শ্রিংলার সফর ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

0

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা হঠাৎ করে ঢাকা সফরে আসেন। কোনো সফরসূচি বা আনুষ্ঠানিক পূর্বঘোষণা না থাকায় একে একটি অনানুষ্ঠানিক সফর হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, দুই দেশের সম্পর্ক এতটাই বহুমাত্রিক যে এর মধ্যে নানা উপাদান রয়েছে, যে কোনো সময় সফর হতেই পারে। শ্রিংলা ঢাকা এসে প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বুধবার পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। এ থেকেই শ্রিংলার এ সফরের গুরুত্ব ও গভীরতা আঁচ করা যায়। বাংলাদেশ বা ভারত সরকারের তরফ থেকে এ সফর নিয়ে প্রকাশ্য কিছু বলা হলেও ভারতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষত ভারত ও চীনের মধ্যকার সীমান্ত উত্তেজনা এবং উপমহাদেশের দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন যখন প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে তখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং ক্রমশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার বাস্তবতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এহেন প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই অকষ্মাৎ বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব এবং ঝানু ক‚টনীতিক হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। দুই দেশের সম্পর্কের দূরত্ব ঘুচিয়ে এগিয়ে নেয়াই তাঁর এই সফরের লক্ষ্য বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় আসীন, দুই দেশের ক‚টনৈতিক ও শীর্ষ পর্যায় থেকে গত এক দশক ধরে এ দাবী করা হচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মূল্য দিয়ে এ সময়ে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে বাংলাদেশ। বিনিময়ে ন্যায্য ও প্রত্যাশিত কিছুই পায়নি বাংলাদেশ। তিস্তার পানিচুক্তি, গঙ্গার পানিবন্টন, সীমান্ত হত্যা, মাদক চোরাচালান, বাণিজ্য বৈষম্য ইত্যাদি কোনো বিষয়েই ভারতের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায়নি। উপরন্তু বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে ভারতকে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করতে দেখা গেছে। সমুৃদ্রসীমা নিরাপত্তার জন্য চীন যখন বাংলাদেশকে সাবমেরিন সরবরাহ করে ভারত তখন তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। এটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নিদর্শন নয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থান, তৈরী পোশাক রফতানিখাতের রেমিটেন্স দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্বায়ণ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারায় আঞ্চলিক ও আন্তজার্তিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ধারায় বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ। ভ‚-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ও উন্নয়ন অংশীদারিত্বের সম্পর্ক যেমন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, একইভাবে ভারতের সাথেও শত শত কোটি ডলারের যৌথ বিনিয়োগ, ঋণচুক্তি এবং উন্নয়ন অংশীদারিত্ব রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষ মেগাপ্রকল্পসহ চীনা প্রকল্পগুলো যতটা দ্রæততার সাথে এগিয়ে চলেছে ভারতীয় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো ততটাই পিছিয়ে পড়েছে। ভারত যখন বছরের পর বছর ধরে তিস্তা পানি চুক্তি নিয়ে টালবাহানা করছে চীন তখন তিস্তা প্রকল্পে শতকোটি ডলারের বিনিয়োগ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইছে। বাংলাদেশ নি:সন্দেহে তার উন্নয়নের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবে। ভারতের সাথে বন্ধুত্ব চীনা বিনিয়োগ ও উন্নয়ন অংশীদারিত্বে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। বিআরআইসহ চীনা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাপরিকল্পনায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ থেকে ভারত নিবৃত্ত করতে চাইলে তা’ মেনে নেয়া সমীচিন হবে না।
ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব ঢাকায় এসে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার পুর্নব্যক্ত করেছেন। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন সময়ে ভারতের তরফ থেকে এমন অঙ্গীকার করা হয়েছিল। বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের নদনদীগুলো শুকিয়ে গেছে। তিস্তার ভাটিতে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একদিকে শুকনো মওসুমে সেচ প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে, আবার বর্ষায় পদ্মা-যমুনায় বন্যা ও ভয়াবহ ভাঙ্গনের মুখে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। একদিকে বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের উচ্চতার কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব আইন করে ভারত থেকে কোটি মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। এভাবে দ্বিপাক্ষিক সর্ম্পক এগুতে পারেনা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল সেমিনারে ভারতীয় ক‚টনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই বলেছেন, ভারত নিজের স্বার্থে তার প্রতিবেশিদের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়। আঞ্চলিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি সঠিক ধারায় উন্নয়নের মহাসরণিতে এগিয়ে চলেছে। ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রেখেও চীনা বিনিয়োগ বা পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর সাথে টেলি সংলাপ হতে পারে। শেখ হাসিনা তা দেখিয়ে দিয়েছেন। সব ক্ষেত্রে ভারতের সন্দেহ ও আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভূটানের সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন তার বড় প্রমান। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা এগিয়ে নিতে চাইলে নিজেদের ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা থেকে ভারতকে বিরত থাকতে হবে। সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরীতা নয়, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই নীতি মেনে চলে বাংলাদেশ। ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য ও আলোচ্য বিষয়গুলো নিয়ে কোনো রকম রাখঢাক বা গোপনীয়তা কাম্য নয়। সবকিছুই জনগণের সামনে খোলাসা করতে হবে। তা না হলে অনভিপ্রেত জল্পনা কল্পনা ও গুজবের পাখা বিস্তৃত হতে পারে।