প্রমাণ পেয়েছে সমাজসেবা অধিদফতরের তদন্ত কমিটি : নির্মমতা গোপন করতে সিসি ক্যামেরার ভিডিওচিত্র মোছেন কর্মকর্তারা

0

মীর মঈন হোসেন মুসা ॥ শুধু পৈশাচিকভাবে কিশোর বন্দিদের ওপর নির্যাতন নয়, ঘটনা গোপন করতে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলাসহ ঘটনা ধামাচাপা দিতে যা যা করার দরকার সবকিছুই করেছিলেন কর্মকর্তরা। পরিকল্পনাসহ এই বন্দি কিশোরদের ওপর নির্যাতনের মূল ভূমিকায় ছিলেন যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের উপ-তত্ত্বাবধায়ক (প্রবেশন অফিসার) মাসুম বিল্লাহ ও ফিজিক্যাল ইনসট্রাক্টর একেএম শাহানুর আলম। বন্দি কিশোরদের হতাহতের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে এধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। তাছাড়া সমাজসেবা অধিদফতর গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে।
অপরদিকে বুধবার দুপুরে জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন ও তদন্ত কর্মকর্তা চাঁচড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইনসপেক্টর মো. রোকিবুজ্জামান ফের যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। এদিকে ৩ বন্দি কিশোর হত্যার মামলায় আনিস নামে আরও এক কিশোরকে শ্যোন অ্যারেস্ট করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। চুয়াডাঙ্গায় বাড়ি এই বন্দিকে বুধবার আদালতের মাধ্যমে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। এছাড়া রিমান্ডে আনা সাময়িক বরখাস্ত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) আব্দুল্লাহ আল মাসুদসহ আরও ৩ কর্মকর্তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সাইফুদ্দীন হোসাইন এ সময় তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ৩ কিশোর ‘বন্দি’ হত্যার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা নির্যাতনের তথ্য প্রমাণাদি পেয়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছেন। তারা ইতোমধ্যে পেটানোর কাজে ব্যবহৃত ক্রিকেটের বেশ কয়েকটি স্ট্যাম্প ও লোহার রড জব্দ করেছেন। মারপিটের কারণে দু একটি স্ট্যাম্প ভেঙ্গেও গেছে। নিহতদের রক্তমাখা জামাও আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে কোজসার্কিট (সিসি) ক্যামেরা রয়েছে। যেখানে বন্দি কিশোরদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় সেখানেও সিসি ক্যামেরা আছে। বন্দি কিশোরদের ওপর নির্যাতনের পর ঘটনার সময়কার ধারণকৃত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ মুছে ফেলা হয়েছে। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের অভিযুক্ত কর্মকর্তারা তাদের কৃতকর্মের ঘটনা ধামাচাপা দিতে সিসি ক্যামেরার ভিডিওচিত্র মুছে ফেলেছেন। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন বলে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন। সূত্র আরও জানায়, বন্দি কিশোরদের ওপর নির্যাতন চালানোর মূল ভূমিকায় ছিলেন সাময়িক বরখাস্ত উপ-তত্ত্বাবধায়ক মাছুম বিল্লাহ ও ফিজিক্যাল ইনসট্রাক্টর একেএম শাহানুর আলম। ধরে আনার পর তারা দুজনে প্রথমে কিশোরদের লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিলে। এরপর তাদের অনুগত ৮ কিশোরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পেটানোর জন্য। তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত একটানা পেটানোর জন্য। এই নির্দেশ দেওয়ার পর যতক্ষণ নির্যাতন চালানো হয়েছিলো ততক্ষণ পর্যন্ত অফিস রুমের বারান্দায় পায়চারি করছিলেন মাছুম বিল্লাহ ও একেএম শাহানুর আলম। মারপিটের পর অনুগত কিশোর বন্দিদের দিয়ে নির্যাতিতদের ডরমেটরির রুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। নির্যাতিত এই কিশোর বন্দিদের মধ্যে পরে ৩ জন পারভেজ হাসান রাব্বি, রাসেল ওরফে সুজন ও নাঈম হোসেন মারা যায়। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চাঁচড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ ইনসপেক্টর মো. রোকিবুজ্জামানসহ পুলিশের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা বুধবার দুপুরে ফের যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
এদিকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৩ বন্দি কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পেয়েছে সমাজসেবা অধিদফতরের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি। মঙ্গলবার কমিটির সদস্যরা ঢাকায় ফিরে গেছেন। বুধবারের ভেতর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা ছিলো তাদের। তবে জমা হয়েছে কি-না তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ নুরুর বাসির সাংবাদিকদের জানান, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ১৩ আগস্টের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন মহাপরিচালকের কাছে জমা দেয়া হবে। কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। অপরদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠিত তিন সদস্যের কমিটি আরও সময় চেয়ে আবেদন করেছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির আহবায়ক যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবুল লাইছ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৩ কিশোর বন্দি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আরও এক বন্দিকে বুধবার আদালতের মাধ্যমে শ্যোন অ্যারেস্ট করেছে পুলিশ। যোগাযোগ করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইনসপেক্টর মো. রোকিবুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, এর আগে ১৬ আগস্ট অভিযুক্ত ৭ বন্দিকে আদালতের মাধ্যমে শ্যোন অ্যারেস্ট করা হয়েছে। অভিযুক্ত ৮ বন্দিকে হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অভিযুক্ত ৮ বন্দির বর্তমান বয়স নির্ধারণের জন্য মেডিকেল করানোর চিন্তাভাবনা চলছে। কারণ, তাদের দেখে প্রাপ্তবয়স্ক মনে হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা রোকিবুজ্জামান জানান, ৩ বন্দি হত্যা মামলায় আটক আরও তিন কর্মকর্তার রিমান্ড শেষ হওয়ায় বুধবার তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এরা হচ্ছেন-সাময়িক বরখাস্ত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, উপ-তত্ত্বাবধায়ক (প্রবেশন অফিসার) মাসুম বিল্লাহ ও বরখাস্ত সাইকো সোস্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান। উল্লেখ্য, প্রধান প্রহরী নুর ইসলামকে মারধরের জের হিসেবে গত ১৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের বন্দি কিশোরদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়। এ ঘটনায় ৩ বন্দি নিহত এবং ১৫ বন্দি আহত হয়। হত্যার ঘটনায় পরে নিহত পারভেজ হাসান রাব্বির পিতা রোকা মিয়া কোতয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় পুলিশ অভিযুক্ত ৫ কর্মকর্তাকে আটক করে।