অস্ত্র-সোনা-হুন্ডি ও মাদক পাচার সিন্ডিকেটের হোতা সীমান্তের রাজা বাদশা মল্লিক

0

সুন্দর সাহা ॥ সীমান্ত গলিয়ে নানা কৌশলে রঘুনাথপুর ও ঘিবার বিভিন্ন অবৈধ পকেটঘাট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করা হচ্ছে ডলার ও সোনা। বিনিময়ে ভারত থেকে দেশে পাচার করে আনা হচ্ছে অস্ত্র-গুলি আর নানান কিসিমের মাদক। মাদকের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে মরণনেশা ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজা। বেনাপোল পোর্ট থানার এই দু‘টি ঘাটের একছত্র অধিপতি হচ্ছে মল্লিক সিন্ডিকেট। অন্যান্য সীমান্ত ঘাটে একাধিক গডফাদার থাকলেও এই দ‘ুটি সীমান্তের অবৈধ ৫/৬টি পকেট ঘাটের সম্রাট একজনই। হুন্ডি অস্ত্র সোনা ও মাদক পাচার জগতের সেই সম্রাট হচ্ছে সীমান্তের রাজাদের রাজা বাদশা মল্লিক।
সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়, বেনাপোল পোর্ট থানার রঘুনাথপুর গ্রামের কেরামত মল্লিকের পুত্র বাদশা মল্লিক এক সময় ছিলেন মাদক সম্রাট। প্রতিদিন হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল আসতো ভারতের চড়ুইগাছি, ভিড়া, হরিদাসপুর ও জয়ন্তীপুর সীমান্ত দিয়ে। রঘুনাথপুর, ঘিবা, সোলোর বিল ও দুধেল বিলসহ বিভিন্ন পকেট ঘাট দিয়ে এসব ফেন্সিডিল এসে পৌঁছাতো বাদশার ডেরায়।শুধু ফেন্সিডিল নয় সেই সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে হিরোইন, গাজা ও মদও আসতো। সীমান্তে মাদকের ডিলার হিসেবে বাদশার নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। মাদক ব্যবসায়ীরা ফেনসিডিলের বড় বড় চালান বাদশার ডেরা থেকে নিয়ে যেতো ফ্রি-স্টাইলে। বাদশার এই অপকর্মের সিপাহশালার ছিল মাদক ব্যবসায়ী মিন্টু ও শরি মেম্বার। সবঘাট ম্যানেজ করেই চলতো বাদশার মাদক পাচার ব্যবসা। ফেন্সিডিল, হিরোইন, মদ ও গাজার ১৫/২০টি চালান প্রতিদিন পাচার হতো। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে পৌঁছে দেয়া হতো এসব মাদকের চালান। এছাড়া বরিশালে ছিল বাদশার বড় আরেকটি মোকাম। সেখানেও পৌঁছে দেয়া হতো বিপুল পরিমাণ মাদক দ্রব্য। এভাবেই বাদশা মল্লিক হয়ে পড়ে দেশ সেরা মাদক ব্যবসায়ী। সীমান্ত থেকে যমুনা ব্রিজ পর্যন্ত দায়িত্বরত সংশ্লিষ্টদের সবাইকে হিস্যা দিয়ে ও ম্যানেজ করে চলতো বাদশার একচেটিয়া মাদকের ব্যবসা। বাদশা সিন্ডিকেটের মধ্যে অনেকেই মাদকসহ আটকও হয়। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার তারা বাদশার ডেরায়, ফের মাদক পাচারের পেশায় যোগ দেয়।
সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়, দেশে ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজার প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে মরণ নেশা মাদকের চালানও। যা নিয়ে লোকসমাজসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশিত হলে টনক নড়ে উপরের মহলের। এসময় শুরু হয় দেশব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযান। মাদক ব্যবসায়ীরা মরতে থাকে ক্রসফায়ারে। বাদশা, মিন্টু, শরি, রেজা, আলা, মুকুল, রেজা সহ বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা চোখে সর্ষে ফুল দেখতে থাকে। বোতল প্রতি ২ টাকা থেকে ২০ টাকা নেয়া সেই সব কর্মকর্তারা চোখ উল্টে দেন। শুরু হয় মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলার পরে মামলা দেয়া। