যবিপ্রবি ও খুমেক ল্যাবের ফলাফলে আকাশ-পাতাল ফারাক

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ খুলনা মেডিকেল কলেজ ল্যাব থেকে গতকাল ৮০টি নমুনার ফলাফল যশোরে পাঠানো হয়েছে; যার সবগুলোই নেগেটিভ। এর অর্থ হলো, যাদের নমুনা পাঠানো হয়েছিল, তারা কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি। এর আগে রোববার যশোরে কোনো ফলাফল পাঠানো হয়নি। শনিবার দুইদিনের মোট ৭২টি নমুনার ফল পাঠানো হয়েছিল; সেগুলোও সবই ছিল নেগেটিভ।
খুলনা থেকে নমুনা পরীার ফল একের পর এক নেগেটিভ আসছে, অথচ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারে পরীা করা নমুনার উল্লেখযোগ্য অংশ পজেটিভ আসছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরীার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন যশোরের সিভিল সার্জনও। বলেছেন, এই তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপকে জানানো হয়েছে। এদিকে গতকাল ঢাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে করোনায় খুলনা বিভাগে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ যশোরকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ অবস্থায় যশোরে করোনাভাইরাসের পরীা নিয়ে এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের মাঝে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এযাবৎ যবিপ্রবি ল্যাব থেকে পাঠানো রিপোর্টে যশোরের ৫৫ ব্যক্তিকে করোনাভাইরাস সংক্রমিত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিপরীতে খুমেক ল্যাবে পাঠানো নমুনার মধ্যে মাত্র দুটি পজেটিভ বলে রিপোর্ট আসে। দুই পরীাগারের ফলাফল এককথায় আকাশ-পাতাল। যশোর সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ (নভেল করোনাভাইরাস) রোগীদের ৮০টি নমুনা পাঠানো হয়েছিল গত ৩০ এপ্রিল। এগুলোর ফল গতকাল সোমবার চারদিনের মাথায় যশোর এসেছে। ফলাফল সবই নেগেটিভ। খুলনার ল্যাবে এখনো যশোরের ৪০টি নমুনা রয়েছে; যেগুলোর ফলাফল আসেনি। কবে নাগাদ এই ফলাফল এসে পৌঁছাবে, তা নিশ্চিত নয় যশোরের স্বাস্থ্য বিভাগ।
যশোরের সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রথম পাঠানো শুরু হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবে। পরে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারে পরীার কাজ শুরু হলে এখানে নমুনা পাঠানো হয় একনাগাড়ে ১৪ দিন। পরে জীবাণুমুক্ত করতে যবিপ্রবি ল্যাব চারদিন বন্ধ রাখার হয়। এই সময়কালে যশোরের নমুনাগুলো ফের খুলনায় পাঠানো হচ্ছিল। গতকাল অবশ্য যবিপ্রবি ল্যাবে নমুনা পরীার কাজ শুরু হয়েছে, যেখানে ইতিমধ্যে যশোরের ৪০টি নমুনা পাঠানোও হয়েছে। দুই ল্যাবে এই পর্যন্ত যশোরের মোট ৯৬৪টি নমুনা পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে মোট ৭০৯টি নমুনা পরীা করে প্রতিবেদন প্রদান করা হয়েছে। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, যবিপ্রবি ল্যাব থেকে মোট ৫৫ জনকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর খুলনা ল্যারের পরীায় করোনা পজেটিভ হয়েছেন মাত্র দুইজন। দুই ল্যাবের পরীার আকাশ-পাতাল পার্থক্য কী করে হয়, তা এক বিরাট রহস্য। এই প্রশ্নের জবাব সরাসরি কেউ গণমাধ্যমকে দিতেও চাইছেন না। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দেশের বিশিষ্ট অণুজীববিজ্ঞানী এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের ল্যাবে নমুনা পরীার কাজ করেন অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের শিকরা। এই ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। অন্য কোন ল্যাবে কীভাবে কাজ করা হচ্ছে, তা আমার জানা নেই।’
