ওসিসিতে ধর্ষণের শিকার ৪ শিশুছোট শরীরে পাশবিক নির্যাতন, সহ্য করা কঠিন!

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ছোট ছোট চার জন শিশু! দুই জনের বয়স ছয়, একজনের সাত আর অন্যজনের নয়। প্রতিবেশি সজল মোল্লা (৫৫) প্রথম দিন দুইজন এবং পরে দিন অন্য দুইজন শিশুকে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেন। এই শিশুরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস (ওসিসি) সেন্টারে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রায় ৩০ ঘণ্টা ধরে চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে আছেন তারা। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলছেন, প্রাথমিক পরীক্ষায় শিশুদের ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তবে তারা শারীরিকভাবে ভালো আছে। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে মানসিকভাবে ভয়টা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
শুক্রবার (৯ অক্টোবর) বেলা ১১ টার দিকে নির্যাতনে শিকার হওয়া এক শিশুর বাবা মাকে ঢামেকে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস (ওসিসি) সামনে পাওয়া যায়। পরে তাদের সঙ্গে কথা হয়। শিশুটির মা বলেন, আমরা সকালে এসেছি। ডাক্তারের (নার্স) মাধ্যমে মেয়েটার খোঁজ নিয়েছি। এখন সে ভাল আছে। সকাল থেকে দুইবার খেয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে আর থাকতে চাচ্ছে না। শিশুটির মা বলেন, ছোট মানুষ এখনও বুঝে উঠতে পাচ্ছে না। তার শরীর কতটা কষ্ট পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, সজল মোল্লাকে ‘নানা’ বলে ডাকত আমার মেয়েসহ অন্য শিশুরাও। দুইদিন আগে মেয়ে আমাকে বলেছে, সজল নানা আমাকে ‘এখানে’ কষ্ট দিয়েছে। এই কথা কাউকে বলতেও নিষেধ করেছে। না হলে লাঠি দিয়ে মারবে। তাই প্রথমে ভয়ে আমাকে কিছু জানায়নি মেয়ে। পরে যখন অন্য শিশুদের নির্যাতনের কথা শুনে আমার মেয়েকে জিজ্ঞাস করি, তখন সে স্বীকার করে। মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, ছোট বয়সে এমন কিছু ঘটলে। মনে এমন খারাপ অভিজ্ঞতার ছাপ থেকে যায়। শিশুরা বাড়ি ফেরার পরে যতদ্রুত সম্ভব তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে হবে। যেন এই ঘটনা তাদের মন থেকে মুছে যায়। এদিকে ঢামেকের ওসিসির সমন্বয়ক বিলকিস বেগম বলেন, চার শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। শিশুদের বয়স ৬ থেকে ৯ বছরের মধ্যে। তাদের অবস্থা গুরুতর নয়। তারা ভাল আছে।
ধর্ষক কারাগারে
রাজধানীর উত্তর গোড়ানের এ ঘটনায় স্বজনরা অভিযোগ জানানোর পর বুধবার মধ্যরাতে ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিলে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করার নির্দেশ দেন।
সেদিন যা ঘটেছিল
খিলগাঁও থানা পুলিশ ও স্বজনদের সুত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী শিশুরা পরিবারের সঙ্গে উত্তর গোড়ানের টিনসেড বাসায় থাকে। তাদের মা-বাবারা শ্রমজীবী। সজল মোল্লা প্রতিবেশি হওয়ায় শিশুরা তাকে চিনত।তাকে নানা বলে ডাকতেন। মঙ্গলবার দুপুরে এক শিশুর মা তার সন্তানকে না পেয়ে এলাকার বিভিন্নজনের ঘরে খোঁজ নিচ্ছিলেন। এসময় সজলের ঘরে ঢুকে তিনি দেখতে পান আপত্তিকর দৃশ্য। তার সন্তানসহ দু’জনকে যৌন নিপীড়ন করতে দেখেন। পরে শিশুদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। বারবার অভয় দেওয়ার পর ভুক্তভোগীরা জানায়, শুধু তাদের সঙ্গে নয়, অন্য শিশুদের ওপরও এমন নির্যাতন করেছে। পরে অপর দুই শিশুকে খুঁজে নিয়ে তাদের কাছ থেকেও এমন বর্ণনা পাওয়া যায়।
শিশু নির্যাতন বেড়েছে
অন্যদিকে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা যেন থামছেই না। একের পর এক নির্মম, বীভৎস ঘটনা ঘটে চলেছে। শিশু অধিকার ও মানবাধিকার সংগঠন শিশু অধিকার ফোরাম, তথ্যমতে, গত ৫ বছরে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার হার আশঙ্কাজনক। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রথম ছয় মাসে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা এবং শিশুদের ওপর অন্যান্য যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। এ বছর জুলাই পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে ৫৭২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে অন্তত ২৩ জনকে। এতে বলা হয়েছে, ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ৮৪ জন শিশুর ওপর এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৫ জন শিশু। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, সারাদেশে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ৪৪৫ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। গত বছর (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) শিশুর প্রতি সহিংসতা হয়েছে এক হাজার ৯৯৬টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজে নানা কারণে অস্থিরতা বাড়ছে। সামাজিক বন্ধনও দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা দূর করা যাচ্ছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নিপীড়কের রাজনৈতিক প্রভাব, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, মাদক, পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা, সামাজিক অস্থিরতা, পুরুষের বিকৃত মানসিকতা সামাজিক অপরাধ বাড়ার মূল কারণ। তাছাড়া পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবেও অনেকেই বিপথে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের
মনোবিজ্ঞানীরা যা বলছেন
মনোবিজ্ঞানী ডা. মেহতাব খানম বলেন, ছোট ছোট শিশুরা যদি এমন নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, ধর্ষকদের শাস্তি পাওয়াটা জরুরি। কারণ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় একজন ধর্ষককে দেখে আরও অনেকে উৎসাহিত হয়। তারা মনে করে, এটা কোনো অপরাধ নয়। কারণ জৈবিক চাহিদা খাবারের ক্ষুধা অনুভব হওয়ার মতোই। এই ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা জরুরি। অন্যদিকে অভিভাবকরা শুধু কন্যা শিশুই নয়, তাদের যেকোনো শিশু-কিশোরকে মেশার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্ষতিকর দিক বাদ দিয়ে শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। সচেতনতা ও নিজের সম্পর্কে জানা যাবে এমন ভালো সাইট দেখাতে হবে শিশুদের।
পুলিশ কর্মকর্তারা কী ভাবছেন
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ধর্ষণের মত অপরাধ বেড়েছে। এটি কমাতে হলে অনেক পদ্ধতি রয়েছে। একক কোনো পদ্ধতিতে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা মনে করছি এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। পুলিশ মামলা নিচ্ছে, আসামি ধরছে এবং তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিটও দিচ্ছে। কিন্তু এরপর আর বিষয়গুলোর খবর থাকছে না। যদি তড়িৎ গতিতে বিচার হতো তবে মানুষ ভাবতো, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বিচার হচ্ছে। তাহলে মানুষ ভয়ে এসব অপরাধে জড়িতে পড়তো না। এ ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যকর যেসব মামলা রয়েছে, এগুলোর বিচার দ্রুত করা প্রয়োজন।