ড্রাগন কূটনীতি নানা সমীকরণ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বদলে যাওয়া দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে ক্রমশ। নেপালের বিদেশমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গ্যায়ালির মুখে ভারতের তীব্র সমালোচনা শুনে যে কারণে কোনো বিস্ময় তৈরি হয় না। অথচ একসময় এটা ভাবাই যেতো না! ভারত-পাকিস্তান শত্রুতা কিংবা চীন-পাকিস্তান দোস্তি- কোনোটাই এ অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে যা একেবারেই অভিনব। যেন নতুন ‘দাদা ভাইয়ের’ ভূমিকা নিয়েছে চীন। আফগানিস্তানেও চালকের আসনে ড্রাগন ডিপ্লোমেসি। ভারতের পুরনো বন্ধু মালদ্বীপের সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতুটি তৈরি করে দিয়েছে চীন। ওই সেতুর বর্ণাঢ্য উদ্বোধনীতে চীনের রাষ্ট্রদূতের গাড়ি ছাড়া অন্যদের আরোহণ সম্ভব হয়নি। লাদাখ সীমান্তে চীন-ভারত উত্তেজনা জিইয়ে থাকার পটভূমিতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনীতির সমীকরণ আরো জটিল হচ্ছে।
ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে থাকা বাংলাদেশ নিয়ে এখন অন্তহীন আলোচনা। এখানে ড্রাগনের প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়ে দুনিয়াজুড়ে কথাবার্তা হচ্ছে। ঢাকার সামনে এখন এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের মিত্র। এ দেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দিল্লি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ভারতের প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তিস্তা, সীমান্ত হত্যা, রোহিঙ্গাসহ স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো নিয়ে দুই বন্ধু রাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় ধরার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে তিস্তা নিয়ে ঢাকা-দিল্লি আলোচনা চলছে। কিন্তু আজ অবধি সুরাহার কোনো ইঙ্গিত নেই। তিস্তা ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় অনেক ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে হতাশা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপড়েন বাংলাদেশ-চীনকে কাছাকাছি করেছে। তবে এটিই ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের মূল ভিত্তি নয়। এ সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি অর্থনীতি। যদিও চীন এখন তার কার্যক্রমকে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সীমাবদ্ধ রাখছে না। ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করেছে রাজনীতিকেও। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে হিসাব পাল্টে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে রাজনীতির মূল সুর হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। মেগা প্রকল্পগুলো থাকছে প্রধান আলোচনায়। আর এসব প্রকল্পের প্রধান অর্থদাতা হচ্ছে চীন। যদিও ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা-বেইজিং হৃদ্যতা দিল্লিকে অগ্রাহ্য করে নয়। এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে ঢাকা।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, সম্প্রতি যে সংবাদটি দিল্লিকে বেজায় অস্বস্তিতে ফেলেছে তা হলো তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের উন্নয়নে চীনের একটি সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ! যা ঠেকাতেই নাকি দিল্লির বিদেশ সচিব ঢাকায় উড়ে এসেছিলেন এমনও বলাবলি আছে। যদিও তার সাম্প্রতিক ঢাকা সফর ছিল অনেকটাই বেসুরো। বহুল আলোচিত তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তিস্তার সমস্যা আমাদের বহুদিন ধরে। তিস্তা বর্ষা মৌসুমে পানিতে ভরে যায় আর শীত মৌসুমে শুকিয়ে যায়। শীতের মৌসুমে যেন তিস্তা শুকিয়ে না যায় এজন্য পানিটা ধরে রাখতে হবে। এ কারণে তিস্তার অবকাঠামো নির্মাণে অর্থায়ন দরকার। এই অর্থায়ন যদি চীন দিয়ে থাকে এটা তো ভারতের মাথাব্যথা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়ার মূল্যায়ন ‘চীন আসলেই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঋণ হিসাবে এক বিলিয়ন ডলার দেবে তারা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা অবশ্য বলছেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে বুঝাপড়ার বিষয়টি ঝুলে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে পানির প্রবাহ বাড়াতে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ নামক ওই প্রকল্প প্রস্তাব করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রায় আট হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্প এখনো ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির পর্যায়ে রয়েছে, যা চীন বিনা পয়সায় করে দিচ্ছে। ভারতকে কাউন্টার করতে কোনো প্রকল্প গৃহীত হয়নি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন কোন্‌ পথে?
