‘যাদের থাকার জায়গা নেই, তাদের আইসোলেশনের ঘরটা কোথায়’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ গত পাঁচ বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন সায়মা আক্তার । ৩৫ বছর বয়সী এই নারীর অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি শেষে সায়মা এখন কিছুটা সুস্থ। দুই সন্তানকে নিয়ে আরেকটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেটে মালিবাগ বাজার রোডের এক বাসাতে থাকেন। গত কয়েকদিন আগে সায়মার জ্বর হওয়াতে তিনি কোভিড টেস্ট করালে তার পজিটিভ আসে। রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলেও তাকে সেখানে ভর্তি নেওয়া হয়নি, ওষুধ দিয়ে বাসায় তাকে আইসোলেশনে থাকতে বলেছেন চিকিৎসকরা।
সায়মার বাবা আব্দুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আইসোলেশনে থাকার কথা বলে তো হাসপাতাল তার দায়িত্ব শেষ করলো কিন্তু মেয়েটা আইসোলেশনে কোথায় থাকবে সে চিন্তা কে করবে? ওরা থাকে দুই রুমের সাবলেটে। এদিকে, ওর সঙ্গে থাকা ছোট ছেলেকেও কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। তার প্রশ্ন, এখন মা আইসোলেশনে কোথায় থাকবে আর ছেলেইবা কোয়ারেন্টিনে কোনখানে থাকবে? আব্দুর রহমান বলেন, প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যারা পজিটিভ তারা বাসায় আইসোলেশনে থাকবেন আর যারা আক্রান্তদের সঙ্গে ছিলেন তারা থাকবেন কোয়ারেন্টিনে। কিন্তু আমার মেয়েটার মতো যারা কষ্ট করে এক বা দুই রুমে থাকেন তাদের জন্য সরকারের ব্যবস্থা কী-সেটা তো কাউকে বলতে শুনলাম না। যশোর জেনারেল হাসপাতালের প্রাতিষ্ঠানিক করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড। কিন্তু, লক্ষণ মৃদু হলে এমন প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি করা হয় না। ফলে রোগী বিপদে পড়ে যান কোথায় থাকবেন তা নিয়ে। গত ২১ এপ্রিল করোনা পজিটিভ হওয়ার পরও মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি নেয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন স্বপন মিয়া। তাকেও মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে ওষুধ দিয়ে বাসায় আইসোলেশনে থাকার কথা বলা হয়। স্বপন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুই কক্ষের বাসাতে দুই সন্তান আর বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে থাকেন তিনি। এখন কোথায় পাবেন তিনি আইসোলেশনে থাকার জায়গা? রাজধানীর মালিবাগের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত এক নার্স কোভিড-১৯ পজিটিভ হন গত সপ্তাহে। একটি হোস্টেলে থাকতেন তিনি, কিন্তু কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর হোস্টেলে আর থাকা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। বাড়ি ঢাকার বাইরে, হাসপাতালেও রাখবে না-জানিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এরপর শুরু হয় তার অন্যরকম যুদ্ধ। নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, এত বড় ঢাকা শহরে কোথাও থাকার জায়গা নেই সেদিন এটা বুঝলাম, যেদিন জানলাম আমি কোভিড পজিটিভ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লক্ষণ উপসর্গ গুরুতর না হলে করোনা আক্রান্ত রোগীকে হোম আইসোলেশনে রাখার কথা গাইডলাইনে বলা হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষ, হোস্টেলে থাকা মানুষদের জন্য গাইডলাইনের এ কথা বাংলাদেশের মতো দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা বাস্তবসম্মত সেটা আমলে নেওয়ার দরকার ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, কোভিড-১৯ রোগীদের শতকরা ৮০ শতাংশের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তারা বাসায় থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চিকিৎসা নিলে সুস্থ হয়ে যায়। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য হোম এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে শুরু থেকেই জানিয়ে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা কিডনি রোগ, ক্যান্সার, হৃদরোগ, যক্ষ্মা, লিভারের সমস্যা রয়েছে তারা যদি কোভিডে আক্রান্ত হন এবং তাদের বয়স যদি ৩০ বছরের নিচেও হয় তাহলে সেটা আমাদের জন্য অ্যালার্মিং। তাই এসব মানুষদের জন্য হোম কোয়ারেন্টিন বন্ধ করে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করার মতো সুযোগ বাড়ানো হোক, নয়তো হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ, বৃদ্ধ এবং শিশুদের যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের জন্য এটা ভয়াবহ হবে। তারা বলছেন, যদি আমরা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে চাই, চীনের উহান বা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মতো অবস্থা এড়াতে হলে শিল্প এলাকা, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অনতিবিলম্বে নজর দেওয়া উচিত, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা উচিত, স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রশাসনকে অতিদ্রুত কাজে লাগানো উচিত এবং সমন্বিত অর্থাৎ ঘরে ঘরে গিয়ে ইনটেনসিভ হেলথ সার্ভিসের ব্যবস্থা করা উচিত যত দ্রুত সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদফতর শুরু থেকেই হোম এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থার কথা জানিয়ে এসেছে, ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ান্টিনের সংখ্যা বেড়েছে বলেও জানায় প্রতিষ্ঠানটি। ‘নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার মতো অবস্থা নেই এবং এটা খুবই প্রাকটিক্যাল কথা’ মন্তব্য করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এসব মানুষের তো আলাদা রান্নাঘরই নেই, একইঘরে তারা থাকে এবং গ্যাসের চুলায় রান্না করে। তারা তো ঘরের ভেতরেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো অবস্থাতে নেই, তারা হোম কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন কীভাবে করবে। তিনি বলেন, স্বল্প আয়ের, অনিশ্চিত আয়ের মানুষ, যারা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে থাকেন তাদের জন্য অবিলম্বে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা দরকার। নয়তো ঘরে ঘরে এই করোনা ছড়িয়ে যেতে একটুও সময় লাগবে না। যাদের লক্ষণ মৃদু তাদের হাসপাতালে না রাখার জন্য আমরা বলছি, কিন্তু তারা যাবেন কোথায় একই প্রশ্ন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরও। মুশতাক হোসেন স্পষ্ট করে বলেন, ‘তাদের জন্য ঘরটা কই? তাই অবিলম্বে কোনও প্রতিষ্ঠান রিকুইজিশন করে তাদের জন্য জরুরিভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ করোনা ইস্যুতে সামগ্রিকভাবে কী কী ঘটতে পারে, শুরুতে সে বিষয়টা ভাবা হয়নি মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশে কোন কোন ধরনের মানুষ রয়েছে, তাদেরকে কীভাবে পুরো স্বাস্থ্যসেবাতে আনা হবে সেটা যদি আগে ভাবা হতো, পরিকল্পনা নেওয়া হতো তাহলে আজ এটা হতো না।
করোনার জন্য হাসপাতালগুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, বস্তি এলাকাতে যখন রোগী বাড়বে তখন কী হবে সে সামগ্রিক পরিকল্পনা ব্যবস্থাতে ঘাটতি রয়েছে বলেও মন্তব্য তার। এর সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, এ ধরনের বাসাতে যারা থাকবেন তারা চাদর জাতীয় কিছু দিয়ে কর্নার বানিয়ে তাতে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও এতে শতভাগ শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত হবে না, তবে ৯০ শতাংশ তো হবে। বাসায় থাকলেও এমন আক্রান্ত বা তার স্বজনদের সব সময় মাস্ক পরে থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, যখন কেউ তাকে খাবার দেবেন তখন দুজনকেই মাস্ক পরতে হবে, থালা-বাসন আলাদা করতে হবে আর একই বাথরুম ব্যবহার করা হলে বাথরুমকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তি ব্যবহারের পর।
একইসঙ্গে ঢাকাসহ পুরো দেশের হাসপাতালগুলোও এক্ষেত্রে কাজে লাগানোর কথা বলে তিনি জানান, প্রতিটি হাসপাতালের একটি করে ইউনিট বা ফ্লোর ছেড়ে দিয়ে সেখানে যেন সংক্রমণ না ছড়িয়ে যায় কেবল সে ব্যবস্থাটুকু করতে হবে, বলেন ডা. বে-নজির আহমেদ। ‘দেশের নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের আইসোলেশনে থাকার মতো পৃথক ঘর নেই এবং সে ব্যবস্থা নেই-এটা সঠিক’ মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত সচিব ও করোনা বিষয়ক মিডিয়া সেলের প্রধান হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তবে সরকার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা করছে। তাদের জন্য ব্যবস্থা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের থাকার ব্যবস্থা আলাদা করে করা সম্ভব না’। তাহলে নিম্নবিত্ত, ক্যান্সারাক্রান্ত সায়মা আক্তারের মতো সাবলেটে থাকা মানুষেরা কোথায় যাবে প্রশ্ন করলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এর উত্তর দেওয়া আসলেই কঠিন, তবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করে হয়তো কিছুটা লেভেল পর্যন্ত ঠিক করা যেতে পারে।’ ঢাকা শহরে এত ভবন আছে, এর মধ্যে থেকে আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসোলেশন এবং তার সংস্পর্শে আসাদের জন্য কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা কেন যাবে না প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা করতে পারলে খুব ভালো হয়’, কিন্তু, এটাতো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সম্ভব না। তবে সেনাবাহিনী কোয়ারেন্টিনে আমাদের সাহায্য করছে।