সঞ্চয় খরচ করেছেন ২৫ শতাংশ পোশাক শ্রমিক

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করার পাশাপাশি বড় প্রভাব ফেলেছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর। তৈরি পোশাক খাতের রফতানিতে যেমন এটি ধস নামিয়েছে, তেমনি এ খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ওপর কভিড-১৯-এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও মাইক্রো ফিন্যান্স অপরচুনিটিজের (এমএফও) যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের ওপর চলমান এক জরিপে দেখা গেছে, ২৫ শতাংশ পোশাক শ্রমিক সঞ্চয় হতে খরচ করেছেন। আর খরচ চালাতে ধার করেছেন এমন অংশ্রহণকারীদের মধ্যে এ সংখ্যা ১৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার ওপর কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব মূল্যায়ন করতে সানেম ও এমএফও ১৫ সপ্তাহ ধরে ১ হাজার ৩৬৭ জন শ্রমিকদের ওপর ধারাবাহিকভাবে জরিপ চালিয়ে আসছে। এ সিরিজ জরিপে প্রতি সপ্তাহে নতুন প্রশ্ন যোগ করা হয়। সর্বশেষ এ জরিপে ১ হাজার ২৬৯ জন শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন। জরিপটির কিছু প্রশ্ন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে বলে জরিপের ফলাফলের ওপর ‘গার্মেন্ট ওয়ার্কার ডায়েরিজ’ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে একই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়। তবে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা সামান্য পরিবর্তিত হয়। জরিপে অংশ নেয়া শ্রমিকরা চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত আছেন। অংশগ্রহণকারীদের তিন-চতুর্থাংশ নারী, যা পুরো গার্মেন্টস খাতের জেন্ডার বণ্টনের প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
এ জরিপে শ্রমিকদের আয়, আয়ের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং আয়ের ওপর কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব নিয়ে তথ্য উঠে এসেছে। চলমান কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব সম্পর্কে জরিপে অংশ নেয়া শ্রমিকদের জিজ্ঞাসা করা হলে তাদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ জানিয়েছেন, কভিড-১৯ সংকট তাদের জীবিকার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। অন্যদিকে বাকিরা কিছুটা হলেও প্রভাবের কথা বলেছেন। জীবিকার ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাবের বিষয়টিতে দেখা গেছে, করোনাকালে আয় করতে কোয়ারেন্টিন নিয়ম ভেঙেছেন ১৫ শতাংশ, বর্ধিত পরিবারের সাহায্যের ওপর নির্ভর করেছেন ৯ শতাংশ, কম খরচের বাসায় উঠেছেন ৪ শতাংশ, অন্য চাকরি খুঁজেছেন ৩ শতাংশ, পারিবারিক দায়িত্বের জন্য চাকরিতে যোগদান বন্ধ করেছে ৩ শতাংশ, বাড়ি ফিরে গেছেন ৩ শতাংশ, অন্য চাকরি পেয়েছেন ২ শতাংশ এবং ১ শতাংশেরও কম পোশাক শ্রমিক খরচ চালাতে সম্পত্তি বিক্রি করেছেন।
অংশগ্রহণকারীদের ৫১ শতাংশ জানিয়েছেন, মহামারীর আগে তারা পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতেন। এদের মধ্যে নারী ৪৭ শতাংশ ও পুরুষ ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ নিয়মিত, ৩৩ শতাংশ মাঝেমধ্যে এবং ৯ শতাংশ কদাচিৎ পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতেন। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারী এ চিত্র কিছুটা বদলে দিয়েছে। যে ৫১ শতাংশ আগে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতেন তাদের ১৮ শতাংশ এখন জানিয়েছেন, তারা এখন আর পরিবারের কাছে টাকা পাঠান না। ৫৮ শতাংশ আগের চেয়ে কম টাকা পাঠান বা আগে যতবার টাকা পাঠাতেন তার চেয়ে কমবার পাঠান। ২২ শতাংশ জানিয়েছেন, আগে যেমন টাকা পাঠান ঠিক তেমনি টাকা তারা পরিবারে পাঠাচ্ছেন। অর্থাৎ মহামারীর ফলে পরিবারের কাছে পাঠানো অর্থের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। অন্যদিকে ২ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা আগের চেয়ে এখন বেশি অর্থ পরিবারে পাঠান।
সানেম এবং এমএফওর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এ জরিপগুলো ‘গার্মেন্ট ওয়ার্কার ডায়েরিজ’ শীর্ষক প্রকল্পের অংশ। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বৈশ্বিক পোশাক সরবরাহ ও উৎপাদক দেশগুলোয় নিয়োজিত শ্রমিকদের শ্রমঘণ্টা, আয়, ব্যয় এবং অন্যান্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিয়মিত, নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে সরকারি নীতি, শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায় এবং কারখানা ও ব্র্যান্ডের মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করা।
চলমান এ জরিপে দেখা গেছে, উপার্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিরাট একটি অংশের প্রত্যক্ষ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাড়িতে পাঠানো অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এমন সংখ্যা ৫৮ শতাংশ। অন্যদিকে ৪২ শতাংশ জানিয়েছেন, উপার্জিত অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে সেটির সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নেন।
দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেয়া শ্রমিকদের মধ্যে একটি বড় অংশ চাকরির জন্য তাদের জন্মস্থান থেকে অভিবাসন করেছেন। সংখ্যায় কম হলেও অনেক শ্রমিক একাধিকবার অভিবাসন বা জায়গা বদল করেছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৯ শতাংশ অন্তত একবার হলেও অভিবাসন করেছেন। যাদের মধ্যে ৯১ শতাংশ নারী ও ৮৩ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক। অন্যদিকে ৮১ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিক জানিয়েছেন, তারা চাকরির জন্য অভিবাসন করেছেন। এদের মধ্যে চাকরির জন্য অভিবাসীদের ৬৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা একবারই অভিবাসন করেছেন। আর ২৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা দুইবার অভিবাসন করেছেন এবং ১২ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা তিন বা তারও বেশি অভিবাসন করেছেন।
কেন অভিবাসন করেছেন—এ প্রশ্নের উত্তরে ৩০ শতাংশ জানিয়েছেন, বাড়িতে তাদের চাকরির সুযোগের অভাব রয়েছে। এছাড়া দারিদ্র্যের কারণে ২২ শতাংশ, স্বামী-স্ত্রী বা পরিবারের সঙ্গে থাকতে ১৬ শতাংশ, বেশি আয়ের জন্য ৮ শতাংশ, শহরে থাকতে পছন্দ করার কারণে ৮ শতাংশ, বিয়ে করতে ৬ শতাংশ, অভিবাসনে বাধ্য হওয়ার কারণে ৫ শতাংশ, পারিবারিক সমস্যায় ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে অভিবাসন করেছে ২ শতাংশ পোশাক কর্মী।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা মাইক্রোফিন্যান্স অপরচুনিটিজের উদ্যোগে বাংলাদেশ, ভারত ও কম্বোডিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে এ প্রকল্প শুরু হয় ২০১৬ সালে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচটি উৎপাদক দেশের শ্রমিকদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ও সেগুলো প্রকাশ করা। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এ তথ্য-উপাত্ত বৈশ্বিক সরবরাহ ধারায় স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে।