শ্রীলংকার কাছ থেকে শেখার আছে অনেক

0
আমিরুল আলম খান
শ্রীলংকায় করোনায় মারা গেছে ৭ জন আর আক্রান্ত ৩৩০ জন। এ হিসেব গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত। ১৫ ফেব্রুয়ারি সেখানে প্রথম একজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়, প্রথম একজনের মৃত্যু ঘটে ১০ মার্চ। শ্রীলংকা ভারতীয় উপমহাদেশের নিকট প্রতিবেশী এবং সার্কভূক্ত একটি দেশ। ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যেও ঠিক দক্ষিণে ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র। আর্য কাহিনী রামায়ণে সেটা রাক্ষসপুরী। বিদেশাগত আর্যদের যুগাবতার দশরথপুত্র রামচন্দ্র। ভারত জয়ের পর তার পূর্বপুরুষেরা ভূমিপুত্র দ্রাবিড়দের বিতাড়িত করে দক্ষিণে আরব সাগরতীরে ঠেলে দিয়েছিল। তারদেরই যে অংশটি বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে রাজ্য গড়ে সুখে শান্তিতে বাস করত তারাই লংকার বাসিন্দা। প্রজাবৎসল রাজা রাবণ বাল্মিকী রচিত মহাকাব্য রামায়ণে রাক্ষস। তার দশ মাথা। আসলে সেটা তার বীরত্বের প্রতীক। যেমন মা দূর্গা দশভুজা। কিন্তু সে কাহিনী এখানে নয়।
করোনা নিয়ে শ্রীলংকার শংকার কারণ অনেক। দেশটি প্রধানত পর্যটন অর্থনীতির। সারা দুনিয়ার মানুষ আসে এই স্বর্গতুল্য সৌন্দর্যম-িত দ্বীপে। দেশটিতে প্রচুর সংখ্যক বিদেশিদের সাথে কাজে ও বেড়াতে আসে প্রচুর চীনা নাগরিক। বর্তমান শ্রীলংকার উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অংশিদার চীন। তাই করোনা সংক্রমণের আশংকা ছিল প্রথম থেকেই। শ্রীলংকার আয়তন ৬৫ হাজার ৬১০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ২ কোটি ১৭ লাখ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনঘনত্ব ৩২৭ জন। শিক্ষিতের হার ২০১৫ সালের হিসেবে ৯৬ দশমিক ৩ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। মাথাপিছু গড় আয় ৩,৯৪৭ (পিপিপি হিসেবে ১৩,৮৯৭) মার্কিন ডলার। মানব উন্নয়ন সূচকে শ্রীলংকার অবস্থান বিশে^ ৭১তম। ২৭ ভাগ কৃষিজীবি। বেকারত্ব ২০১৭ সালের হিসেবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এই হার সার্কভূক্ত যে কোন দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির রপ্তানি ২৪% আর আমদানি ভারত থেকে ২২%, চীন থেকে ১৯%। শ্রীলংকার বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; কিন্তু বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর কারণ তামিল টাইগারদের সাথে জুলাই ১৯৮৩ থেকে মে ২০০৯ পর্যন্ত এক সর্বনাশা দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল দেশটি।
শ্রীলংকার প্রায় ৭৫ ভাগ সিংহলী, ১১ ভাগ শ্রীলংকান তামিল, ৯ ভাগ শ্রীলংকান মুর (মুসলমান), মাত্র ৪.২ ভাগ ভারতীয় তামিল। এই ভারতীয় তামিলরাই ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে তামিল টাইগার নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই শুরু করে। ভারতীয় সে দাদাগিরির প্রচুর মূল্য দিতে হয় এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে। যুদ্ধ এতই ভয়ংকর ছিল যে, একজন শ্রীলংকান প্রেসিডেন্ট, একজন প্রধানমন্ত্রী এবং একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকেও প্রাণ দিতে হয়। কিন্তু এত কিছু করেও শ্রীলংকাকে ভারত কবজা করতে পারে নি। দৃশ্যত নরওয়ের মাধ্যমে শান্তি আলোচনা চালালেও প্রায় তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধ অবসানে নেপথ্যে চীন প্রধান ভূমিকা পালন করে। জেনারেল রাজাপক্ষের নেতৃত্বে শ্রীলংকা তামিল বিদ্রোহী দমনে সফল হয়।
ইতালিতে প্রথম একজন প্রবাসী শ্রীলংকান করোনা আক্রান্ত হন ৩ মার্চ। তার অনেক আগে বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে যাত্রী কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করে শ্রীলংকা। শুরু হয় কড়া ¯্র‹িনিং। একই সাথে শিশু, অন্তঃসত্বা মহিলা, প্রবীণ নাগরিক এবং শ^াসকষ্টে ভোগা রোগীদের ভিড় এড়িয়ে চলদে পরামর্শ দেয়া হয়। চলাচলের উপর কড়াকড়ি আরোপ করে তাদের ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। ২২-সদস্যের একটি শক্তিশালী জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। সে দেশে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে কর্মরত সকল চীনা নাগরিককে বিশেষ স্বাস্থ্য নজরদারির মধ্যে রাখা শুরু হয়। তাদের চলাচলের উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু হুবেই থেকে আসা ৪৪ বছর বয়সী এক চীনা নারী পর্যটকের শরীরে ২৭ জানুয়ারি করোনা উপসর্গ ধরা পড়েবিমান বন্দর স্ক্রিনিং-এ। তাকে সঙ্গে সঙ্গে শ্রীলংকা জাতীয় সংক্রমণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তার ভ্রমণসঙ্গীদের স্বাস্থ্য ঘরবন্দি (কোয়ারিন্টিনে) করা হয়। সর্ম্পর্ণ সুস্থ হলে সেই নারী পর্যটককে হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ২৭ জানুয়ারি করোনা রোগী শনাক্তের পর শ্রীলংকায় মাস্কেও আকাল শুরু হয়, নকল মাস্কে সয়লাব হয় ফার্মেসীগুলো। সরকার কঠোর হস্তে স্বাস্থ্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি দমন করে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মত অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিষেবা বৃদ্ধি কওে এবং সংকট মোকাবেলায় সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করে। চীনের উহান থেকে থেকে ৩৩ জন ছাত্রকে ১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের এক সেনা ছাউনিতে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। মার্চের শুরু থেকে ইরান, ইতালি বা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা সকল যাত্রীকে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য ঘরবন্দি রাখা হয়।
শ্রীলংকার অভ্যন্তরে প্রথম কোন শ্রীলংকান নাগরিকের দেহে করোনা শনাক্ত হয় ১০ মার্চ। ২২ এপ্রিল সে সংখ্যা পৌঁছায় ৩৩০। একদিনে সর্বাধিক ৩৩ জন শনাক্ত হয় ২০ এপ্রিল। ২৮ মার্চ প্রথম একজন মারা যাবার পর মৃত্যু ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৭ জন প্রাণ হারায়। এরপর আর কোন মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় নি। ১৯৭ জন সুস্থ হয়েছেন। ২২৬ জনের মধ্যে ২ জনের অবস্থা শংকাজনক। বাকিরা শংকামুক্ত। প্রতি ১০ লাখে আক্রান্ত ১৬ জন, পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৪৫ জন। মোট পরীক্ষা করার সংখ্যা ৭,৩৯৩ জন। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে সাফল্যের সাথে করোনা মোকাবেলা করছে। তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান