মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাখ্যান : অশান্ত হাটহাজারী ক্ষোভ, বিক্ষোভ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ফের বিক্ষোভে উত্তাল চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা। দুই মাসের জন্য মাদ্রাসা বন্ধের খবরে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে তারা বিক্ষোভে নামেন। এ সময় আল্লামা শফীকে অবরুদ্ধ ও আনাস মাদানীসহ অনুসারী শিক্ষকদের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। এই বিক্ষোভের মূলে আল্লামা শফীপুত্র আনাস মাদানীর ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক পদে আসীন হয়ে একের পর এক ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন আনাস মাদানী। ওদিকে গতকাল সন্ধ্যার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধের আদেশ দেয়া হয়। এ আদেশের পর আন্দোলনকারীরা মাদ্রাসার মসজিদের মাইকে তা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। বলেন, আমাদের মাদ্রাসা সরকারি নয়।
তাই এই মাদ্রাসা বন্ধের সিদ্ধান্ত সরকার দিতে পারে না। আমরা এ আদেশ মানি না। মাদ্রাসার শূরার সদস্যরা বৈঠকে মাদ্রাসা বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলে আমরা তা মেনে নেব। অন্যথায় আন্দোলনের দাবানল জ্বলবে বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন তারা। এরমধ্যে হেফাজতের ফান্ডের টাকা তছনছ, সিনিয়র নেতৃবৃন্দের অবমূল্যায়ন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে জুনায়েদ বাবুনগরীকে পদত্যাগে বাধ্য করা, নিয়মনীতি না মেনে মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা, নিয়োগ বাণিজ্য, কওমি সনদ স্বীকৃতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়ার একচ্ছত্র সিদ্ধান্তই এই ক্ষোভের কারণ। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, আল্লামা শফী বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। একাধিকবার তাকে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। মাদ্রাসার প্রশাসনিক তদারকিতে তিনি অক্ষম। দাপ্তরিক কাজে মাওলানা আনাস মাদানীনির্ভর তিনি। এ সুযোগে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আল্লামা শফীর প্রেস সচিবসহ ১১ শিক্ষক-কর্মকর্তাকে কোনো রকম নোটিশ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ ছাড়া হাটহাজারী মাদ্রাসা, হেফাজতে ইসলাম ও কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের (বেফাক) ওপর প্রভাব বিস্তার করেন আনাস মাদানী। এভাবে নানা সংকট তৈরির কারণে হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করেছেন সিনিয়র ধর্মীয় নেতা মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী। এই পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমীর মুফতি ইজহারুলসহ প্রায় ৫০০ আলেম। মুফতি ইজহারুল ইসলাম ওই সময় হেফাজতে ইসলামে সৃষ্ট সংকটের কারণ হিসেবে শাপলা চত্বরে ঘোষিত কর্মসূচিতে দলীয় সমন্বয়হীনতাসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যখন কোনো কিছুর মাত্রাতিরিক্ত হয়, তখন তা থেকে ক্ষোভ তৈরি হয়। কোনো কিছু পেলে শুকরিয়া আদায় করতে হয়। কিন্তু সেই শুকরিয়া যদি কখনো অতি শুকরিয়ায় পরিণত হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। তিনি বলেন, কওমি সনদ স্বীকৃতির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেন মাওলানা আনাস মাদানী। এ ঘটনায় মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর মতো একজন সিনিয়র আলেমে দ্বীন হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করলেন। এটা কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি আমাদের অধিকার। অধিকার আদায় মানে এই নয় যে, আমরা কারো কাছে বিক্রি হয়ে গেলাম।
