মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের তথ্যে ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কোনও যৌক্তিক কারণ নেই বলে মনে করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপরও বেড়েছে এই নিত্যপণ্যের দাম। অনেকটাই স্থির হয়ে আসা পেঁয়াজের বাজার নতুন করে কেন অস্থির হয়ে উঠলো? এ বিষয়ে এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য কাজে লাগিয়ে অনৈতিক মুনাফা করা হয়। এ জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা কখনও পণ্যের সরবরাহ সংকট, কখনও মজুত সংকটের অজুহাত দেখান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের সর্বশেষ ঘটনা ঘটলো গত বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি)। আগামী রমজানের আগাম প্রস্তুতি উপলক্ষে বৈঠক ডেকেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠকে রমজানের নিত্যপণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, ডাল, ছোলা, খেজুর, ভোজ্যতেল ও চিনির মজুত, আমদানি, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সূত্র জানায়, ওই সভায় শুরুতেই পেঁয়াজ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে রোজা শুরু হবে। ওই সময় দেশে উৎপাদিত নতুন পেঁয়াজে বাজার সয়লাব থাকার কথা থাকলেও দাম ও সরবরাহ কতটা আয়ত্তে থাকবে তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, রোজা সামনে রেখে পেঁয়াজ নিয়ে কোনও ধরনের ঝুঁকি নিতে পারবো না। কাজেই চলমান পেঁয়াজ আমদানি প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। এ সময় সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, তাহলে শুধু রোজাকে কেন্দ্র করে সিটি, মেঘনা, এস আলম গ্রুপ এবং টিসিবি— এই চার প্রতিষ্ঠান ৫০ হাজার টন করে মোট ২ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করবে। যেহেতু আমদানিকৃত পেঁয়াজ জাহাজে আনতে কমপক্ষে ৪৫ দিন সময় লাগে, সেহেতু আজ থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু করা হোক।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, সভায় পেঁয়াজ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর আশঙ্কা এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর পরামর্শ—এই দুই তথ্যকে কাজে লগিয়ে ওই দিনই পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ে। পরদিন শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম এক লাফে বাড়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। খুচরা বাজারে যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০০ টাকা। অসাধু ব্যবসায়ীরা বুঝে গেছেন, যেহেতু ৪৫ থেকে ৫০ দিন পরে আমদানি করা পেঁয়াজ আসবে, তখন দেশি পেঁয়াজও থাকবে। তাই অতিরিক্ত মুনাফার জন্য এই ৫০ দিন বেছে নিয়েছে তারা। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা প্রথম বলেছিলেন, কৃষকরা বেশি দামের আশায় মাঠ থেকে আগেভাগে পেঁয়াজ তুলে ফেলেছেন। তাই দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজের সরবরাহ শেষ। এ কারণে দাম বেড়েছে। পরদিন শনিবার থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ব্যবসায়ীরা আবার জানিয়েছেন, বৃষ্টির কারণে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। অথচ কৃষকরা জানান, বৃষ্টিতে মাঠের পেঁয়াজের কোনও ক্ষতি হয়নি।
২০০৯ সালে চিনি নিয়েও এমন ঘটনা ঘটেছিল বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সেই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির ফলে চিনি আমদানির এলসি কম খোলা হয়। এ কারণে ওই বছর রমজানে সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে বলে আভাস দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিধি। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাজধানীর মৌলভীবাজারের কয়েকজন চিনি ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে একজন বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই সভা থেকে বেরিয়ে ফোন করে সংকটের বিষয়টি জানিয়ে দেন। বৈঠক শেষ হওয়ার পরপরই চিনির দাম বাড়তে থাকে, পরবর্তীতে যা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। বিষয়টি সংবাদকর্মীদের মারফত সেই সময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান জেনেছিলেন এবং ওই ব্যবসায়ীকে মন্ত্রণালয়ের সভায় আমন্ত্রণ জানানো বন্ধ করেছিলেন বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। জানতে চাইলে পেঁয়াজ আমদানিকারক হাজী মাজেদ বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহে সংকট দেখা দেওয়ায় চাহিদা বেড়েছে, তাই দাম বেড়েছে। এখানে কারও কোনও কারসাজি নেই বলে দাবি করেন তিনি। মাজেদ জানান, সরবরাহ বাড়লেই দাম কমে যাবে। এদিকে পেঁয়াজের বাজার নতুন করে অস্থির হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (৬ জানুয়ারি) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া প্রেসনোটে বলা হয়েছে, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ, মূল্য তদারকিতে বাজারে অভিযান চালানো হবে। ব্যবসায়ীদের পণ্যের আমদানি মূল্য, ক্রয়মূল্যের চালান ও রসিদ সংরক্ষণে রাখার অনুরোধ করা হচ্ছে। দোকানে বিক্রয় মূল্যের তালিকা টাঙিয়ে রাখার অনুরোধ করা হচ্ছে। অন্যায়ভাবে কোনও ব্যবসায়ীকে হয়রানি করা হবে না। কারসাজি বা অন্যায়ভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুত করলে, মূল্য বাড়ালে বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্ট করলে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রেসনোটে আরও বলা হয়েছে, বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ রয়েছে। এরপরও পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। কাজেই পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কোনও কারণ নেই। জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কোনও কারণ নেই। বৈঠকে দেওয়া তথ্য নিয়ে কেউ যদি অনৈতিক মুনাফা করেন তাহলে আগামীতে বৈঠকে এ বিষয়ে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা হবে বলে জানান তিনি।উল্লেখ্য, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। তখন পর্যায়ক্রমে দাম বাড়তে বাড়তে তা ২৭০ টাকা কেজিতে ওঠে। দেশি পেঁয়াজ উঠতে শুরু করায় এবং আমদানির কারণে দাম কমে ১০০ টাকায় নেমেছিল। তবে গত কয়েকদিন ধরে আবার বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।