রিয়ার ব্যবহারে অখুশি ছিলেন সুশান্ত, মিস করতেন অঙ্কিতাকে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ প্রেম কখনও মধুর, কখনও সে বেদনা বিধুর— বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত জীবনে চিরায়ত এই সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন। টিভি সিরিয়াল ‘পবিত্র রিশতা’র সহশিল্পী অঙ্কিতা লোখান্ডের সঙ্গে ছয় বছরের প্রেম ভুলতে পারেননি। নতুন প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তীর ব্যবহারে খুশি ছিলেন না। পেশাদার জগতের টানাপোড়েন তো ছিলই। সব মিলিয়ে হতাশার বৃত্তে আটকে পড়েন।
প্রাণবন্ত ও হাসিখুশি ছেলেটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলো কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মুম্বাই পুলিশ। নাকি এর পেছনে আছে পেশাদার বিদ্বেষের কারসাজি। সবকিছু নিয়ে চলছে তদন্ত। ইতোমধ্যে তার মানসিক অবসাদ ও সম্পর্কের জটিলতাসহ বেশকিছু তথ্য জানা গেছে। হিন্দি পত্রিকা নবভারত টাইমসের তথ্যানুযায়ী, সুশান্তের নারী মনোরোগ চিকিৎসক কেসারি চাবডাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা জানিয়েছেন। হতাশায় ডুবে থাকার কারণে রাতে ঘুমাতে পারতেন না সুশান্ত। অদ্ভুত সব চিন্তা করতেন তিনি। নিজের মনটা দ্বিমেরু লাগতো তার। অঙ্কিতা লোখান্ডের সঙ্গে ছয় বছর একছাদের নিচে থাকার পর সুশান্তের ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর বেশ কয়েকটি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, অঙ্কিতার মতো করে কেউ ভালোবাসেনি তাকে। মনোরোগ চিকিৎসক নিশ্চিত করেন, ‘রাবতা’র নায়িকা কৃতি স্যানন ও একজন পরিচালকের মেয়ের সঙ্গে সুশান্তের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কারও সঙ্গে শেষ পর্যন্ত প্রেম টেকেনি তার। তাছাড়া সবশেষ প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তীর ব্যবহারে অসন্তুষ্ট ছিলেন তিনি।
এদিকে বান্দ্রা থানায় পুলিশের জেরায় বলিউড অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তী জানান, সুশান্তকে যন্ত্রণা আঁকড়ে ধরেছিল। বিষণ্নতায় ভোগার কারণে চিকিৎসা চলছিল তার। কিন্তু ওষুধ সেবনের পরিবর্তে যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন করে আরোগ্য পেতে চেয়েছিলেন তিনি। রিয়া স্বীকার করেন, সুশান্তের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। লকডাউনে তারা একই অ্যাপার্টমেন্টে ছিলেন। নভেম্বরে বিয়ের পরিকল্পনা ছিল দু’জনের। কিন্তু কয়েকদিন আগে তাদের মধ্যে ঝগড়া ও ছাড়াছাড়ি হয়। সুশান্তের আকস্মিক প্রস্থানের কারণ অনুসন্ধান করতে আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তার বাবা কেকে সিং, বোন মিতু, শেষ ছবি ‘দিল বেচারা’র পরিচালক মুকেশ ছাবরা, বিজনেস ম্যানেজার শ্রুতি মোদি ও রাধিকা নিহাল।
২০১৯ সালের জুলাই থেকে এ বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুশান্তের পক্ষে কাজ করেছেন শ্রুতি মোদি। ‘ছিচ্চোরে’র প্রচারণার সময় তিনি ছিলেন। তার তথ্যানুযায়ী, সুশান্ত ছিলেন বেশ কৌতূহলী মানুষ। অন্যরকম সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেন। মহাশূন্য, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কোডিং এসব নিয়ে আগ্রহ ছিল। প্রযুক্তির প্রতি অনুরাগ থেকে নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য তাই পোশাকের ব্র্যান্ড আনার পরিবর্তে এসব বিষয়ের উদ্যোক্তা হয়েছিলেন। নিজের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন।
২০১৮ সালের মে মাসে চালু হয় সুশান্তের ‘ইনসাই ভেঞ্চারস’। ইনসাই হলো আইসল্যান্ডিক শব্দ। এর অর্থ স্বজ্ঞা, অর্থাৎ যেকোনও কিছু তাৎক্ষণিক বোঝার ক্ষমতা। উদ্দীপিত বাস্তবতা, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছিল প্রতিষ্ঠানটি।সুশান্তের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান ‘ভিভিড্রজ রিয়ালিটিক্স’-এর নামের ‘রিয়া’ বানানটি প্রেমিকা রিয়ার নিজের নাম যেভাবে লেখেন সেভাবে দেওয়া। তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। এর পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য রিয়ার ভাই শোয়িক চক্রবর্তী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মিক্সড রিয়েলিটি, নিরীক্ষামূলক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে এটি।
