পোশাক শ্রমিকদের আরো ৬ মাস বেতন নিশ্চিতে সমন্বিত উদ্যোগ চায় সিপিডি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে দেশে লকডাউন থাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা তাদের জীবন জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে তারা যেন আগামী মাসের বেতনগুলো ঠিকমতো পান তা নিশ্চিত কতে হবে। পাশাপাশি মহামারির চলমান পরিস্থিতিতে আরো ৬ মাস তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বৃহস্পতিবার সিপিডি আয়োজিত রানা প্লাজা ধসের সপ্তম বার্ষিকীতে ‘কোভিড-১৯: সংকটের মুখে শ্রমিক ও মালিক – সরকারি উদ্যোগ ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এ পরামর্শ উঠে আসে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
মূল প্রবন্ধে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মহামারির এমন পরিস্থিতিতে তারা যেন আগামী মাসের বেতনগুলো ঠিকমতো পান তা নিশ্চিত কতে হবে। তাদের ভেতরে চাকরি এক ধরনের অনিশ্চয়তা ঢুকে গেছে। এই অনিশ্চয়তা দূর করতে ব্র্যান্ড বায়ার, উদ্যোক্তা এবং সরকারকে দেখা দরকার। ব্র্যান্ড ক্রেতা, উদ্যোক্তা ও সরকার যেন উদ্যোগ নেন যাতে আগামী ৬ মাস পর্যন্ত সময়ে শ্রমিকদের পর্যাপ্ত পরিমাণ আয় থাকে, যা নিয়ে তারা ন্যূনতম জীবন কাটাতে পারেন। শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় সরকারের ১০ টাকা কেজি চালের রেশনিং ব্যবস্থায়ও শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করারও আহ্বান জানান তিনি। এ পর্যন্ত বাতিল হওয়া ৩৬০ কোটি ডলারের মতো ক্রয়াদেশের তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব অর্ডারের বিপরীতে কাঁচামালের খরচ ও শ্রমিকদের মজুরিসহ বেশ কিছু জটিলতায় পড়েছেন উদ্যোক্তারা। আর যেন অর্ডার বাতিল না করা হয়। তবে নতুন করে আরো ১০০ কোটি ডলারের নতুন ক্রয়াদেশ এসেছে বলে বিজিএমইএর হিসাব তুলে ধরেন মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, সম্প্রতি ইউরোপের বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড বায়ার একটি যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, যে যেসব অর্ডার এখনো রয়েছে এবং আগামীতে যেসব ক্রয়াদেশ আসবে তা সরবরাহের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কীভাবে সংক্রমণ ঠেকিয়ে উৎপাদন করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে তারা (বায়াররা) শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে আনা-নেয়ার ব্যবস্থা করা ও সংক্রমণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ২০০৮-০৯ সালের মন্দার পরে আমরা পোশাক রপ্তানিতে বেশ ভাল প্রবৃদ্ধি করেছিলাম। কারণ যে কোনও মন্দার পরে মানুষ কম দামের পণ্য কিনে থাকে। আর বাংলাদেশ বিশেষ করে কম দামের পোশাকই যেহেতু তৈরি করে তাই এই মন্দা শেষ হলে আমরা আবারও বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির আশা করছি আমরা।
সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই শিল্প যদি আমাদের চালু রাখতে হয় তাহলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। কারণ এই মহামারি কতদিন ধরে থাকবে তা আমরা জানি না। করোনার কারণে ইউরোপের ব্যবসা চীন থেকে সরে বাংলাদেশ আসতে পারে কি-না- এ ধরনের এক প্রশ্নের উত্তরে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনা পরবর্তীতে বিশ্ব বাজারে কী পরিবর্তন হয়, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্টের সঙ্গে চীনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ইউরোপের অনেক দেশ করোনার জন্য চীনকে দায়ী করছে। কিন্তু ব্যবসার সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। অনুযোগ, অভিযোগের কারণে ব্যবসার সম্পর্কে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। যেখানে বেশি লাভ হবে, ব্যবসায়ীরা সেখানে যাবে। সুতরাং চীন থেকে সরে ব্যবসায়ীরা অন্য কোথাও যাবে বলে আমার মনে হয় না। কীভাবে আমরা এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারি, সেজন্য আমাদের উদ্যোক্তা, ক্রেতা ও সরকার- সবাই মিলে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা যাদের বেতন ন্যূনতম আট হাজার টাকা, তাদের জন্য অন্তত ৪ হাজার টাকা সরকারের তহবিল থেকে দেয়ার সুপারিশ করেছি, তখন শিল্প মালিকদেরও দায়ভার কিছুটা কমে। বিজিএমইএ সহ-সভাপতি আরশাদ জামাল দিপু বলেন, আমরা সকল কারখানাকে শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন দিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশনা পাঠিয়েছি। কিন্তু ছোট কারখানাগুলো হয়তা বেতন দিতে পারছে না।
