্দিষ্ট পশুই কোরবানি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। (কিতাবুল মাসায়েল : ২/৩০৪)।
কোরবানির সাথে আকিকা
কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দুটোই সহিহ হবে। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়্যা : ২/৮০)।
কোরবানির সাথে ওলিমা
কেউ যদি কোরবানির বড় পশু অর্থাৎ- গরু, মহিষ ও উটে ওলিমার অংশ রাখে তাহলে তা জায়েজ আছে। এতে ওলিমার কারণে কোরবানির পশুতে কোনো প্রভাব পড়বে না। (কিতাবুল মাসায়েল : ২/৩১৪)।
গোশত জমা করে রাখা
কোরবানির গোশত বণ্টন করা ওয়াজিব নয়। বরং একতৃতীয়াংশ গরিবদের দান করা মুস্তাহাব। সুতরাং কেউ যদি কোরবানির গোশত ফ্রিজে বা অন্য কোনো পন্থায় জমা করে রাখে তাহলে সমস্যা নেই। বরং কোরবানির গোশত দীর্ঘ দিন জমা করে রেখে খাওয়া জায়েজ আছে। (ফতোয়ায়ে শামী : ৬/৩২৮)।
কোরবানির চামড়া
কোরবানির চামড়া কোরবানিদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। নিজে ব্যবহার না করলে কাউকে সদকা করে দিবে অথবা মূল্য সদকা করার নিয়তে এটি বিক্রি করে গরীব-মিসকীনদের মাঝে বণ্টন করে দিবে। কোরবানির চামড়া মসজিদে দেওয়া জায়েজ নেই। তবে মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং -এ দিতে পারবে। (কিতাবুল মাসায়েল: ২/৩৩১)।
সন্তান ও স্ত্রীদের কোরবানি
ছোট নাবালেগ বাচ্ছাদের পক্ষ থেকে পিতা কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব নয়। তবে দেয়া ভালো। অনুরূপ স্বামী তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে কোরবানি করা আবশ্যক নয়। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়্যা : ২/৮৭) নাবালেগ ছেলে যদি নেসবে পরিমাণ মালের মালিকও হয় তবুও বিশুদ্ধ মতানুসারে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৬৪)।
কিছু জরুরি মাসআলা-মাসায়েল
মাসআলা : এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নেই। অনুরূপ দাঁত, শিং, কান বা লেজ ইত্যাদি ভাঙ্গা, কাটা থাকলে এ ক্ষেত্রে মুলনীতি হলো, অর্ধেকের বেশি নষ্ট হলে বা এর দরুণ মস্তিষ্কে প্রভাব পড়লে এমন পশু দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নেই। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩৪৩)।

মাসআলা : যারা কোরবানি করার ইচ্ছা করবে তাদের জন্য জিলহজ মাসের প্রথম থেকে নখ-চুল ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব। তবে কোরবানি করতে অক্ষম ব্যক্তি ঈদের পর নখ-চুল ইত্যাদি কাটলে তার জন্য পূর্ণ একটি কোরবানির সাওয়াবের কথা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। (মুসলিম : ১৯৭৭, সুনানে আবি দাউদ: ২৭৮৯)।
মাসআলা : সুদ-ঘুষ খাওয়া নিঃসন্দেহে জঘন্যতম অপরাধ। শরীয়তের দৃষ্টিতে যাদের অধিকাংশ সম্পদ বৈধ, তাদের সাথে শরীক হয়ে কোরবানি করা জায়েজ। পক্ষান্তরে যাদের অধিকাংশ সম্পদ বৈধ নয়, তাদের সাথে শরীক হয়ে কোরবানি করা জায়েজ নেই। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৯০)।
মাসআলা : কোরবানির পশু জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেয়া জায়েজ আছে, তবে পারিশ্রমিক হিসেবে কোরবানির পশুর কোনো কিছু দেয়া জায়েজ নেই। (বাদায়েউস সানায়ে : ৬/৩৩২)।
মাসআলা : শ্রমিককে পারিশ্রমিক হিসেবে সরাসরি কোরবানির গোশত খাওয়ানো জায়েজ নেই। (ইমদাদুল আহকাম: ৪/২৮১)।

[সংকলিত]