ড্রেজার কেনা হলেও নদীর গভীরতা বাড়ে না কেন?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশের প্রধান নদীগুলোর নাব্যতা ধরে রাখতে সরকারি টাকায় প্রায় প্রতিবছর কেনা হয় ড্রেজার। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের বেশিরভাগ সময় এগুলো থাকে অকেজো কিংবা নষ্ট। এ কারণে নদী খননের কাজ সেভাবে হয় না। তাই নাব্যতা কমতে থাকে দ্রুত। ফলে পানি ধারণের ক্ষমতা হারায় নদী। এজন্য নদীর পানি লোকালয়ে উঠে এসে সৃষ্টি হয় বন্যা। প্রায় প্রতিবছরই এমন পরিস্থিতি দেখা যায়। এর প্রভাবে ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু বিলীন হয়। কখনও কখনও বন্যার দীর্ঘস্থায়ীত্বে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ২০১৩ সাল পর্যন্ত তাদের বহরে ছোটবড় মিলিয়ে মোট ২৮টি ড্রেজার ছিল। এগুলোর মোট বার্ষিক খনন ক্ষমতা ছিল ৫০ লাখ ঘনমিটার। কিন্তু চাহিদামাফিক ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণমূলক ড্রেজিং সফলভাবে সম্পাদনের জন্য এই বাৎসরিক খনন ক্ষমতা প্রায় ২০০ কোটি ঘনমিটারে উন্নীত করা প্রয়োজন।
জানা গেছে, দেশের প্রধান নদীগুলোর ক্রমবর্ধমান ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণমূলক ড্রেজিং চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বা পাউবো’র ড্রেজিং সক্ষমতা বাড়াতে এবং টেকসই নদী ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করতে ‘বাংলাদেশের নদী খননের জন্য ড্রেজার ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয়’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নতুনভাবে আরও ২১টি ডেজার কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বছরে ড্রেজিং সক্ষমতা ২৫০ লাখ ঘনমিটার বাড়বে। আশার কথা হলো, পাউবো দেশের ২৪টি নদ-নদীর ভাঙন, নদী ভরাট, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে নদীর নাব্যতা ও ধারণক্ষমতা পুনরুদ্ধারে ড্রেজিং সমীক্ষা শেষ করেছে। এর মধ্যে ছোটবড় মিলিয়ে ৮টি ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনা নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও নদী ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে ছোটবড় মিলিয়ে মোট ৪৫টি ড্রেজার সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো দিয়ে চলছে নৌ-রুট খননের কাজ। নদীপথে বিভিন্ন চ্যানেলের গভীরতা রক্ষায় ভূমিকা রাখছে এসব।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুকের মন্তব্য– ‘শুধু নদী খননই নয়; পানি নিষ্কাশন, বাঁধ নির্মাণ, নদীর তীর রক্ষা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিস্কাশনসহ সেচের কাজ করে পাউবো। ড্রেজারগুলো সবসময়ই কোনও না কোনও নদী খননের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ও হবে। তবে বছরের বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয় নদীর ভাঙন ঠেকানোতে। প্রকল্পের আওতায় সব ড্রেজার চলে এলে আমাদের নদী খনন বিশেষ করে ড্রেজিং সক্ষমতা বাড়বে।’ এদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন আহমেদের দাবি, ‘ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৫টি ড্রেজার দিয়ে আমরা দৈনন্দিন চ্যানেলগুলো সচল রাখার কাজ করছি। নতুন নতুন আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ড্রেজার আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছে। সেগুলো বেশ ভালো কাজে দিচ্ছে।’
নদী খননের কাজ কার
সময়মতো নদী খননের কাজ নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রশি টানাটানির খবর নতুন নয়। প্রতিবছরই এমনটি শোনা যায়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধির ৭ নম্বরে বলা রয়েছে– বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নদী ড্রেজিং করা। অভিযোগ রয়েছে, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজটি যথাযথভাবে করে না বলেই দেশের নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছরই সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা। একটি সূত্রের দাবি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় নদী খননের চেয়ে বাঁধ নির্মাণে বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করছে। অন্যদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় মনে করে, পুরো নদী খননের কাজ তাদের নয়। প্রয়োজনীয় চ্যানেলের গভীরতা কমে গেলে তা খনন করে নৌপথ সচল রাখা এবং নতুন নতুন নৌপথ সৃষ্টি করাই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মূল দায়িত্ব।
নদীর সঠিক সংখ্যা কত
বেসরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে নদীর সংখ্যা ছিল ৭০০। যদিও সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা কিছুটা কম। ৭০০ নদ-নদীর মধ্যে এখন কোনোরকম টিকে আছে এমন নদীর সংখ্যা প্রায় ২০০। এগুলো বেশিরভাগই শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। কিছু কিছু নদী একবারেই মরে গেছে। বহু নদী, খাল, ঘরবাড়ি ও স্থাপনার নিচে পড়ে গেছে। এককালের উন্মত্ত পদ্মা নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট নদ-নদী রয়েছে ৪০৫টি। এর মধ্যে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলে ১০২টি, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ১১৫টি, উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৬১টি, পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলে ১৬টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ২৪টি। বাকীগুলোর অস্তিত্ব এখন প্রায় বিলীন। বাংলাদেশের প্রধান নদী বলতে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা (ব্রহ্মপুত্র), কর্ণফুলী, তিস্তাকেই বোঝায়। ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে, আর তিনটির উৎপত্তি মিয়ানমারে। নদী হলো বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশের প্রাণের স্পন্দন ধরে রাখতে হলে নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে। সময়মতো ড্রেজিংয়ের অভাবে প্রবাহিত স্রোতস্বিনী নদীগুলো ধরে রাখা যাচ্ছে না। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাসহ দেশের প্রধান নদীগুলো বছরে প্রায় ১১০ কোটি টন পলি নিয়ে এসে জমা করে। নদীতে ভাসমান বালি ও মাটি ‘বালুর চড়া’ বা ‘চর’ সৃষ্টি করে। এটি নদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে তীরে ভাঙন ঘটায় ও নাব্যতা হ্রাস করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী ধ্বংসের কারণ শনাক্ত করা এবং নদীর নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং ও পুনঃখনন জরুরি। মজে যাওয়া খাল এবং ছোট ছোট শাখা নদী খনন করা হলে দেশের প্রধান নদীপ্রণালীতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাদের মন্তব্য, শুকিয়ে যাওয়া নদী ও নদীর পাড় দখলমুক্ত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।