তুরাগ তীরে ফরিয়াদ

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও কল্যাণ কামনায় আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে প্রথম পর্বের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা গতকাল শেষ হয়েছে। মোনাজাত চলাকালে সমগ্র ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। আমিন আমিন আলাহুমা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীর ও আশেপাশের এলাকা। ধনী-গরিব, নেতাকর্মী নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশা-গোষ্ঠীর মানুষ আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান সকলেই মহান আলাহর দরবারে নিজেকে সমর্পণ করে নিজ নিজ গুনাহ মাফের জন্য আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বাংলাদেশের তাবলীগের মারকাজের মুরব্বি কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা জোবায়ের। বেলা ১১টা ৮ মিনিট থেকে মোনাজাত শুরু হয়ে চলে ১১টা ৪৬ মিনিট পর্যন্ত। ৩৮ মিনিটের মোনাজাতে আরবি ভাষায় ‘রাব্বানা জালামনা আনফুসিনা’ দিয়ে শুরু করা হয়। এ মোনাজাতে দেশি-বিদেশি প্রায় ৪০-৪৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নেন বলে ধারণা করছে আয়োজকরা।
মোনাজাতের সময় লাখো মুসল্লি দু’হাত তুলে আমিন আমিন করে মহান আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা করেন। মোনাজাতে অংশ নিতে কনকনে শীতের মধ্যেও বাদ ফজর থেকে লাখ লাখ মুসল্লি চারদিক থেকে ইজতেমা ময়দানের দিকে আসতে থাকে। এ সময় টঙ্গী হয়ে ওঠে সকল পথের মোহনা। আগামী শুক্রবার ১৭ই জানুয়ারি থেকে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্বের মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে ১৯শে জানুয়ারি রোববার।
দোয়ায় হে আল্লাহ, রোগে আক্রান্তদেরকে শেফা দান করেন। হে আল্লাহ, বিশ্ব ইজতেমাকে কবুল করেন। হে আল্লাহ, আমাদের দোয়া কবুল করেন ইত্যাদি গভীর আকুতি-মিনতিপূর্ণ ভাষায় মোনাজাত করা হয়। আবেগঘন আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতে গিয়ে মাওলানা মো. যোবায়ের কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লির মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। কান্নার শব্দে পুরো ইজতেমা এলাকাসহ আশেপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠে। মোনাজাত চলাকালে দক্ষিণে বিমানবন্দর, উত্তরে গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার, পূর্বে পুবাইলের মাঝু খান এবং পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত অন্তত প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মুঠোফোন, রেডিও এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সমপ্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসলিম মোনাজাতে অংশ নেন। স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের ৭৩টি দেশের ২ হাজার ১০৩ জন তাবলীগ অনুসারী বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়। এটি ছিল ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। আখেরি মোনাজাতকে ঘিরে গোটা বাংলাদেশের নজর ছিল টঙ্গীতে। মোনাজাতে শরিক হওয়ার জন্য দিনটি সরকারের ঐচ্ছিক ছুটি ছিল এ এলাকায়। ৩৮ মিনিটের মোনাজাতে মাওলানা মো. যোবায়ের প্রথম ১৬ মিনিট মূলত পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। শেষ ২২ মিনিটে বাংলা ভাষায় দোয়া পরিচালনা করেন। গতকাল বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের সমাপনী দিনে স্বাগতিক বাংলাদেশ ও বিদেশি তাবলীগ মুরব্বিগণ গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েতি বয়ান করেন।
মুসল্লিদের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার: রোববার সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল টঙ্গীর দিকে। টঙ্গী হয়ে উঠেছিল সকল পথের মোহনা। আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ টঙ্গী অভিমুখে ছুটতে থাকেন শনিবার থেকে। বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীরা ছাড়াও কেবলমাত্র আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিগণ বাস, ট্রাক, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ট্রেন, লঞ্চ ও ট্রলারে করে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করে। রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন ভিড় এড়াতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা উপেক্ষা করে রাতেই টঙ্গীমুখো হয়। টঙ্গী ও রাজধানী ঢাকার সরকারি- বেসরকারি অফিস, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ছিল পূর্ণ ছুটির আমেজ। রোববার ভোররাত থেকে টঙ্গীমুখো সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় দীর্ঘ পথ হেঁটে টঙ্গী পৌঁছতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। কয়েক লাখ মানুষ কনকনে শীতের মধ্যে রাতেই ইজতেমার মাঠ কিংবা আশেপাশের বাসাবাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদ কিংবা করিডোরে এমনকি গাছতলায় অবস্থান নেন। রোববার ভোররাত থেকে যানবাহন শূন্য সড়ক-মহাসড়ক ও নদীপথে টুপি পাঞ্জাবি পরা মানুষের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার শুরু হয়। চারদিকে যত দূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ। সকাল ৬টার মধ্যে গোটা এলাকা জনতার মহাসমুদ্রে পরিণত হয়। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এদিকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে আগের তুলনায় মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী মহিলাকে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে টঙ্গী পৌঁছে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। মোনাজাতে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ইজতেমার চারপাশে প্রায় ৪ কি.মি. এলাকা পর্যন্ত শাখা সড়কগুলোতে মাইক টানিয়ে দেয়া হয়। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দেশের দূর-দূরান্ত ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষ এসে যোগ দেয়ায় ইজতেমা ময়দান ছাড়িয়ে টঙ্গী, উত্তরা ও তুরাগ থানার প্রতিটি রাস্তাঘাট, বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ, খেলার মাঠে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
ফিরতি যাত্রায় বিড়ম্বনা: আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর এক সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ফিরতে শুরু করলে সর্বত্র মহাজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী স্টেশনে ফিরতি যাত্রীদের জন্য অপেক্ষমাণ ট্রেনগুলোতে উঠতে মানুষের জীবনবাজির লড়াই ছিল উদ্বেগজনক। ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদে ও দরজা-জানালায় ঝুলে শত শত মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে মানুষের জন্য ট্রেন দেখা যাচ্ছিল না। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ফিরতি মুসল্লিদের বিড়ম্বনা ও কষ্টের সীমা ছিল না। চার-পাঁচ দিন ধরে টঙ্গীতে জমায়েত হওয়া মুসল্লিরা জোহরের নামাজের পর একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরতে চাইলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। হাজার হাজার বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর ও মহিলা মাইলের পর মাইল হেঁটে মোনাজাতে শরিক হন এবং একইভাবে ফিরেন। বিকালে সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
২০২১ সালে ওলামা মাশায়েখদের দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমার ঘোষণা: আগামী ২০২১ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশের ওলামা মাশায়েখদের বিশ্ব ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আখেরি মোনাজাতের পরপরই বয়ান মঞ্চের মাইকে তা ঘোষণা করা হয়। আগামী ৮-৯-১০ই জানুয়ারি প্রথমপর্ব মাঝে ৪ দিন বিরতি দিয়ে ১৫-১৬-১৭ই জানুয়ারি-২০২১ ইং দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রথম পর্বে মুসল্লির মৃত্যু: বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আসা ১৪ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আরো তিন মুসল্লি মারা গেছেন। শনিবার বিকালে ও রাতে তাদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় গত চারদিনে ১৪ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমার পুলিশ কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, শনিবার বিকাল সোয়া ৫টায় কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থানার গুচিহাটা গ্রামের নুর ইসলাম (৫৫), রাত সাড়ে ১০টায় কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাব্রাম এলাকার আলী আহমদ (৬০) ও রাত পৌনে ১টায় জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার আব্দুল মোমিন (৫৬) মারা যান। বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে গত বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল রোববার আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত ১৪ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।