ঝুঁকিপূর্ণ করোনাবর্জ্য

0

এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। একদিকে করোনাভাইরাস থেকে রা পাওয়ার জন্য পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, স্যানিটাইজারের মতো সুরা সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে, অন্যদিকে এসব ব্যবহৃত সামগ্রী যত্রতত্র ফেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছে। করোনা থেকে বাঁচতে গিয়ে এসব বর্জ্য তা আরও ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে পত্র-পত্রিকায় যেখানে-সেখানে এমনকি হাসপাতাল চত্বরে করোনাবর্জ্য ফেলে রাখার ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বারবার সর্তকবার্তা দিয়েছেন। এতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপরেই টনক নড়েনি। ফলে দিন দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনাবর্জ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশবাদী বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন করোনার শুরু থেকে পরবর্তী এক মাসের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করেছে, এ সময়ে দেশে প্লাস্টিকবর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু গ্লাভসই ছিল ৫ হাজার ৮৭৭ টন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯ জুন পর্যন্ত সরকার দেশের হাসপাতালগুলোতে ২৩ লাখ ৪১ হাজার ৬০৫ সেট পিপিই বিতরণ করেছে। যা থেকে প্রায় ৪০ লাখ কেজি বিপজ্জনক চিকিৎসা বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতরাও ব্যক্তিগতভাবে পিপিই ব্যবহার করছে। এসব চিকিৎসাবর্জ্যের বাইরে ফেসিয়াল টিস্যু, ব্যান্ডেজ, রোগীদের ব্যবহৃত অক্সিজেন, মাস্ক, টেস্ট টিউব, ডিসপোজেবল সিরিঞ্জসহ অন্যান্য বর্জ্য রয়েছে। এসব বর্জ্য সঠিকভাবে সংরণ করে রিসাইকেল বা ধ্বংস করার পরিবর্তে যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে। এতে যেমন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, তেমনি পরিবেশও দূষিত হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়েই দেশে চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়ে তোলা হয়নি। এখন করোনার মতো জরুরি পরিস্থিতিতে তা কতটা বেহাল হয়ে পড়েছে, তা প্রতিদিনের বর্জ্যের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। এক রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার টন গৃহস্থালী বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এ বর্জ্যের সঙ্গে মেডিক্যাল এবং নতুন করে করোনার বর্জ্য যুক্ত হয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। করোনায় ব্যবহৃত ফেলে দেয়া মাস্ক, স্যানিটাইজার বোতল, পিপিই ইত্যাদি সংগ্রহ করে ধুয়ে পুনরায় ব্যবহারের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী, ব্যবহৃত পিপিই একবার ব্যবহার করার পর তা বিপজ্জনক বর্জ্যে পরিণত হয়। এর ফলে করোনা সংক্রমণ আরও বেগবান হয়ে উঠছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি হচ্ছে, যত্রতত্র ফেলা ব্যবহৃত নিরাপত্তা সামগ্রী মাটি ও পানিতে জীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। এর ভয়াবহতা কতটা হতে পারে, তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। করোনা চিকিৎসা নিয়ে শুরু থেকেই সমন্বয়হীনতার চিত্র পরিলতি হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ এ রোগে ব্যবহৃত সামগ্রী কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান করা হয়নি। এখনও একই পরিস্থিতি চলছে। অথচ, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রোগী ও চিকিৎসকদের ব্যবহৃত প্রতিরা সামগ্রীর ব্যবস্থাপনা কি হবে, তা শুরুতেই নির্ধারণ করা উচিৎ ছিল। দেখা যাচ্ছে, যেসব হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, সেসব হাসপাতালে যথাযথভাবে ব্যবহৃত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়নি। ফলে এসব বর্জ্য সাধারণভাবে সংগ্রহ করে উন্মুক্ত ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হচ্ছে। সেখান থেকে টোকাইরা সংগ্রহ করছে এবং তাদের থেকে কেউ কেউ কিনে নিয়ে ধুয়ে বিক্রি করছে। কোনো কোনো েেত্র সেগুলো পোড়ানোর কারণে বাতাসও বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে করোনাসহ অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতালে বর্জ্য শোধনের আধুনিক মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তির মেডিক্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজম্যান্ট সালিউশন নেই। দেশের কয়েকটি হাসপাতালে ইনসিনারেটর মেশিনের মাধ্যমে মেডিক্যাল বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো এখন অচল হয়ে আছে। এ অবস্থা থেকে বোঝা যায়, দেশে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কতটা নাজুক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাসহ সব ধরনের সংক্রামক মেডিক্যাল বর্জ্য পরিশোধনে আধুনিক মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকর। এই মেশিনে বর্জ্যগুলো প্রথমে গুঁড়ো করা হয়। তারপর উচ্চ তাপে পুড়িয়ে শোধিত করে বালুর মতো করা হয়। এই বালু পুনরায় ব্যবহার করে কাগজ বা টিস্যু পেপার তৈরি করা যায়। এ ধরনের একটি শোধনাগার তৈরি করতে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা লাগে। তবে খরচ কমাতে প্রতি হাসপাতালে স্থাপন না করে জোনভিত্তিক করা হলেও মেডিক্যাল বর্জ্য শোধন করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের শোধনাগার স্থাপন এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে কোনো মেডিক্যালবর্জ্যের চেয়ে করোনাবর্জ্য একশ’ গুণ বেশি সংক্রমণ মতাসম্পন্ন। তাই এ বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা এবং সঠিকভাবে পরিশোধনের ব্যবস্থা না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এমনিতেই করোনায় দেশের মানুষ নাজেহাল হয়ে পড়েছে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় মেডিক্যালবর্জ্য সংক্রমণের নতুন মাধ্যম হয়ে পড়লে তা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বিজ্ঞাপন বা গণবিজ্ঞপ্তি দিলেও করোনাবর্জ্যের কি হবে এবং কিভাবে কোথায় তা ফেলতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি। ফলে এসব বর্জ্য মানুষ যেখানে সেখানে ফেলছে। এ প্রেেিত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপকে এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক পদপে নিতে হবে। মানুষ যাতে যত্রতত্র এসব বর্জ্য না ফেলে এবং তা কীভাবে সংরণ ও ফেলতে হবে, এমন পরামর্শ দিয়ে পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সতর্ক করতে হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনকে এসব বর্জ্য যথাযথভাবে সংগ্রহ করে ধ্বংস করে দিতে হবে। এক বিপদ সামাল দিতে গিয়ে আরেক বিপদ সৃষ্টি করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।