শ্বাসকষ্ট নিয়ে চার হাসপাতালে, অতঃপর…

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা ১৫। রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল। জরুরি বিভাগের সামনেই একটি এম্বুলেন্স এসে থামলো। খানিক বাদেই স্ট্রেচারে করে নামানো হলো ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধকে। ফটকের ভেতর থেকেই দেখা গেলো তিনি হাঁপাচ্ছেন। স্বজনরা দ্রুত জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলেন। হাসপাতালে কর্মরতরা তখনও কেউ এগিয়ে আসছেন না। জরুরি বিভাগ থেকে বের করে বৃদ্ধকে বাইরে রাখতে বললেন কয়েকজন।
স্বজনরা আবার তাকে নিয়ে বাইরে রাখলেন। স্বজনরা বলাবলি করছিলেন শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তারা সত্তর বছর বয়সী ওই বৃদ্ধকে নিয়ে ছুটোছুটি করছেন। জরুরি বিভাগের কর্মীদের বারবার অনুরোধ করছেন অক্সিজেন দেয়ার জন্য। কিন্তু অভ্যর্থনা কক্ষের সামনে অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা নেই। আবার জরুরি বিভাগের ভেতরও ‘করোনা’ সন্দেহে নিতে দিচ্ছেন না কেউ। প্রায় পনেরো মিনিট এভাবে চলতে থাকে। জরুরি বিভাগের কর্মীরা ভেতর-বাহির আসা যাওয়া করছেন। একইভাবে ছুটোছুটি করছেন রোগীর স্বজনরাও। এর মধ্যে রোগীর এক স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে ওই বৃদ্ধকে মুগদায় আনা হয়েছে। তার নাম নুরু মিয়া। এদিকে ছুটোছুটির এক পর্যায়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকের পরামর্শে নুরু মিয়াকে রাখা হয় সদ্য নির্মাণ হওয়া করোনা ইউনিটে। হাসপাতাল সূত্র জানায়, এখানেই করোনায় আক্রান্তদের রাখা হবে। করোনা ইউনিটে আনা হলেও শ্বাসকষ্টে ভোগা নুরু মিয়ার জন্য অক্সিজেন মেলেনি। কারণ ওই ইউনিটে শুধুমাত্র শয্যা ছাড়া অন্য কোনো সরঞ্জামাদি স্থাপন করা হয়নি। কিছুক্ষণ পর কান্নার শব্দ আসছিল করোনা ইউনিট থেকে। কাছে গিয়ে দেখা যায় কাঁদছিলেন নুরু মিয়ার স্বজনরা। কারণ এই ১৫ থেকে ২০ মিনিট যে ব্যক্তি শ্বাস নিচ্ছিলেন তার আর কোনো সাড়া মিলছে না। এ সময় জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এসে দেখে যান। তার সহকারীরাও ছিলেন তখন। কিন্তু নুরু মিয়ার আর কোনো সাড়া মিললো না। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।
নুরু মিয়ার স্বজনরা দাবি করেন, শরীয়তপুর থেকে চিকিৎসার জন্য আসা নুরু মিয়ার গত দুই দিনে চার হাসাপাতালেও চিকিৎসা পাননি। শ্বাসকষ্টে ভুগে চার হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। নুরু মিয়ার নাতি মো. সেলিম মানবজমিনকে জানান, মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় তার দাদাকে। কিন্তু সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে বুধবার রাত অপেক্ষার পরও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সংকট থাকায় চলে যেতে হয় অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে। মো. সেলিম বলেন, আমরা শরীয়তপুর থেকে আসি। অনেক দিন ধরে দাদার শ্বাসকষ্ট। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসলে সেখানে রাখা যায়নি। দাদাকে নিয়ে কুর্মিটোলায় নিয়ে যাই। সেখানে বুধবার রাখার পর আইসিইউ না পেয়ে পদ্মা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানে তারা রাখেনি। ওইখান থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। কাঁদতে কাঁদতে সেলিম জানান, তিন চার হাসপাতাল ঘুরে তার দাদার চিকিৎসা হয়নি। এ বিষয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, লোকটি (নুরু মিয়া) আগে থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। ঘটনার বিবরণ জানিয়ে হাসপাতালটির দায়িত্বে থাকা পরিচালক ডা. শহিদ মো. সাদিকুল ইসলামের বক্তব্য জানতে চাইলে মুঠোফোনে মানবজমিনকে বলেন, আমি তো ছিলাম না। এ বিষয়ে জানি না। জেনে বলতে পারবো। করোনার আইসোলেশন ইউনিট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোন বক্তব্য তিনি শনিবারের আগে দিতে পারবেন না।
নুরু মিয়া কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউতে না থাকতে পারার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, আইসিইউর সংকট রয়েছে। আমাদের মাত্র দশটি আইসিইউ ইউনিট। রোগীদের অপেক্ষা করতে হয় অনেক সময়। শুধু আমাদের না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই। পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল থেকে নুরু মিয়াকে চিকিৎসা না দিয়ে ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ড. মোসলেহ উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনটি ধরেননি। এদিকে করোনার সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে করোনার জন্য আইসোলেশন ইউনিট খোলা হয়েছে। তবে সেখানে শুধু কয়েকটি শয্যাই দৃশ্যমান। কোনো সরঞ্জামাদি নেই। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয়া হবে। অবশ্য হাসপাতালে আসা সর্দি-কাশির রোগীদের জন্য একটি বিশেষ কক্ষ চালু রেখেছে কর্তৃপক্ষ। সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালের ১০৭ নম্বর কক্ষে এ ধরনের রোগীদের দেখা হয়। হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, সকাল থেকে অনেক রোগী আসেন শ্বাসকষ্ট, সর্দি কাশি নিয়ে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে করোনা পরীক্ষার জন্য কোনো কিট দেয়া হয়নি। তাই রোগ নির্ণয়ও করা যাচ্ছে না।