যেসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। ধর্ষককে গ্রেপ্তারে যে কোনো সময় খবর আসতে পারে। ঘটনাস্থলের অদূরের সিসি ক্যামেরার কয়েকটি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও ভুক্তভোগীর বর্ণনা অনুযায়ী আসামিকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার চেষ্টার অগ্রগতি হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ইতিমধ্যে ভুক্তভোগীর সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেছেন। তারা ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ধর্ষকের শারীরিক আকৃতি, চেহারা কেমন ছিল সেটি জানার চেষ্টা করছেন। সে মোতাবেক সন্দেভাজন বেশ কয়েকজনের ছবি এনে তাকে দেখিয়েছেন। ভুক্তভোগী ছাত্রী তদন্ত সংশ্লিষ্টদের বলেছেন ধর্ষকের সামনের দুটি দাত ছিল না। ডিএমপির ক্যান্টনমেন্ট থানায় রোববার রাতে ভুক্তভোগীর বাবা বাদী হয়ে করা ধর্ষণ মামলাটির দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়েছে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তরের একটি টিমের কাছে। পাশাপাশি মামলার ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব, পিবিআই ও সিআইডির পৃথক টিম। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ঘটনার আশেপাশে কোনো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ না পেয়ে ঘটনাস্থলের অদুরের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও গলফ গার্ডেনের ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে আসামি শনাক্তের চেষ্টা করছেন। কেউ আগে থেকে ওই শিক্ষার্থীকে অনুসরণ করছিলো কিনা সেটিও বুঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। র‌্যাব ও ডিবি কর্মকর্তারা এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
ওই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলছে না। গতকাল ঢাবিতে বিক্ষোভ চলাকালে তার বিভাগের এক শিক্ষার্থী বক্তব্য প্রদানকালে বলেন, কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে ৫ জন এক সঙ্গে নামার পর তিনজন একদিকে অন্য দুজন আরেক দিকে যান। ওই সময় সম্ভবত ধর্ষিতার মোবাইলে কল আসার কারণে বাকিদের সঙ্গে ভুক্তভোগীর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যদি সত্যিই তার মোবাইলে কোনো কল আসে তবে সেই ব্যক্তিটি কে? এছাড়া ভুক্তভোগী যখন ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলো তখন তার সহপাঠিরা বা ওই ফুটপাত দিয়ে কি একেবারেই মানুষের চলাচল ছিল না? কারণ ভুক্তভোগীর বর্ণনা অনুযায়ী সময় তখন আনুমানিক সন্ধ্যা সাতটার মত। এমনকি তার বর্ণনা অনুযায়ী ধর্ষক তাকে গলায় টিপ দিয়ে একাই নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। তখন কি ধর্ষককে আর কেউ সহযোগিতা করেনি। তার একার পক্ষেই কি মেয়েটিকে নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? এমনকি ধর্ষণের সময় মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সে কি ন্যাচারেলি জ্ঞান হারিয়েছে নাকি তাকে সেন্সলেস করা হয়েছে। আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কেনইবা ধর্ষক ঘটনাস্থলে অবস্থান করবে। এসব প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ওদিকে ভুক্তভোগীর সব ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার রিপোর্ট চিকিৎসকদের কাছে এসেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী বোর্ডের চিকিৎসা চলছে। ঢামেকসূত্র জানিয়েছে, মেডিকেল বোর্ডের সদস্যদের কাছে ভুক্তভোগী জানিয়েছে এখনও তিনি গলা, বুক ও পেটের ব্যাথায় ভুগছে। জানিয়েছেন, হঠাৎ করেই তার মুখ চেপে ধরে নিয়ে যায় পাশের নির্জন স্থানে। তারপর তার পেটে বুকে লাথি মেরে ফেলে দেয় ধর্ষক। একপর্যায়ে সে তার নাম জানার চেষ্টা করে।
সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ধর্ষণ মামলার তদন্ত হচ্ছে: পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনাটি মর্মান্তিক এবং খুবই দুঃখজনক। ঘটনাটি শোনার পর থেকে বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি দিয়ে মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। যে বা যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। গতকাল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে পুলিশ সপ্তাহ-২০২০ এর অনুষ্ঠানে আইজিপি ব্যাজ বিতরণ শেষে তিনি এসব কথা বলেন। আইজিপি বলেন, ঘটনাটি আমাদের নলেজে আসার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) ক্রাইম সিন পরিদর্শনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পাঠানো হয়েছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও পুলিশের অন্যান্য ইউনিটও সেখানে গেছে। সেখান থেকে ক্রাইম সিনে যেসকল আলামত পেয়েছেন সেগুলো সংগ্রহ করে ফরেনসিকের জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, র‌্যাবসহ সবগুলো ইউনিট একযোগে কাজ করছে। আমরা খুবই আশাবাদী কারণ অন্যান্য যে ঘটনাগুলো অতীতে হয়েছে প্রত্যেকটি ঘটনার রহস্য আমরা উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। ঢাবি শিক্ষার্থীদের ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম নিয়ে আইজিপি বলেন, যেকোনো ঘটনার তদন্ত করতে সময় লাগে। একেকটি ঘটনার তদন্ত একেকরকম। কোনো ঘটনা কয়েক মিনেটের মধ্যেই আবিষ্কার হয়ে যায়। কোনোটি আবার সময় লাগে। তদন্ত তার নিজস্ব যে প্রক্রিয়া আছে সে প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। সময় ধরে তদন্ত হয় না। আমরা শুধু এটুকু বলতে চাই সবাই মিলে চেষ্টা করছি। আমাদের প্রত্যেকটা টিম অত্যন্ত আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। এটি আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি সেটি ফিক্সড করেই চেষ্টা করছি। যতসম্ভব দ্রত গতিতে বিষয়টি উদঘাটিত করার চেষ্টা করছি এবং সেটি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদঘাটিত হবে।
