কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর হচ্ছে বাংলাদেশের

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ পণ্য আমদানি ও রফতানির মাধ্যমে কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেকদিনের। পর্যায়ক্রমে দেশটির বিনিয়োগ প্রবাহও বেড়েছে বাংলাদেশে। কয়েক বছর হলো স্যামসাং ও এলজির মতো প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে বাংলাদেশে। কোরীয় অটোমোবাইল ব্র্যান্ড হুন্দাইয়ের গাড়ি আগামী বছর নাগাদ বাংলাদেশেই সংযোজন শুরু হবে বলে প্রত্যাশা রয়েছে। সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল ও অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশকে ঘিরে আগ্রহ বাড়ছে কোরীয়দের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আরো গভীর হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অবকাঠামো খাতের প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে কোরীয় প্রতিষ্ঠান। আলোচনা চলছে আরো প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্পের বিষয়ে।
চল্লিশ বছর আগে পোশাক কারখানা স্থাপন উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনাগোনা শুরু হয় কোরীয় প্রতিষ্ঠানের। এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে বৈশ্বিকভাবেই স্বীকৃত বাংলাদেশ। গত চার দশকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কও বেড়েছে পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে। এখন অবকাঠামো উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করার প্রচেষ্টা চলমান আছে। সামগ্রিকভাবে দুই দেশের সুসম্পর্ক আরো গভীর হচ্ছে।
কূটনীতিকরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব ভিন্ন খাতে ধাবিত হয়েছে। এসব খাতের মধ্যে আছে ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল, মেশিনারি এবং তথ্যপ্রযুক্তি। কয়েক বছর হলো বাংলাদেশে হালনাগাদ মোবাইল উৎপাদন করতে শুরু করেছে স্যামসাং। উৎপাদিত বৈদ্যুতিক পণ্যের মধ্যে আরো আছে রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার এবং ওয়াশিং মেশিন। স্মার্ট টিভি সংযোজন করছে এলজি। আগামী বছর হুন্দাই অটোমোবাইল সংযোজন শুরু করার কথা রয়েছে।
ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল, মেশিনারি এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশের অবকাঠামোর বিষয়ে ভাবছেন দক্ষিণ কোরিয়া সরকার প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, কোরীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত প্রযুক্তির অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশে কাজে লাগানোর বিষয়ে উৎসাহী।
আগামী বছর হুন্দাই বাংলাদেশে অটোমোবাইল সংযোজন শুরু করবে এমন প্রত্যাশা জানিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত কোরীয় রাষ্ট্রদূত লী জাং গুন্ বণিক বার্তাকে বলেন, অবকাঠামো হলো আরেকটি ক্ষেত্র, যেখানে কোরিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতা উন্নয়নে আশাবাদী। উন্নত প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতা বাংলাদেশী অংশীদারদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে কোরীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময়ই প্রস্তুত আছে।
কোরীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ প্রচারণা সংস্থা কেওটিআরএ বা কটরার তথ্য অনুযায়ী, কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান যুক্ত আছে বাংলাদেশে এমন চলমান প্রকল্প আছে ১৪টি। সাসেক রোড কানেকটিভিটি সুপারভিশনে যুক্ত আছে কুহ্নয়া ইঞ্জিনিয়ারিং। সিলেট এয়ারপোর্ট স্টেনদেনিং প্রকল্পে আছে হাল্লা করপোরেশন। ঢাকা ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্টের সঙ্গে আছে হুন্দাই রোটেম। পদ্মা সেতু সুপারভিশনে আছে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন।
আখাউড়া-লাকসাম রেলওয়ে সুপারভিশনে যুক্ত কোরীয় প্রতিষ্ঠানটি হলো দোহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং, হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্ট এক্সপ্যানশন প্রকল্পে আছে স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি। এদিকে ভান্ডালজুরি ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পে আছে তায়েইয়াং ইঅ্যান্ডসি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল প্রকল্পের সঙ্গে আছে কোরিয়ার হুন্দাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি।
পটুয়াখালী-গোপালগঞ্জ পাওয়ার লাইন প্রকল্পে আছে জিএস ইঅ্যান্ডসি। মেঘনাঘাট পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্পে আছে স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি। কক্সবাজার এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে আছে হাল্লা করপোরেশন। মাতারবাড়ী কোল পাওয়ার প্লান্টে আছে পসকো ইঅ্যান্ডসি। বাকখালী রিভার ব্রিজ প্রকল্পে আছে হাল্লা করপোরেশন। মাতারবাড়ী পাওয়ার প্লান্ট পোর্ট ওয়ার্কস প্রকল্পের সঙ্গে আছে হুন্দাই ইঅ্যান্ডসি।
গতকাল ঢাকাস্থ কোরীয় দূতাবাসের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত প্রচারণা অনুষ্ঠান অনলাইন রোড শোতে জানানো হয় কয়েক বছরে অবকাঠামো উন্নয়নে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থের প্রকল্প সহায়তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে কোরীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি পর্যায়ে ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় করতে চায় কোরিয়া।
বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার রোড শোতে বাংলাদেশের আটটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ১৭টি কোরীয় প্রতিষ্ঠান আলোচনায় অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও এআইআইবির অর্থায়নে ১ হাজার ১৮৫ কোটি বা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে কোরিয়ার কোম্পানিগুলো। প্রকল্পগুলোর সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশী সংস্থার মধ্যে আছে ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়ারেজ অথরিটি ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ইডকল)।
কোরীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেনের। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের অনেক অবকাঠামো প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কোরীয় কোম্পানি। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে নৈতিকতা ও গুণগত মানের বিষয়ে কোরীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক নির্ভরযোগ্য। বর্তমানে যে প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে, তার বেশির ভাগই পিপিপিতে করার বিষয়ে আগ্রহী কোরীয়রা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য হয় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ১৬০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। দেশের মোট আমদানি ২ দশমিক ৫ শতাংশ বা প্রায় ১৩২ কোটি ডলারের পণ্য আসে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। আবার দেশটিতে বাংলাদেশে তৈরি পণ্য রফতানি হয় ৩০ কোটি ডলারের বেশি। এদিকে বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার পুঞ্জীভূত প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ১১২ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো বলছে, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাংলাদেশে আমদানীকৃত পণ্যের মধ্যে আছে জাহাজ, যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক, আয়রন এবং স্টিল, কাগজ ও কাগজের বোর্ড, জিংক, তুলা, রাসায়নিক, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্র ইত্যাদি। আর রফতানি পণ্যের সিংহভাগই তৈরি পোশাক। বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের খাতগুলোর মধ্যে আছে বস্ত্র ও পোশাক, ব্যাংকিং, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং বাণিজ্য।