তিনি বলেন, ৫ই মে শাপলা চত্বরে ট্র্যাজেডিতে হেফাজতে আমীর আল্লামা শফীর সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। দলমতনির্বিশেষে সবাই হেফাজতের আন্দোলনে ছিল। ব্লগাররা যখন আমাদের প্রিয় নবী ও তার স্ত্রীদের নিয়ে কটূক্তি করেছিল। রাসূলের শানে বেয়াদবি করেছিল তখনই এর প্রতিবাদ জানাতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামে। আল্লামা শফী সাহেব মুরুব্বি হওয়াতে আমরা তাকে সামনে রেখেছি। কিন্তু সেদিন শফী সাহেব জাতিকে এক বিশাল সমুদ্রে ফেলে দিয়ে নিজের ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন। রেখে আসেন মাদ্রাসার শিক্ষক ও হেফাজত নেতা জুনাইদ বাবুনগরীকেও। সেদিন শফী সাহেব যদি বলতেন আমি আমার শিক্ষক ও ছাত্রদের না নিয়ে যাবো না, তাহলে পুলিশের যত ক্ষমতাই থাকুক আমাদের দাবি মানতে বাধ্য হতো।
আর এসব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এরই প্রেক্ষিতে বুধবার দুপুর থেকে শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। ছাত্রদের দাবিগুলো ছিল, মাদ্রাসা থেকে মাওলানা আনাসের বহিষ্কার, আল্লামা শফীর সম্মানজনক অবসর, চাকরিচ্যুত শিক্ষক-কর্মচারীদের বহাল, আনাস মাদানী কর্তৃক শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ বাতিল, শিক্ষার্থীদের ওপর সব ধরনের জুলুম ও হয়রানি বন্ধ, মাদ্রাসার শূরা মজলিস থেকে অযোগ্যদের বাতিল। তবে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে বুধবার রাতে মাদ্রাসার শূরা মজলিসের তিন সদস্যের বৈঠকে মাওলানা আনাসকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত হয়। বাকি সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে শনিবার বৈঠকে বসার কথা জানানো হয়। ফলে রাত ১১টার পর বিক্ষোভ থামায় ছাত্ররা। কিন্তু বৃহসপতিবার ভোরে আল্লামা শফী শিক্ষকদের ডেকে দুই মাসের জন্য মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা দেয়ার কথা জানায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর নতুন করে আন্দোলনে নামে ছাত্ররা।
এ বিষয়ে কথা বলতে মাওলানা আনাস মাদানীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি তিনি। মেসেজ দিলেও সাড়া দেননি। তবে আল্লামা শফীর অনুসারী হাটহাজারী মাদ্রাসার শূরা সদস্য ও মেখল মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা নোমান ফয়জীর দাবি, বৃহসপতিবার সকালে শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আহমদ শফী। মাদ্রাসা বন্ধের সিদ্ধান্ত দেননি। বৈঠক ডাকার খবর শুনেই অতর্কিত হামলা ও ভাঙচুর শুরু করে আন্দোলনকারীরা। তাদের হামলায় আহত হয়েছেন কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মচারী। এমনকি আল্লামা আহমদ শফীকে নিজ কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এদিকে ছাত্র বিক্ষোভের বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার রাশেদুল হক বলেন, মাদ্রাসার ভেতরে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আবারো উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ছাত্ররা গেইট বন্ধ করে ভেতরে আন্দোলন করে। ফলে আমরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। বাইরে আছি। পুলিশ-র‌্যাব সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আন্দোলনকারীরা বলেন, আমাদের দাবি পূরণ না করে মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তাই আমরা আমাদের দাবি পূরণের জন্য এই আন্দোলন অব্যাহত রাখবো। আন্দোলনকারীদের বাকি দাবিগুলো পূরণের জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে হেফাজত ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফীর কার্যালয়, সহযোগী পরিচালক আল্লামা শেখ আহমদ কার্যালয়, আল্লামা ওমর ও মাদ্রাসার শিক্ষাভবন ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। খবর পেয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র?্যাব, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও মাদ্রাসার সব গেট বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সতর্কবস্থায় বাইরে অবস্থান করছেন। তবে প্রশাসন যাতে মাদ্রাসার ভেতরে ঢুকে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করে সেজন্য মাদ্রাসার ছাত্ররা মসজিদের মাইকে বারবার মাইকিং করছিল। দাবি আদায় না হলে মাদ্রাসার সমস্ত একাডেমির কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলেও মাইকে ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারী ছাত্ররা। তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি হলে দেশের সমস্ত কওমি মাদ্রাসায় আন্দোলনের দাবানল জ্বলে উঠবে।