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দুর্নীতিবাজ সংশ্লিষ্ট কর্তারা মাদক সম্রাট বাদশাসহ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। ভারতে পালিয়ে গেলেও কারও ব্যবসা থেমে থাকেনি। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের ফের কপাল খোলে প্রাণঘাতী করোনা শুরুর পর। করোনাকালে থেমে গেছে অনেক ব্যবসা। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া দীর্ঘদিন বাসার বাইরে যাচ্ছে না মানুষ। বর্তমানে স্বাভাবিক হয়ে এলেও সেই মার্চ মাস থেকে তুলনামূলকভাবে অন্য সময়ের তুলনায় রাস্তা-ঘাট অনেক ফাঁকা। সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাদক কারবারিরা। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাদশাসহ একে একে সব মাদক সম্রাটরা বেনাপোলে ফিরে আসে। কেউ কেউ কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে জেল হাজতে আশ্রয় নেয়। আবার সেই আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে জামিনে বেরিয়েও আসে।
সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়, এদের মধ্যে বাদশা হয়ে যায় আঙুল ফুলে কলাগাছ। করোনাকালে ফিরে এসে কুখ্যাত বাদশা হুন্ডি এবং মরণনেশা ফেনসিডিল, হেরোইন, মদ ও গাঁজা ব্যবসার সাথে শুরু করে সোনা পাচার ও অস্ত্র-গুলির ব্যবসা। মাদকের পাশাপাশি রঘুনাথপুর ও ঘিবা সীমান্ত হয়ে উঠেছে অস্ত্র-গুলি, বৈদেশিক মূদ্রা ও স্বর্ণের খনি। প্যাকেট বা পকেটে করে নয়, রীতিমত বস্তায় করে সোনা-বৈদেশিক মূদ্রা পাচার করা হচ্ছে। যার বিনিময়ে দেশে আসছে অস্ত্র-গুলি-ম্যাগজিনসহ মরণনেশা ফেনসিডিল, হেরোইন, মদ ও গাজা। এ সবের একছত্র অধিপতি বাদশা মল্লিক বলে সীমান্তবাসী জানান। বাদশার অপরাধ জগতের সাথে জড়িত রয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক দলের অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ একদল ক্যাডার। যাদের মধ্যে বেনাপোল পোর্ট থানার ধান্যখোলার সর্বাংহুদার সহিদ বিশ্বাসের ছেলে আনারুল, সাবেদ আলীর ছেলে আলমগীর হোসেন ও ঘিবার এজুবার মিয়ার পুত্র সাজজুল বিজিবির অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি-ম্যাগজিন ও গাজাসহ আটক হয়েছে। অন্য যারা আছে তাদের মধ্যে দুর্ধর্ষ হচ্ছে সামাজুল, লালন, জামির, ইবাদুল বাবুল, বিল্লাল, ফরহাদ, মনি, রেজাউল, আনারুল, আব্দুর রব, আক্তার, কবীর ও লোকমান অন্যতম। এরা সরাসরি মাদকের ব্যবসার সাথে জড়িত। হুন্ডি, সোনা ও অস্ত্র ব্যবসা সরাসরি বাদশা নিয়ন্ত্রণ করে বলে সূত্র জানায়। সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র-গুলি ও মাদক বাংলাদেশে