সড়কের ৩ কিলোমিটার যেতে লাগে ৩০ মিনিট!

0

খুলনা সংবাদদাতা॥ প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে খুলনার পাঁচটি সড়ক বেহাল অবস্থায় রয়েছে। এ সড়কগুলোতে যাত্রীবাহী যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মহানগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল সংলগ্ন এম এ বারী লিংক রোড, শিপইয়ার্ড সড়ক, শামসুর রহমান সড়ক, মুজগুন্নি সড়ক ও রূপসা উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ রূহুল আমিন সড়ক সংস্কারের অভাবে এখন প্রায় চলাচলের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মহানগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল সংলগ্ন এম এ বারী লিংক রোডটিতে চলাচলের পরিবেশ নেই। বর্ষার কাদাপানি জমে গর্ত ও খানাখন্দ বড় হয়ে এ সড়কটি এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালের কাছের অংশে প্রায় ৩০ ফুট এলাকায় খালের মতো পরিবেশ সৃস্টি হয়েছে। এছাড়া মহানগরীর শিপইয়ার্ড সড়কেরও বেহাল দশা। ভাঙা সড়কটি এখন অসহনীয়। মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র শামসুর রহমান সড়কও ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে।
মহানগরীর মুজগুন্নি সড়কেরও যাচ্ছে তাই অবস্থা। এছাড়াও রূপসা উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ রূহুল আমিন সড়কটিও বেহাল দশায় রয়েছে। সড়ক জুড়ে খানা-খন্দ ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ সড়ক দিয়ে বালু বোঝাই ড্রাম ট্রাক, হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, পাথর, কয়লা ও টাইলসের মাটির ভারী যানবাহন চলাচল করে। সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল সংলগ্ন বাইপাস সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৩ সালের ৩০ জুন। কাজ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর খুলনা সিটি করপোরেশন ও এজিইডিকে সড়কটি হস্তান্তর করে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। সড়কটির মহানগরীর অংশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) এবং বাকি অংশ এলজিইডি। সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল থেকে জয়বাংলার মোড় পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কটির কার্পেটিং উঠে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। যানবাহন চলাচলের জন্য ভাঙা ইট ফেলা হয়েছে। তবে বৃষ্টি হলেই সড়কের গর্তে জমে হাঁটুপানি।
জানা যায়, শহরকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিন্যাল সংলগ্ন বাইপাস সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় কেডিএ (খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)। ২.৩৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সংযোগ সড়কটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১৮ কোটি টাকা। ২০১১ সালের ৩০ মার্চ প্রথম সংশোধিত প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। সড়কটির নির্মাণ কাজের টেন্ডারের আহ্বান করা হয় ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজটি পায় ঢাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ডিয়েনকো লিমিটেড। ওয়ার্ক অর্ডার হয় ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৩ সালের ৩০ জুন। কাজ শেষ হওয়ার কিছু দিন পর খুলনা সিটি করপোরেশন ও এজিইডিকে সড়কটি হস্তান্তর করে কেডিএ (খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)। সড়কটির মহানগরীর অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) এবং বাকি অংশ এলজিইডির। কিন্তু সংস্কারের অভাবে সড়কটির হয়েছে বেহাল দশা। তিন কিলোমিটার সড়কের দুই কিলোমিটার জুড়েই সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় খানা-খন্দ। চলতি বর্ষা মৌসুমে কোথাও কোথাও পানি জমে পুকুরের মতো জলাশয়ের আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় নগরীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ব্যস্ততম এই সড়কটিতে স্বাভাবিক পরিবহনসহ যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন জনসাধারণ।
এম এ বারী সড়ক সংলগ্ন এলাকার ব্যবসায়ী আবু হাসান বলেন, এ সড়কের পাশে দোকান থাকায় রীতিমতো সমস্যা হয়। শুকনোর সময় ধুলো-বালিতে দোকানে টেকা দায়। আর বর্ষার সময় কাদা পানি ভেযে যাতায়াত করতে হয়। বাসচালক আজমল হোসেন বলেন, খুলনায় ঢুকতে আর বের হতে এ সড়কের তিন কিলোমিটার জায়গা পার হতে ২৫-৩০ মিনিট লেগে যায়। যা যাত্রীদের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। সড়কের প্রায় ৯০ ভাগ অংশই এখন ভাঙা। পিচ ও ইটের খোয়া উঠে গেছে। পথচারী আকলিমা বেগম বলেন, এ সড়কে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য গর্ত ও খানা-খন্দের। সড়কটিতে হেঁটে চলাও দায় হয়ে পড়েছে। গাড়িচালক রানা হাওলাদার বলেন, পেটের দায়ে গাড়ি নিয়ে বের হতে হয়। ভাঙা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে মন চায় না, কিন্তু নিরুপায় হয়ে আমাদের এ সড়কে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। একাধিক বাসচালক জানান, রাস্তাটিতে দীর্ঘদিন সংস্কার কাজ হয়নি। ভাঙা এ সড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে দুর্ভোগ বাড়ছে।
কেডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্তুজা আল মামুন বলেন, কেডিএর নিয়মে রাস্তা সংস্কার বা মেরামতের জন্য কোনও বরাদ্দ থাকে না। সরকারও বরাদ্দ দেয় না। যে কারণে এ রাস্তাটি ২০১৩ সালে তৈরির পর সিটি করপোরেশনে হস্তান্তর করা হয়েছে। সোনাডাঙ্গা থেকে ময়ূরী ব্রিজ পর্যন্ত খুলনা সিটি করপোরেশন ও বাকি অংশটুকু এলজিইডিকে দেওয়া হয়েছে। এলজিইডি অনেকবার সংস্কার কাজ করতে চেয়েও করছে না। সিটি করপোরেশনও সড়কটিতে এখন পর্যন্ত কোনও কাজ করেনি। খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে নতুন রাস্তা মোড় পর্যন্ত মুজগুন্নি সড়কটির অবস্থা এত বেহাল যে, বড় বড় খানা-খন্দ ও গর্ত হয়ে চলাচলের অযোগ্য হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ মহাসড়কটির বিভিন্নস্থানে বিটুমিন উঠে গিয়ে বড় বড় খানা-খন্দের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্নস্থানে ডেবে বড় বড় গর্তে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির সময় এসব স্থানে পানি জমে থাকে। এ অবস্থায় সড়কটি দিয়ে জনসাধারণের চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ সড়কের আশপাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র বিশেষায়িত শেখ আবু নাসের হাসপাতাল, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির সেক্টর সদর দফতর, নৌ-বাহিনীর ঘাঁটি (বানৌজা তিতুমীর), বিএনএন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, অ্যাংকরেজ স্কুল, নৌ-বাহিনী ভর্তি কেন্দ্র, নাবিক কলোনি, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইন, মুজগুন্নী শিশু পার্ক, ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, খুলনা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রায়েরমহল (অনার্স) কলেজ, নগরস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।
মুজগুন্নির বাসিন্দা মো. তহিদুল ইসলাম ও রিয়াজুল ইসলামসহ কয়েকজন চালক জানান, এ সড়কের বেশির ভাগ জায়গায় উঁচু টিলার মতো তৈরি হয়েছে। ফলে মোটরসাইকেল আরোহী ও অন্যান্য গাড়ি চালকরা রাস্তা সমতল ভেবে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে গেলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা এর প্রতিকার চেয়েছেন। খুলনার সম্মিলিত নাগরিক ফোরামের আহ্বায়ক কুদরত-ই-খুদা বলেন, করপোরেশনের পূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের গাফিলতি রয়েছে। সড়কগুলোর যথাযথভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে না। এছাড়া জলাবদ্ধতায় সড়ক নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে সড়ক সংস্কারে বাজেট কম রাখা ও অল্প খারাপ হলে মেরামত করা হয় না। ফলে বেশি খারাপ হলে সংস্কার ব্যয় বেড়ে যায়। অর্থের অভাবে আর সহজে সড়ক সংস্কার হয় না। যার ভোগান্তি পোহাতে হয় জনসাধারণের। গ্লোবাল খুলনার আহবায়ক শাহ মামুনুর রহমান তুহিন বলেন, খুলনার দুর্ভাগ্য, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তায় এই ভাঙাচোরা অবস্থার কারণে প্রতিদিন বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটছে। হাসপাতালে আগত রোগী এবং তাদের আত্মীয় স্বজনরা হাসপাতালের সামনে এসেই দুর্ঘটনা এবং ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। রূপসা উপজেলা প্রকৌশলী এস এম অহিদুজ্জামান বলেন, তিন বছর আগে বীরশ্রেষ্ঠ রূহুল আমিন সড়কটি নির্মাণ করা হয়। মূলত বালু ব্যবসায়ীরা সড়কটি ধ্বংস করে ফেলেছে। এখন সংস্কার করতে হলে আগে বালুর ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. এজাজ মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, চলতি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির কারণে সড়কের বেশির ভাগ স্থানে বিটুমিন উঠে গিয়ে বড় বড় খানাখন্দ ও গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক বৃষ্টির মৌসুমের পর ৬৫০ কোটি টাকা প্রকল্পের আওতায় সংস্কার করা হবে। খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) সূত্র জানায়, মহানগরীতে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) এক হাজার ২১৫টি সড়ক রয়েছে। যার মোট দৈর্ঘ্য ৬৪০ কিলোমিটার। এরমধ্যে মূল সড়কগুলোর দৈর্ঘ্য ২০০ কিলোমিটারের মতো। নগরীর অভ্যন্তরীণ সড়ক হিসেবে মুজগুন্নি মহাসড়কটিও কেসিসির আওতাধীন।