পরিবেশ ও সমাজের কল্যাণে কাজ করতে চেয়েছেন সুশান্ত। তাই এ বছরের জানুয়ারিতে সমাজসেবা সংগঠন চালু করেছিলেন। এর নাম ‘ফ্রন্ট ইন্ডিয়া ফর ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন’। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টি নির্মূলের সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটেশন নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে এই সংস্থা। সাবেক ম্যানেজার শ্রুতি মোদি জানান, ভার্চুয়াল গেমস তৈরির জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সুশান্ত। এছাড়া ‘জিনিয়াসেস অ্যান্ড ড্রপ আউটস’ নামের একটি সামাজিক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। রুমি জাফরির পরিচালনায় একটি ছবিতে রিয়ার সঙ্গে জুটি বাঁধার কথা ছিল সুশান্তের। রুমি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, অভিনয় ছেড়ে কৃষক হতে চেয়েছিলেন সুশান্ত! তার ইচ্ছে ছিল সারাভারতে বৃক্ষরোপণ করা। কখনও তিনি বলতেন বিজ্ঞানী হবেন। কখনোবা লোনাভালা খামারবাড়িতে গিয়ে একা থাকতেন। রুমি জাফরিকে মানসিক অবসাদে ভোগার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি বিহারের পাটনায় জন্মেছিলেন সুশান্ত সিং রাজপুত। পড়াশোনায় ছিলেন মেধাবী। ভারতের জাতীয় পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে বিজয়ী হয়েছিলেন। মহাকাশ, পদার্থ ও নক্ষত্র নিয়ে তুমুল আগ্রহ ছিল। রাতের বেলা নিজের কেনা দামি টেলিস্কোপে চোখ রেখে দূর আকাশে তারা দেখতে ভালোবাসতেন। মোটরসাইকেলের প্রতি ছিল আলাদা ভালোলাগা। তাই দিল্লির কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন করে পাওয়া টাকা জমিয়ে ২০০৬ সালে প্রথম মোটরসাইকেল কিনেছিলেন।
একই বছর (২০০৬ সালে) মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠানে ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন ও সাইফ আলি খানের ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার ছিলেন সুশান্ত। নৃত্য পরিচালক শৈমাক দাভারের নৃত্যদলে থাকায় এই সুযোগ হয়েছিল। তার শেষ ছবি ‘দিল বেচারা’য় অতিথি চরিত্রে দেখা যাবে ছোট নবাবকে। গত ১৪ জুন মুম্বাইয়ে বান্দ্রার কার্টার রোডে নিজের ফ্ল্যাটে সুশান্ত সিং রাজপুতের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিছানার চাদর গলায় প্যাঁচিয়ে ঝুলে থাকায় অ্যাসপিক্সিয়ার (অক্সিজেনের ঘাটতিতে দম বন্ধ হওয়া) কারণে মারা গেছেন তিনি। তার ঘরে পাওয়া গেছে প্রেসক্রিপশন ও অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ। তবে কোনও সুইসাইড নোট মেলেনি। গত ১৫ জুন মুম্বাইয়ে ভিলে পার্লের পবন হংস মহাশ্মশানে সুশান্তের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। ১৮ জুন দুপুরে সেখানেই তার দেহভস্ম ভাসানো হলো গঙ্গায়। ছেলের অস্থি নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন বাবা কেকে সিং। সুশান্তের শেষ ছবি ‘ছিচ্চোরে’ (২০১৯) দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে। মাত্র ৩৪ বছরের জীবনে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন তিনি। কঠোর পরিশ্রমে পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছেন। তিল তিল করে বলিউডে অবস্থান গড়েছেন। হঠাৎ স্বেচ্ছায় মৃত্যুর দুয়ার খুলে চলে গেলেন অনন্তযাত্রায়। ভারতে এখনও তার মৃত্যুর শোক চলছে। সবার একটাই কথা, ছেলেটা সত্যি খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো।
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, বলিউড হাঙ্গামা