ধর্ষককে দেখলে চিনতে পারবে মেয়েটি: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বলেছেন, আমি মেয়েটিকে দেখতে এসে তার সঙ্গে কথা বলেছি। মেয়েটি অত্যন্ত সাহসী সে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। সে জানিয়েছে আসামিকে দেখলে চিনতে পারবে। তার মাঝারি গঠন। তাকে দেখলে সবকিছু সে বলতে পারবে। সে যেহেতু আসামির চেহারার একটি বর্ণনা দিতে পারছে অবিলম্বে একটি স্কেচ এঁকে আসামি শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা করা হয় সেটি আমি বলেছি। এছাড়া তার বুদ্ধিমত্তায় আলামত নষ্ট হয়নি। এখন পরীক্ষা করে ডিএনএ মিলিয়ে প্রকৃত ধর্ষককে শনাক্ত করা কঠিন হওয়ার কথা না। সাহস আর মনের জোরের কারণে মেয়েটির অবস্থার দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির শারীরিক অবস্থা দেখতে এসে তিনি এসব কথা বলেন। ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, মেয়েরা কি এতই সহজ? শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই যৌন সহিংসতার শিকার হবে। এখানে ওসিসিতে পুলিশ, চিকিৎসক, এডভোকেট সবাই আছে তাদেরকে মেয়েটির যাবতীয় সব সহায়তার দেওয়ার কথা বলেছি। ঢাবির শিক্ষার্থী ছাড়া এখানে আরো আটজন ভিকটিম আছেন। তাদের সবার মামলার মনিটরিং করব এবং বিচার ও আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে মনিটরিং করব। বলেন, ডিএনএ ল্যাবটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। ডিএনএ অধিদপ্তরের অধীনে জাতীয় সার্ভারে ডিএনএ নমুনা সংরক্ষিত থাকলে এ ধরনের অপরাধীকে ধরা অনেক সহজ হত। আলামত পরীক্ষা করে ডিএনএ মিলিয়েই ধর্ষণকারীকে চিহ্নিত করা যেত। তাতে এ ধরনের অপরাধ কমে যেত।
অবস্থার উন্নতি হয়েছে: ধর্ষণের শিকার মেয়েটির শারীরিক অবস্থা উন্নতি হয়েছে। ২/৩ দিনের ভেতরে তাকে ছাড়পত্র দেয়া হবে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। গতকাল সকালে ঢামেকে মেয়েটির শারীরিক অবস্থার খবর জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সাত সদস্যর মেডিকেল বোর্ড মেয়েটিকে দেখেছে। ফাইনালি তারা তার ফিজিক্যাল কন্ডিশনের কোনো ট্রমা পাননি। উনি মানসিকভাবে যথেষ্ট ডিপ্রেসিভ ছিলেন। আমাদের মনোচিকিৎসক আছেন তিনি কিছু ম্যানেজমেন্ট দিয়েছেন। সার্বিকভাবে আগের দিনের চেয়ে স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে। সাত সদস্যর মেডিকেল বোর্ড চাইলে ২/৩ দিনের ভেতরে তাকে ছাড়পত্র দিতে পারবো।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার: এদিকে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ঢাবির ওই শিক্ষার্থী যে স্থানে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ওই স্থানের আশেপাশের দুটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। এখন ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আসামি শনাক্তের চেষ্টা চলছে। ডিএমপির গুলশান জোনের উপ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের কিছু ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ধর্ষককে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করাই সবার লক্ষ্য। আশা করছি সেটা সম্ভভ হবে। প্রথম থেকেই মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। সোমবার রাতে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাবি শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় মামলার এজাহার গ্রহণ করেছেন আদালত। এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখও নির্ধারণ করেছেন। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম ইয়াসমিন আরা মামলার এজাহারটি গ্রহণ করে ২৮ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেছেন। রোববার রাতেই ভুক্তভোগীর বাবা ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন। প্রাথমিক তদন্ত ও যাচাই-বাছাই শেষে পরেরদিন দুপুরে অভিযোগটি মামলা হিসাবে গ্রহণ করা হয়।
প্রসঙ্গত, রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে রওয়ানা দেন ওই শিক্ষার্থী। রাস্তা ভুল করে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নামেন। এরপর ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় অজ্ঞাত কেউ তার মুখ চেপে ধরে সড়কের পেছনে নির্জন ঝোপে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ধর্ষণের পাশপাশি শারীরিক নির্যাতন করে ধর্ষক। রাত ১০টার দিকে যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে তখন একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বন্ধুর বাসায় গিয়ে তাকে সবকিছু খুলে বলেন। রাত ১২টার দিকে তাকে এনে ঢাকা মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়। পরের দিন ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগে পরীক্ষা নীরিক্ষার পর তার শরীরে ধর্ষণের আলামত রয়েছে বলে জানান, ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহলে মাহমুদ।