সিটি নির্বাচনে বিএনপির অর্জন

0

আমীন আল রশীদ
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে বিএনপি যে হেরে যাবে অথবা তারা যে জিততে পারবে না, সে কথা দলের প্রার্থী ও নেতারা আগে থেকেই জানতেন। যে কারণে শুরু থেকেই তাদের অবস্থান ছিল ডিফেন্সিভ। অর্থাৎ শুরু থেকেই তারা কিছু বিষয়ে তাদের বক্তব্য ও অবস্থানে এতটাই অনড় ছিলেন, যাতে ভোট শেষ হওয়া বা ফল ঘোষণার পরেই তারা এ কথা বলতে পারেন, তাদের শঙ্কাই সঠিক হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই নির্বাচনে দলটির কিছু অর্জনও হয়েছে।
১. আওয়ামী লীগের বিকল্প: গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে (নবম ও একাদশে অংশগ্রহণ করেও কম আসনপ্রাপ্তি, দশম নির্বাচন বর্জন) বিএনপির যে অর্জন, যেভাবে তাদের আসন কমেছে, যেভাবে তারা মাঠের রাজনীতি এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ অন্যান্য দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাতে অনেকেই মনে করেছিলেন, বিএনপি ধীরে ধীরে একটি প্রান্তিক দলে পরিণত হবে। যদি তাই হয়, তাহলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিকল্প কে হবে—এমন প্রশ্নও সামনে এসেছে। জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচএম এরশাদ বিভিন্ন সময়ে তার দলকে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে দাবি করেছেন। কিন্তু ঢাকা সিটি নির্বাচনে বিএনপি অন্তত এটি প্রমাণের সুযোগ পেয়েছে, জাতীয় পার্টি নয় বরং এখন পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি। কারণ এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা কোনও আলোচনাতেই ছিলেন না।
২. ভাঙনের শঙ্কা দূরীভূত: একটানা প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা প্রবল। এর মূল কারণ মামলা। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির যেসব নেতাকর্মী ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অধিকাংশই নানারকম চাপে আছেন। তাদের অনেকের মাথার ওপরে ১০-২০টি করে মামলা রয়েছে। প্রতিনিয়ত পুলিশের হয়রানি। এ অবস্থায় বহু নেতাকর্মী গত ১৫ বছরে হয় আওয়ামী লীগে ভিড়ে গেছেন, নয়তো দেশ ছেড়েছেন। অনেকে দেশে থাকলেও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। অনেকে দল করলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে আপস করে চলছেন। শুধু তৃণমূলে নয়, কেন্দ্রেও অনেক নেতা নিষ্ক্রিয়। অনেকে দল ছেড়েছেন। কেউ কেউ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এসব সংকটের ভেতরে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় কারাগারে, দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান লল্ডনে। তিনিও দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত। দেশে এলেই গ্রেফতার হবেন। এরকম বাস্তবতায় অনেকবারই গুঞ্জন উঠেছে, বিএনপি ভেঙে যাচ্ছে। বিশেষ করে কয়েকজন সিনিয়র নেতা বেরিয়ে গিয়ে আলাদাভাবে দল গঠন করবেন বলেও শোনা গেছে। কিন্তু ঢাকা সিটি নির্বাচনে বিএনপি নিজেদের এই বিভেদ ঘুচিয়ে অন্তত নেতাদের একটি প্ল্যাটফর্মে রাখতে পেরেছে। ফলে এটিও তাদের নিজেদের জন্য একটি বড় অর্জন।
৩. হরতালের মতো কর্মসূচি দেওয়ার সাহস: সরকার পতনে বিএনপির আন্দোলন-কর্মসূচি একসময় জনমনে হাস্যরসেরও জন্ম দিয়েছিল। কেননা বেশ কয়েক বছর আগে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ঈদের পরে আন্দোলন। কিন্তু যেহেতু কোনও ঈদের পরেই বিএনপি আন্দোলন জমাতে পারেনি, ফলে এরপর বিএনপি যখনই আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে, আওয়ামী লীগ তো বটেই, সাধারণ মানুষও রসিকতা করে বলেছে, কোন ঈদের পরে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ। যারা রাজপথে আন্দোলনে ব্যর্থ হয়, তারা ভোটে জেতে না। কিন্তু ঢাকা সিটি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি সত্যি সত্যিই হরতালের মতো বৃহত্তর কর্মসূচির ডাক দিলো। হরতালের মতো কর্মসূচি দিয়ে ভোগান্তি তৈরি করতে চায় না—বিএনপির পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের