স্বাগত বাংলা বর্ষ-১৪২৭

0

আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা সনের প্রথম দিন। বিদায়ী বছরের সব ব্যর্থতা, সব অন্যায় অবিচার কাটিয়ে নতুন বছর ১৪২৭ আমাদের জন্য বয়ে আনবে মুক্তির বারতা, এ প্রত্যাশাই করি। বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতিকে নতুন করে আত্মপরিচয়ে আগ্রহী করে তোলে। বাঙালির বড় শক্তি তার ভাষা, তার সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি শুধু গান-বাজনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যা ছড়িয়ে আছে সবার প্রতিদিনের জীবনাচরণে। এ শক্তি তাকে সাহস দিয়েছে ভাষা আন্দোলনে, স্বাধীনতা সংগ্রামে, বিভিন্ন সময়ে রাজপথে গণতন্ত্রের আন্দোলনে। যার সমাপ্তি ঘটেছে অনিবার্য বিজয় অর্জনে। পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। এ কারণে পহেলা বৈশাখের উৎসবটি অন্য আর ১০টি উৎসব থেকে আলাদা হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ উৎসবটি সবার প্রাণের উৎসব হয়। ধর্ম ও গোত্রনির্ভর উৎসবের ভিড়ে বাংলা নববর্ষ আমাদের জানিয়ে দিয়ে যায় আমাদের সংস্কৃতি মানুষে মানুষে মিলন প্রতিষ্ঠা করেÑ এ সংস্কৃতি বিভাজন ও বৈষম্যকে প্রত্যাখ্যান করে। নববর্ষের প্রাণের উৎসবে ধনী, গরিব সব এক হয়ে যায়। তবে দুর্ভাগ্য আমাদের মানব জগৎকে ধ্বংসলীলার মতো করোনাভাইরাস এবার সব কিছু থামিয়ে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে উৎসবের স্পৃহা।
ফি বছর নববর্ষের প্রথমদিকে আমাদের মন খুঁজে ফেরে শৈশব-কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে। উৎসবে ক্ষণিকের জন্য হলেও আমরা ফিরে পাই আমাদের হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে। চৈত্রসংক্রান্তি আর নববর্ষ সবার জীবনে উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। আগে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে বাংলা সনেরই প্রাধান্য ছিল। কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা আবর্তিত হতো বাংলা সালকে ঘিরে। জীবনের অনেক কাছে ছিল প্রকৃতি। প্রকৃতির সহচর্যে আমরা বেড়ে উঠেছি। আর এখন ইট, কাঠের দালানে আমরা আবদ্ধ। তবুও আমরা হারিয়ে যাইনি, হারায়নি আমাদের সংস্কৃতি। নাগরিক জীবন নববর্ষকে কেন্দ্র করে আনন্দে মেতে ওঠে। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ফিরে পাই আমরা। নববর্ষ উৎসবে সবার অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত। গ্রামীণ সমাজে এ দিনটি উদযাপিত হয় বেশ ঘটা করেই। যার প্রভাব এখন শহুরে জীবনে পড়ছে অন্যতম প্রধান উৎসব হয়ে। গ্রামের কৃষক-রাখাল থেকে শুরু করে সবাই দিনটিকে স্মরণ রাখে, আয়োজন করে বাড়তি উন্নত খাবারের। সে নতুন বছরের জন্য আশান্বিত হয়। পুরাতনকে ভুলতে চায়। আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। সে আয়োজন সরল এবং ুদ্র হলেও তার ব্যাপকতা অনেক বেশি। উৎসবের সঙ্গে অর্থনীতির একটি সম্পর্ক আছে। আমাদের কৃষিভিত্তিক সমাজ উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেই অর্থনীতি সীমিত পরিসরে সক্রিয় থাকে নববর্ষের উৎসব আয়োজনে। হালখাতা অনুষ্ঠান অর্থনীতির একটি মানবিক রূপ। দোকানিরা হালখাতা খুলে মানুষকে মিষ্টি অথবা বিরিয়ানি দিয়ে আপ্যায়িত করে। দেনা-পাওনা সব শোধ করে নতুন করে নতুন হিসাব খোলে। যদিও এসব এখন অনেক কমে গেছে। তবে উৎসবে আমেজ-ক্ষেত্র বৃদ্ধিতে সাজগোজের চাকচিক্য বেড়ে যাওয়ায় পোশাক থেকে মাছ মাংসের বাণিজ্যে এসেছে রমরমা ভাব। এভাবেই পহেলা বৈশাখ আজ জাতীয় মর্যাদা লাভ করেছে, যা আমাদের গর্বের বিষয়। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার এক অন্যতম উপাদান এ উৎসব। এ উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে আমরা ফিরে যাই ঐতিহ্যের জগতে নানা বিতর্ক ছাপিয়ে প্রত্যেক পহেলা বৈশাখের প্রভাত আমাদের জীবনে নতুন প্রত্যাশার জš§ দেয়Ñ নতুন কিছু দেয়ার প্রতিশ্র“তিতে ওঠে সুষ্ঠ ও মেতে ওঠে দিন। প্রাত্যহিক স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, নির্যাতন গণতন্ত্রহীনতা যন্ত্রণা, মানবাধিকারসহ মৌলিক অধিকার হারাবার ব্যথা ভুলে নতুন অর্জনের স্বপ্ন দেখি। তবে দুর্ভাগ্য এবার বৈশাখের কোন উৎসব আমরা করতে পারছি না। করোনার মহামারী রূপ পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে। লাখো মানুষের মৃত্যুর মিছিল কেড়ে নিয়েছে সব স্বপ্ন। প্রাণভয়ে কাতর মানুষ গৃহবন্দি হয়ে সারাক্ষণ মহান স্রসটাকে ডাকছে। আমারও সেই প্রার্থনায় সামিল। তারপরও আমরা বাঁচার স্বপ্ন দেখি, দেখি নতুন দিনের স্বপ্ন।
আমরা চাই, এ নতুন দিন নতুন বছর হোক চলমান অসহনীয় দিন ও বছর থেকে ভিন্ন। মুক্তি পাক গণতন্ত্র, বাক ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠিত হোক নাগরিক সব অধিকার। বৈশাখ তার আপন মহিমায় ঝড় তুলে তছনছ করে দিক অন্যায় অবিচার, স্বৈরাচারের মসনদ। ধ্বংসস্তুপের উপর ওড়াক নতুনের কেতন, গড়ে তুলুক প্রত্যাশিত শান্তির নীড়। আমরা দেব জয়ধ্বনী। এ প্রত্যাশা রেখে নববর্ষের শুভলগ্নে লোকসমাজ পরিবার সাংবাদিক, কর্মচারী, লেখক, পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট ও হকার সকলকেই জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।