স্বর্ণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানবে কে?

0

লোকসনাজ ডেস্ক॥আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দামে বিদ্যমান ঊর্ধ্বগতি দিন দিন জোরদার হচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মূল্যবান ধাতুটির দাম আউন্সে ২২০ ডলারের বেশি বেড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বাড়তে থাকলে বছর শেষ হওয়ার আগে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম রেকর্ড ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, এ ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানার উপায় কী? মোটা দাগে বলা যায়, নভেল করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে অর্থনীতির গতি ফিরে আসা ও ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্বর্ণের বাজারে রাশ টেনে ধরতে পারে। যদিও এ দুই ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতার কোনো দৃশ্যমান লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
স্বর্ণের বাজার পরিস্থিতি চাঙ্গা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক করোনা মহামারী। বছরের শুরু থেকে মহামারীতে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা কার্যত গতি হারিয়েছে। শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। টানা লকডাউনে আয় কমেছে মানুষের। ফলে মানুষ ব্যক্তিগত ভোগের জায়গা থেকে স্বর্ণ ক্রয় কমিয়ে দিয়েছেন। বিশেষত শীর্ষ দুই ভোক্তা চীন ও ভারতে স্বর্ণের চাহিদা রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। এতে চাহিদা ও বেচাকেনা মূল্যবান ধাতুটির দরপতনের কথা ছিল। তবে বাস্তবে হয়েছে ঠিক উল্টো।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম কার্যদিবসে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের স্পটমূল্য ছিল ১ হাজার ৫২৭ ডলার ৫০ সেন্ট। আর সর্বশেষ কার্যদিবসে মূল্যবান ধাতুটির স্পটমূল্য বেড়ে আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৭৪৭ ডলার ৬০ সেন্টে উঠেছে। অর্থাৎ, ছয় মাসের কম সময়ের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম আউন্সে ২২০ ডলার ৫০ সেন্ট বেড়েছে।
দেশে দেশে ব্যক্তিগত ভোগে স্বর্ণের চাহিদা কমলেও গত ছয় মাসে বিনিয়োগ হিসেবে মূল্যবান ধাতুটির বৈশ্বিক চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে। ডব্লিউজিসি জানিয়েছে, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে অলংকার, প্রযুক্তি, বার ও কয়েন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে স্বর্ণের চাহিদা কমতির দিকে ছিল। বিপরীতে এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড বা ইটিএফ খাতে স্বর্ণের চাহিদা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রেকর্ড ২৫৫ টনের বেশি বেড়েছে। আর এটাই মূল্যবান ধাতুটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মন্দার সময় বিশ্বজুড়ে শেয়ার ও মুদ্রাবাজার অস্থির হয়ে ওঠে। এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা তুলনামূলক নিরাপদ বিবেচনা করে স্বর্ণের বাজারের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। করোনা মহামারীতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে বেচাকেনা বেড়ে স্বর্ণের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। চীন-ভারত সীমান্ত, ভারত-নেপাল সীমান্ত এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে কার্যত যুদ্ধাবস্থা বজায় রয়েছে। এখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি না হলে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। ফলে স্বর্ণের দাম কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে।
বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক বিরোধ নিরসনের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন দক্ষিণের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোর হুমকি দিচ্ছেন বারবার। ভারত ও চীন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে। পরিস্থিতি দিন দিন ঘোলাটে হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারী দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে সেটাও বলা যায় না। উল্টো চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ফলে দুটো ক্ষেত্রেই আশু সমাধানের আশা নেই। এতে আগামী দিনগুলোয় বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা দীর্ঘমেয়াদে অব্যাহত থাকতে পারে, যা স্বর্ণের দাম আরো বাড়াতে পারে।
সম্ভাব্য এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, স্বল্পমেয়াদে বা পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৮০০ ডলারে উঠতে পারে। মধ্যমেয়াদ বা ছয় মাসে তা আরো বেড়ে আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৯০০ ডলার হতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদে বা পরবর্তী এক বছরের মধ্যে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২ হাজার ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।