এদিকে করোনা ভাইরাসের চলমান সংকট কেটে গেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন হতে পারে বলে মনে করছে সিপিডি। প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল তারপর আমরা দ্রুত ফিরে আসতে পেরেছিলাম। ২০১০ সালের জানুয়ারির পর দ্রুততার সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তৈরি পোশাক খাত-বহির্ভূত অন্যান্য খাতেরও প্রবৃদ্ধি বেড়েছে পরবর্তী মাসগুলোতে। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি, এই চ্যালেঞ্জ চলে গেলে বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করা গেলে এই খাতের একটা উল্লম্ফন দেখা যাবে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বৈশ্বিক ঝুঁকি চলে গেলে অল্প মূল্যের গার্মেন্টস পণ্য কেনার চাহিদা বাড়বে। যেহেতু অনেকের আয় কমে যাবে, ফলে নিম্নমূল্যের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হবে। যেগুলোর জন্য আমাদের দেশের চাহিদা তৈরি হবে। ফলে এটি আমাদের দেশের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে। গার্মেন্টস শ্রমিক নেতারা বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন এখনো পরিশোধ করা হয়নি। তাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যেও নিরাপত্তা নিচ্ছেন না মালিকরা। তাদের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞ্ইা আজকে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে আস্থাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তারা বেতন ও স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিন্ত না হওয়া পর্যন্ত গার্মেন্ট না খোলার পক্ষে মত দেন। তাদের বেতন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমির বলেন, সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরেও এখনও কিছু কারখানা চালু রয়েছে। অথচ তারা মাস্ক নয়, নিজেদের অর্ডারের পণ্য উৎপাদন করছেন। এসব কারখানা সকারের নির্দেশ অনুযায়ী বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়ে দ্রুত সব শ্রমিকের মার্চ মাসের বেতন পরিশোধের দাবি জানান। তিনি বলেন, আজকে এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখ। এই দুর্যোগ মুহুর্তেও প্রায় ১৫ শতাংশ শ্রমিক তাদের বেতন-ভাতা পাননি। এই হারটা আরো বেশিও হতে পারে। যারা এই দুর্যোগের সময় এখনো পর্যন্ত শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন দেয়নি, এরা কোন ধরনের মালিক? তাদের চিহ্নিত করা দরকার এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া উচিত। এই শ্রমিক নেতা বলেন, অনেক কারখানা লে অফের নোটিশ দিয়েছেন। যখন সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, তখন কোনো সেক্টর থেকে আইন অনুযায়ী লে অফ ঘোষণার সুযোগ থাকে না। যতদিন সাধারণ ছুটি থাকবে ততদিন গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিজিএমই যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের যথেষ্ট জনবল রয়েছে। যতদিন সরকারের সাধারণ ছুটি থাকবে ততদিন যাতে গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
আলোচনায় গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, করোনার সংকটকালে দেশের পোশাক খাতের শ্রমিকরা নতুন করে বিপাকে পড়েছেন। গার্মেন্ট মালিকরা বছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেন, অথচ শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেন না। দেশের ৫৫টি কারখানার ২৫ হাজার শ্রমিক এখনও বেতন পাননি। ‘করোনা ভাইরাসের সময় শ্রমিকদের নিয়ে তামাশা করা হয়েছে। তাদের গ্রাম থেকে ঢাকায় নেয়া হলো, আবার গ্রামে পাঠানো হলো। এতে করে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের হুমকি বেড়েছে। অনেক শ্রমিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন।’ শ্রমিকরা বারবার বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, উল্লেখ করে জলি তালুকদার বলেন, রানা প্লাজা ধসের ৭ বছর পার হলেও শ্রমিকদের অনেক দাবি পূরণ করা হয়নি। হত্যার বিচার হয়নি। অনেক শ্রমিক সঠিকভাবে ক্ষতিপূরণ পাননি। রানা প্লাজায় ট্রাজেডিতে শ্রমিকরা মূলত মালিকদের বাড়তি মুনাফার লোভের শিকার হয়েছেন। গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের এক মাসের বেতন দিতে পারেন না, এটা একটা দুঃখ। আমাদের একটাই দাবি, শ্রমিকদের মার্চ ও এপ্রিল মাসের বেতনসহ বোনাস দিতে হবে। এখনও ৩০ শতাংশ শ্রমিক বেতন পাননি।