পাচার করে এপারের ৪/৫টি সিন্ডিকেট। তারাই আবার এ দেশে থেকে হুন্ডির কোটি টাকা, ডলার ও স্বর্ণের বার পাচার করে নিয়ে যায়। এই চক্রের সাথে রয়েছে, লাল্টু, কওরবান, কবীর, সজল, ইব্রা, ও বনি গং। অতি সম্প্রতি সীমান্তের রাজাদের রাজা বাদশা মল্লিকের একটি চালান আটক করেছে বিজিবি। বস্তায় করে ভারত থেকে পাচার করে নিয়ে আসার সময় গত ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার ভোর রাতে বেনাপোল পোর্ট থানার ঘিবা সীমান্তে হাবিলদার সিগন্যাল মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে বিজিবি অভিযান চালায়। বিজিবির অভিযানে উদ্ধার হয় ১১ টি পিস্তল, ৫০ রাউন্ড গুলি, ২২টি ম্যাগজিন ও ১৪ কেজি গাঁজা এ সময় তিনজন পাচারকারীকে আটক করে তারা। আটককৃতরা হলো বেনাপোল পোর্ট থানার ধান্যখোলার সর্বাংহুদার সহিদ বিশ্বাস এর ছেলে আনারুল, সাবেদ আলীর ছেলে আলমগীর হোসেন ও ঘিবার এজুবার মিয়ার পুত্র সাজজুলকে। আসামিরা বিজিবি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে অস্ত্র গোলাবারুদ এবং গাঁজা ভারতের ভিড়া গ্রামের চোরাকারবারী কোরবান আলী এবং লাল্টু মিয়ার নিকট হতে সংগ্রহ করে আনে। পাচারকৃত অস্ত্র-গুলি-ম্যাগজিন ও মাদকের মালিক বাংলাদেশী মাদক সম্রাট বেনাপোল র্পোট থানার নারায়নপুর গ্রামের কেরামত মল্লিকের ছেলে বাদশা মল্লিক। তার কাছে হস্তান্তরের আগেই তারা ধরা পড়েছে। এই ঘটনার পর থেকে বাদশা গা ঢাকা দেয়। সূত্র মতে, যশোর জেলার আলোচিত এসব অস্ত্র-গুলি, স্বর্ণ-হুন্ডি এবং মরণনেশা ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজা ব্যবসায়ীরা প্রত্যেকেই পুলিশের তালিকাভুক্ত। বহুবার গ্রেফতারও হয়েছে, কিন্তু ব্যবসা ছাড়েনি। বরং জেল থেকে বরিয়ে তারা হয়ে উঠেছে আরও বেপরোয়া। সবঘাট ম্যানেজ করেই নাকি মাদক সম্রাট বাদশা মল্লিকের সিন্ডিকেটের এই ব্যবসা চলছে বলে প্রচার করেন তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ঢাকা-চট্রগ্রাম থেকে বেনাপোল আর কোলকাতা থেকে রঘুনাথপুর ও ঘিবা পর্যন্ত রয়েছে দুর্ধর্ষ বাদশা সিন্ডিকেটের তৎপরতা। এরকম বড় মাপের আরও অন্ততঃ ৪০/৫০ টি সিন্ডিকেট সীমান্ত এলাকায় রয়েছে। একাধিক মামলার আসামি হয়েও প্রকাশ্যে মাদকের ব্যবসা করেছে দুর্ধর্ষ সব ব্যবসায়ীরা।
কুখ্যাত বাদশা মল্লিকের সিন্ডিকেটের অস্ত্র উদ্ধার মামলার বিষয়ে মামলার তদন্তকর্তা এসআই জাকির হোসেন বলেন, মামলার আইও হিসাবে এই চক্রের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনতে আটক আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হলেও বিজ্ঞ বিচারক রিমান্ড মঞ্জুর করেননি। বাদশা বর্তমানে পলাতক রয়েছে। মামলাটি বর্তমানে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ে বেনাপোল পোর্ট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে বলেন, এ বিষয়ে তেমন কিছু বলার নেই। আসামিদের রিমান্ড হয়নি। আর এসব মামলা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মামলাটি বর্তমানে নিষ্পত্তির পথে।