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণ ছেপেছে বিবিসি বাংলা। এতে মোটা দাগে যে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে তা হলো- বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নানামুখী আলোচনার পটভূমিতেই অনেকটা আচমকা ঢাকায় উড়ে এসেছিলেন দিল্লির বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। দিল্লির গরজেই সফরটি হয়েছিল। তবে এ সফর কতটা কার্যকর বা ফলপ্রসূ হয়েছে তা নিয়ে অস্পষ্টতা যে এখনো রয়েছে সেটিও ওঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের বিশ্লেষণে। বলা হয়েছে- বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে শীতলতা বা অস্বস্তি নিয়ে যে জল্পনা তা খণ্ডনের চেষ্টা করে চলেছে দিল্লি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের বক্তব্যেও অস্বস্তির বিষয়টি ছিল। তবে তিনি দাবি করেছেন নানা আলোচনার বিপরীতে দুই দেশের ‘ভালো সম্পর্কের’ বিষয়টিকে তারা মোটেও খাটো করে দেখছেন না। বরং ভালো সম্পর্কের বিষয়টি আগামী দিনে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে নিয়মিতভাবে ব্যাপক প্রচার তথা উপস্থাপনে উৎসাহিত করতে ঢাকা-দিল্লি একমত হয়েছে। ভারতের বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার মতে, দুই দেশের সম্পর্ক এখন যেকোনো সময়ের তুলনায় গভীর। তিনি এটাকে বরাবরের মতো ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে অভিহিত করে গেছেন। ঢাকা এবং দিল্লির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য যাই হোক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর রওনক জাহান মনে করেন, বড় দেশ হিসেবে ভারত প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর সমর্থন তাদের পেছনে আছে এটা ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু এটা সত্য যে, বাংলাদেশের জনগণ গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন নীতির কারণে ক্ষুব্ধ। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তিনি বিবিসিকে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত সমর্থন ভারতের কাছে পায়নি। তারপরও প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কখনই আগ বাড়িয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি যাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। ওই বিশ্লেষকের মতে, বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থেই চীনসহ অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। ভারতের আচরণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীন একটা জায়গা করে নিচ্ছে বিশ্লেষকদের এমন দাবিও তুলে ধরা হয় বিবিসি বাংলার বিশ্লেষণে। এ-ও বলা হয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ঘাটতির বিষয়টি ভারত এখন অনেক বেশি অনুধাবন করছে। সে জন্য তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ঢাকায় ড্রাগনের প্রভাব আসলে কতটা?
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ-চীন আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের সূচনা ১৯৭৬ সালে হলেও দুটি জনপদের সম্পর্ক বহু পুরনো। ১৯৬৭ সালে মওলানা ভাসানীকে দেয়া মাও সেতুংয়ের ট্রাক্টরটি পারস্পরিক যোগাযোগের চিহ্ন বহন করে। তারও আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৫২ সালে) গণচীন সফর করেছিলেন। আজকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব তা আচমকা নয় বলেও মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-বেইজিং এবং ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের তুলনামূলক বিশ্লেষণ ছাপা হচ্ছে হরহামেশা। একটি বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের লিগ্যাসি বা ধারাবাহিকতা যেমন রয়েছে তেমনি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধনও প্রগাঢ়। বিশ্লেষণ বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ছিয়াত্তর সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনের তেমন প্রভাব ছিল না। ’৭৬-এ বেইজিং সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হয়। ক্রমেই তারা শক্তপোক্ত এক অর্থনৈতিক-সামরিক ভরসা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের কাছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সফরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তার ঘোষণা দেন সফরকারী প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। হাই প্রোফাইল ওই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক কৌশলগত সম্পর্কে রূপান্তর হয়। শি’র সফরে ২৭টি প্রকল্পে ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি মিলেছিল। এ নিয়ে সমঝোতা স্মারকও (এমওইউ) সই হয়েছিল। নতুন করে বাংলাদেশ আরো নয়টি প্রকল্পে ৬৪১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার ঋণ চেয়েছে চীনের কাছে। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক যখন গভীর হচ্ছে বলা হচ্ছে তখন সাম্প্রতিক একটি বিষয়ে অস্বস্তিও দেখা গেছে। দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে তাইওয়ানের উপস্থিতি বা কার্যক্রম প্রশ্নে বরাবরই চীনের উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিএনপি আমলে ঢাকায় তাইওয়ানের ট্রেড সেন্টার খোলার অনুমতি দেয়ায় পানি ঘোলা হয়েছে অনেক। অতি সম্প্রতি তাইওয়ান বাংলাদেশকে কিছু মেডিকেল সামগ্রী উপহার পাঠিয়েছিল। ৩ জন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতায় তা গ্রহণ করেছিল ঢাকা। শি সরকার যে এতে দুঃখ পেয়েছে তা তুলে ধরে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের তরফে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণও করা হয়েছে।