যবিপ্রবি অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারে নমুনা পরীার কাজের প্রথম টিমের লিডার প্রফেসর ড. ইকবাল কবীর জাহিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। তিনি বলেন, এই ল্যাবের পরীার মান খুবই উন্নত। একই ধরনের জবাব দেন যবিপ্রবি জেনোম সেন্টারের অন্তরবর্তীকালীন সময়ের টিম লিডার ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সেলিনা আক্তারও। তিনি বলেন, নমুনা পরীার ফল পজেটিভ নাকি নেগেটিভ আসবে, তার পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। এর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো, নমুনা কীভাবে পরিবহন করা হচ্ছে, কীভাবে সংরণ করা হচ্ছে, কত সময় পর তা পরীা করা হচ্ছে প্রভৃতি। গতকাল বিকেলে যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীনকে প্রশ্ন করা হয় দুই ল্যাবের পরীার ফলাফল আকাশ-পাতাল কেন হচ্ছে? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ওই বিষয়ে এক্সপার্ট নই। তাই ফলাফল স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক, সে সম্বন্ধে মন্তব্য করতে পারবো না। তবে দুই ল্যাবের ফলাফলের বিরাট পার্থক্য যে হচ্ছে, তা যেকোনো লেম্যানও বুঝবেন।’ ‘বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপকে জানানো হয়েছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত তারাই নেবেন,’ বলছিলেন সিভিল সার্জন। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ডা. শাহীন বলেন, ‘যারা পরীার কাজে নিযুক্ত, তাদের দতা-যোগ্যতা তো অবশ্যই ফ্যাক্টর। আর কোন ল্যাবে কী পদ্ধতিতে নমুনা সংরণ করা হচ্ছে, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন।’
এদিকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব পরিচ্ছন্ন ও জীবানুমুক্ত করার পর সোমবার থেকে ফের করোনা পরীক্ষা শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা শুরুর দিনে যশোরসহ ৫ টি জেলার ৯১ টি নমুনা সরবরাহ করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন অফিসের পক্ষ থেকে এসব নমুনা পৌছে দেয়া হয়। নমুনাগুলো রাতেই প্রসেসিং করে পিসিআর মেশিনে তুলে দেয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ল্যাব পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করার কাজ শেষ করে কয়েক দফা টেস্ট রান করা হয়েছে। টেস্ট রান সফল হওয়ার পর সোমবার থেকে আবার করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা গ্রহণ ও পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার যথারীতি পরীক্ষার ফলাফ পাওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারের সহকারী পরিচালক প্রফেসর ড. মো. ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, দ্বিতীয় দফা পরীক্ষার শুরুর প্রথম দিন যবিপ্রবি ল্যাবে যশোরসহ ৫ টি জেলার ৯৯ টি নমুনা এসে পৌঁচেছে। সোমবার বিকেলে এসব নমুনা পাওয়ার পর পরীক্ষার জন্য এক্সপার্টরা কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ৯৯ টি নমুনার মধ্যে যশোরের ৪১ টি, ঝিনাইদহের ১৫ টি, কুস্টিয়ার ৬ টি, মেহেরপুরের ২১ টি ও চুয়াডাঙ্গার ৮ টি নমুনা রয়েছে। তিনি বলেন, এসব নমুনা রাতেই পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করেন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে, সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. রেহেনেওয়াজ জানিয়েছেন, গেল ২৪ ঘণ্টায় যশোর জেলায় মোট ৬১ জনকে কোয়ারেন্টাইনে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জনকে হোম এবং ৪৯ জনকে ঝিকরগাছা উপজেলার গাজীর দর্গা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আনা হয়েছে। এ ছাড়া গত ৫৪ দিনে জেলায় মোট পাঁচ হাজার ৩২৫ জনকে কোয়ারেন্টাইনে আনা হয়। এর মধ্যে চার হাজার ২৯৬ জনকে ছাড়া হয়েছে। বর্তমানে জেলায় এক হাজার ২৯ জন হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন।