প্লাজমা থেরাপি দ্রুতায়িত করতে হবে

0

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের চিকিৎসার কোনো প্রস্তুতি বিশ্বের কোনো দেশেরই ছিল না। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এটি একটি নতুন প্রজাতির ভাইরাস হওয়ায় এর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ডাক্তাররা। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রস্তুতে আরো অন্তত এক থেকে দেড়বছর সময় লাগতে পারে বলে ভায়রোলজিস্টরা জানাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দেড় লক্ষাধিক মানুষ এই ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি আমাদের দেশেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সাধারণ ছুটি, লকডাউনসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয়ার পরও অব্যাহতভাবে বেড়ে চলা ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর মিছিল থামিয়ে দিতে আমাদের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা দেখা দিয়েছে। এহেন বাস্তবতায় করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য পরীক্ষিত ও অব্যর্থ চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে প্লাজমা থেরাপি এই মুহূর্তের একমাত্র নির্ভরযোগ্য অবলম্বন হিসেবে আশার সঞ্চার করছে। এটি একটি সুপ্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। করোনাভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন বা পরীক্ষিত ওষুধ না থাকায় প্রাণঘাতী সংক্রমণ থেকে করোনা রোগীদের সারিয়ে তুলতে প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করে চীন ও জাপান সুফল পেয়েছে বলে জানা যায়। বর্তমানে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্লাজমা থেরাপি দিয়ে করোনা চিকিৎসায় অগ্রগতি হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্তের এন্টিবডি ব্যবহার করে এই থেরাপি দেয়া হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করা প্লাজমা থেরাপির প্রস্তুতি গ্রহণের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে সাধারণ রক্তদানের উপযোগী যে কোনো সুস্থ ব্যক্তি রক্তদান করে করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
প্রায় দেড়মাস আগে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এরপর প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সেই সাথে প্রতিদিনই কিছু মানুষ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ায় বাড়ি ফেরা মানুষের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। তাছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা ছাড়াও কিছু মানুষ করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। তাদের শরীরেও করোনাভাইরাসের এন্টিবডি তৈরি হয়েছে। রক্তের প্লাজমা থেকে এন্ডিবডি সংগ্রহ করে করোনাভাইরাস রোগীদের সারিয়ে তোলার এই পদ্ধতি কাজে লাগানোর উদ্যোগ শুরু থেকেই গ্রহণ করা উচিৎ ছিল। তরুণ চিকিৎসকের একটি গ্রুপ প্লাজমা থেরাপির উদ্যোগ গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার পর অবশেষে এ সংক্রান্ত একটি উচ্চতর বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছে বলে গতকাল ইনকিলাবের প্রতিবেদনে জানা যায়। চার সদস্যের কমিটিকে পরীক্ষামূলকভাবে সিরাম প্রয়োগের জন্য প্রটোকল প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। চীন, জাপান, ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর এখন ভারত রক্তের এন্টিবডি কাজে লাগিয়ে প্লাজমা থেরাপিকে করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য একমাত্র গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করছে। ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রস্তুত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সুলভ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন নির্ভরযোগ্য থেরাপিকে কাজে লাগানোর দ্রæত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
রক্তের এন্টিবডি ব্যবহারের মাধ্যমে মহামারী থেকে রক্ষা পেতে প্লাজমা থেরাপি শত বছর ধরে একটি অব্যর্থ পদ্ধতি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সাম্প্রতিক দশকে সার্স, মার্স, ইবোলা থেকে বর্তমান কোভিড-১৯ পর্যন্ত এই থেরাপি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এই পদ্ধতির জন্য কোনো বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভর করতে হয় না। চলমান বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে উন্নত বিশ্বের ধনী দেশগুলো যখন নিরুপায় হয়ে পড়েছে তখন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সম্ভাব্য সবকিছুই বাংলাদেশে আছে। করোনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য ওষুধ হিসেবে হাইড্রোক্সিক্লোরিকুইন ও এজিথ্রোমাইসিন উৎপাদন ও বিদেশে রফতানি করে আসছে বাংলাদেশ। দেশীয় বেসরকারি সংস্থা গণস্বাস্থ্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন হাজার হাজার কিট তৈরি ও সরবরাহের লক্ষ্যে কাজ করছে। দেশেই তৈরি হচ্ছে মানসম্মত মাস্ক, পিপিই। এমনকি দেশীয় উদ্যোক্তারা নিজস্ব প্রযুক্তিতে ভেন্টিলেটর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরের প্রণোদনা ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। ক্রমবর্ধমান করোনাভাইরাস রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনতে প্লাজমা থেরাপিকে কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা বা সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে বিভিন্ন দেশের গবেষকরা কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গবেষকদেরও নিজস্ব প্রকল্প নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। তবে এই মুহূর্তে প্লাজমা সিরাম উৎপাদনের কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এই প্রকল্পের ব্যবহারিক সাফল্য নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট রক্তদাতা তথা সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ও সমন্বয় নিশ্চিত করা জরুরি। প্লাজমা থেরাপিসহ করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ও সংক্রমণ প্রতিরোধী শিল্প-সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরবরাহ দ্রুতায়িত ও সহজলভ্য করতে সর্বোচ্চ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।