পাচার অর্থের তথ্য সংগ্রহ: সুইজারল্যান্ড কানাডা মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন গোয়েন্দারা

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এলেও সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সেসব দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সহজে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অভিযুক্ত অর্থ পাচারকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আর্থিক বা কর গোয়েন্দা কর্মকর্তা পাঠানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আগামীকাল সোমবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এ বিষয়ে সভা হওয়ার কথা রয়েছে।
সূত্র জানায়, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেখানে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে- সেসব দেশ থেকে অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ সংবলিত একটি প্রতিবেদন তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি। ওই কমিটির সমন্বয় সভায় সম্প্রতি পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে ডুয়াল ক্রিমিনালিটি, তথ্য সংগ্রহে দীর্ঘসূত্রিতা ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ না করাসহ বিভিন্ন আইনি জটিলতা তুলে ধরা হয়। ওই সভায় এসব জটিলতা নিরসনে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশনে স্বল্প সময়ের জন্য কর গোয়েন্দা পাঠানোর প্রস্তাব ওঠে আসে। বলা হয়, এসব কর গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাংলাদেশ মিশনে ২ থেকে ৩ মাসের জন্য কাজ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি ছাড়া এসব বিষয়ে কেউ কোনো ধরনের তথ্য দিতে চায় না। রয়েছে আইনগত জটিলতাও। একটি অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে গেলে ওই বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্র্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট আর্থিক বা কর গোয়েন্দাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড গত নভেম্বরে যে রিপোর্ট দিয়েছে সে অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে যত টাকা কর আদায় হয়, তার প্রায় ৩৬ শতাংশের সমান বিদেশে পাচার হয়ে যায়। সংস্থাটি বলেছে, আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সিংহভাগ অর্থ পাচার করা হচ্ছে। এর আগে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্র্যাটি (জিএফআই) গত বছরের জানুয়ারিতে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে সেখানেও অর্থ পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশের নাম ওপরের দিকে তালিকাভুক্ত হয়। বিশ্বের ১৪৮টি দেশের মধ্যে অর্থ পাচারের দিক থেকে ১৯তম স্থানে ছিল বাংলাদেশের নাম। জিএফআইর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বা সাড়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছিল। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের এই পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ফাঁস হয় প্যারাডাইস পেপারসের ১ কোটি ৩৪ লাখ নথি। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) ওই নথি তদন্ত করে। দেখা যায়, উত্তর আটলান্টিক সাগর তীরের ছোট্ট দেশ বারমুডায় নামমাত্র কর দিয়ে নামে-বেনামে কোম্পানি গঠন করে মূলধন পাচারের তালিকায় অন্যদের সঙ্গে কয়েকজন বাংলাদেশি প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর নামও ওঠে আসে। ওই সময় এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে তথ্য চেয়েও পায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে থেমে নেই রাষ্ট্রীয় দফতরগুলো। এদিকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বা এর ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাবেক উপপ্রধান ম. মাহফুজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার মনে হয় না বিদেশে কর গোয়েন্দা পাঠিয়ে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কোনো কাজ হবে। এ ধরনের কোনো কর্মকর্তা গিয়ে তথ্য চাইলেও পাবে না। কারণ এটি খুবই জটিল প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, দুই প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রথমত, পাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে মামলা করতে হবে। স্থানীয় আদালতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় দিতে হবে। আদালতের এ রায়ের কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস অর্থ ফেরত দেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে ওই দেশের আদালতে মামলা করবে। অর্থ ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। উপরন্তু ওপরের প্রক্রিয়াটি কেবলমাত্র সরকারি টাকা বা দুর্নীতি করে টাকা পাচার করার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। এর বাইরে আমদানি-রপ্তানি বা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অর্থ পাচারের বিষয়ে তথ্য পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসব তথ্য কোনো ব্যাংক দেয় না, কোনো আইনও নেই। এক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের কোনো সুযোগ থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দিয়েই সেই তথ্য পেতে পারে।