মতো দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বড় কোনও কর্মসূচি দেওয়ার সক্ষমতাই বিএনপির ছিল না। অথবা দলের সিনিয়র নেতারা জানতেন, বড় কর্মসূচি দিলে তারা সেটি সফল করতে পারবেন না। কিন্তু ঢাকা সিটি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি ঠিকই হরতালের মতো কর্মসূচি ঘোষণার যে সাহস পেলো, সেই সাহসের উৎসও এই নির্বাচন। অর্থাৎ কর্মসূচি সফল হোক বা না হোক, অন্তত ঘোষণার মতো সক্ষমতা যে বিএনপির হয়েছে, এটিও ঢাকা সিটির নির্বাচনে তাদের একটি বড় অর্জন বলে মনে হয়। হরতালে জনজীবন ও দেশের অর্থনীতিতে কী ক্ষতি হয়—সেটি অন্য তর্ক। কিন্তু বিএনপির লাভ হলো, তারা জনমনে এরকম একটি ধারণা দিতে পারছে, তারা এখনও প্রান্তিক দলে পরিণত হয়নি।
৪. নির্বাচন নিয়ে অভিযোগের সত্যতা: বিএনপি বহুদিন ধরেই বলে আসছে, আওয়ামী লীগের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। এজন্য তারা দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেও তারা ঠিক একই অভিযোগ করে আসছিল, আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। একটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্য হওয়ার যেসব মানদণ্ড ও মাপকাঠি রয়েছে, সেই নিক্তিতে ওজন দিলে বিগত কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন তোলাই যায়। কিন্তু বিএনপি যে রকম ঢালাও অভিযোগ করে, ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের সেই অভিযোগ করার সুযোগটি আরও বাড়লো। নির্বাচনে তারা হেরে গেলেও বা না জিতলেও রাজনীতির মাঠ যেসব কথাবার্তা বলে গরম রাখতে হয়, সেই অস্ত্রটি তাদের হাতেই থাকলো।
৫. ইভিএম বিতর্ক: বিএনপি ঢাকা সিটির নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই দাবি করে আসছিল, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে কারসাজি করা সম্ভব। ইভিএমে আসলে কতটা কারসাজি করা সম্ভব বা ঢাকার দুই সিটিতে কীভাবে এবং কতটা কারসাজি হয়েছে, সেটি প্রমাণিত না হলেও সাধারণ মানুষের মনে বিএনপি এই মেশিন সম্পর্কে যে অবিশ্বাস বা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে দিয়েছে, সেই বক্তব্যে অনড় থাকার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্বের বহু দেশ যে যৌক্তিক কারণে ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে, বিএনপি এখন সেটিও বলার সুযোগ পাবে। ফলে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোয়ও যদি এভাবে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয় এবং বিএনপি যদি সেসব নির্বাচন বর্জন করে, সেটি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য কিছুটা হলেও অস্বস্তি তৈরি করবে। যে কারণে অনেকেই ভোটের আগে বলছিলেন, ঢাকার দুই সিটিতে ইভিএমেরও একটা পরীক্ষা হবে। সেই পরীক্ষাটি হয়েছে বলে বিএনপি এখন দাবি করার সুযোগ পাবে।
৬. ইশরাক হোসেন: ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে বিএনপির মেয়র প্রার্থী, প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন পুরো নির্বাচনি প্রচারণায় যেভাবে নিজেকে এক্সপোজ করেছেন এবং যেভাবে তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, তার ভাষা ও স্মার্টনেস দেখাতে পেরেছেন, তাতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভবিষ্যতে ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে এই তরুণ একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন, যার একটি মহড়া তিনি দিয়েছেন এই নির্বাচনে। এটি ব্যক্তি ইশরাকের অর্জন হলেও একসময় বিএনপিও এর সুবিধা ভোগ করবে। কারণ দক্ষিণ ঢাকায় সাদেক হোসেন খোকার যে দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল, ইশরাক হোসেন বাবার সেই অবস্থানটি ধরে রাখতে পারবেন বলে মনে হয়। ফলে ইশরাক হোসেন এই নির্বাচনে হেরে গেলেও রাজনীতির মাঠে তিনি নিজেকে প্রমাণের জন্য একটি বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। ঢাকা উত্তরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।