বাণিজ্যমেলার তৃতীয় দিনেও অব্যবস্থাপনা

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার তৃতীয় দিন পার হলেও অব্যবস্থাপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেক স্টল-প্যাভিলিয়নে পুরোদমে চলছে নির্মাণ কাজ। আবার বেশকিছু পড়ে আছে ফাঁকা। অলিতে-গলিতে পড়ে রয়েছে নির্মাণ সামগ্রী। এছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার হলেও জমজমাট ছিল না মেলা প্রাঙ্গণ। মেলা ঘুরে দেখা গেছে, সকালের দিকে লোকসমাগম কম থাকলেও, বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে দর্শনার্থীদের সমাগম বাড়তে থাকে। প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে এমন স্টল-প্যাভিলিয়নে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখছেন স্টলগুলো। কেউ কেউ কেনাকাটাও করেছেন। এদিকে দ্রুত কাজ শেষ করার আশ্বাস দিলেও এই অব্যবস্থাপনার দায় নিতে চায় না ইপিবি ও পিছিয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানের কেউই।
মেলাজুড়ে স্টল-প্যাভিলিয়ন সাজানো গোছানোর নিরন্তর চেষ্টা চলছে। এখনও কেন প্রস্তুত নয়? এমন প্রশ্নে তারা বলছেন, দেরিতে কাজ বুঝে পাওয়ার কথা। তারা বলেন, কাল দোকান পেয়েছে কালই কাজ শুরু হয়েছে। মেলা শুরুর পর কম দামে দোকান পাওয়া যায়। আগে কাজ পেলে আগে কাজ শেষ করতে পারতাম। এসব কিছু যেমন সাজানো গোছানো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সমস্যার কারণ, তেমনি দর্শনার্থীদের চোখেও দৃষ্টকটু। এমন কাজকর্ম ও নোংরা পরিবেশ, দৃষ্টিনন্দনভাবে সেজে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রি ও প্রচারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানালেন স্টল কর্মকর্তারা। তারা বলেন, আমরা ভালো থাকলে কি হবে? চারপাশ তো নোংরা। সেল করতে সমস্যা। এদিকে মেলার সিলভার জুবলি উদযাপনের এই বছরে- আয়োজক প্রতিষ্ঠান ইপিবির প্রস্তুতিও ভালো। কমানো হয়েছে স্টল-প্যাভিলিয়নের সংখ্যা, বাড়ানো হয়েছে টিকিটের দাম। তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও উন্নয়নের নানা চিত্র। তবে কেন প্রতিবছরের অব্যবস্থাপনার পুনরাবৃত্তি এবছরেও? এর কোন সঠিক উত্তর না থাকলেও দায় নিতে চান না মেলার বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা ইপিবির কর্মকর্তারা।
এদিকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার হলেও বৃষ্টিতে জনশূন্য ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার তৃতীয় দিন। এদিন ভোর থেকেই হালকা বৃষ্টি হওয়ায় দর্শনার্থী ও ক্রেতা সাধারণের মেলায় আসতে বেগ পেতে হয়। ওয়ালটন প্লাজায় কর্মরত বিক্রয় ব্যবস্থাপক আব্দুল হিমেল বলেন, বুঝেছিলাম আজ দর্শনার্থীদের সংখ্যা কম হবে। তবুও আমাদের তো আসতে হয়। তবে দিনের শুরুতে ক্রেতাশূন্য হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শনার্থী বাড়ছে বলে তারা জানান। দর্শনার্থী সুমাইয়া ইসলাম বলেন, ঢাকায় ছিলাম। আজই বাড়ি যাচ্ছি। ভেবেছিলাম আজ মেলা ঘুরে যাবো। এমনিতে শেষের দিকে প্রচুর ভিড় থাকে। তাই ভাবলাম শুরুর দিকে মেলা ঘুরে যাই। ফাঁকা স্টলে ‘কাড়াকাড়ি অফারের’ ব্যানার: প্রতিবারই বাণিজ্য মেলায় ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকে বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এবারও ব্যতিক্রম নয়। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার শুরুতেই ছাড় দিচ্ছে অনেক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান। তবে মেলার তৃতীয় দিনেও একটি স্টলের ব্যানারে ‘কাড়াকাড়ি অফার’ এর উল্লেখ থাকলেও সেখানে দেখা মেলেনি কোনো পণ্যের। মেট্রো শপিং বিডি নামের ওই স্টলের ব্যানারে লেখা রয়েছে, ‘কাড়াকাড়ি অফার এক সেট ৩৫০ টাকা, তিন সেট ৯৯৯ টাকা’। মেলার প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গেলেই স্টলটি দেখা যাবে। এমনকি স্টলটিতে কোনো মানুষের আনাগোনাও দেখা যায়নি। তবে স্টলটির ভেতরে ও বাইরে কিছু কাঠের র‌্যাক পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ফাঁকা স্টলে এমন অফার ঝুলিয়ে রাখায় মেলার দর্শনার্থীদের অনেককে বিরক্তি প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। রাইদা নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘স্টলে কোনো কিছু নেই। অথচ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে কাড়াকাড়ি অফার। এ থেকেই বোঝা যায় এ স্টলের পণ্যের মান কত ভালো হবে।’
৩০% ছাড়ে ইতালিয়ানোর পণ্য: মেলার শুরুতেই ক্রেতা-দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় দিচ্ছে দেশের বৃহৎ প্লাস্টিক ও মেলামাইন পণ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান আরএফএল। মেলায় প্রতিষ্ঠানটির ইতালিয়ানো ব্র্যান্ডের প্যাভিলিয়নে যেকোনো পণ্য কিনলেই থাকছে নিশ্চিত ১০ শতাংশ ছাড়। তবে এ ব্র্যান্ডের ডিনারসেট, প্লেট, বাটি এবং গ্লাস কিনলেই মিলছে ৩০ শতাংশ মূল্যছাড়।
মেলায় ইতালিয়ানোর প্যাভিলিয়নটি ঘুরে দেখা গেছে, এক ছাদের নিচেই রাখা হয়েছে কিচেন, ক্লিনারসহ বিভিন্ন স্টেশনারি পণ্য। একই সঙ্গে রয়েছে মেলামাইনের বাহারি সব পণ্য। গ্রাহকদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ প্যাকেজও। ছাড়ে অর্থাৎ কম দামে বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করতে ভিড় করছেন ক্রেতা-দর্শনার্থীরা।
ইসলামী ব্যাংকের নান্দনিক প্যাভিলিয়ন: মেলায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্যাভিলিয়ন উদ্বোধন করা হয়েছে। মেলার ৫৯ নম্বর প্রিমিয়ার প্যাভিলিয়নটি উদ্বোধন করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. মাহবুব উল আলম। মেলার মূল ফট?ক দিয়ে প্রবে?শ করলেই হাতের বাম পা?শে চোখে পড়বে ইসলামী ব্যাংকের প্রিমিয়ার প্যাভিলিয়ন। যেখানে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
প্যাভিলিয়ন বিদেশি ভেতরে বাংলাদেশি!: বিদেশি প্যাভিলিয়ন কিন্তু ভেতরে সবই বাংলাদেশি। বিদেশিরা প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ নিয়ে বাংলাদেশিদের কাছে স্টল বিক্রি করেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেসব স্টলে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি পণ্য। অন্যদিকে, মেলায় অংশ নেওয়া অনেক বিদেশি স্টলেও স্থানীয় প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। অর্থাৎ বিদেশ থেকে এসে মেলায় কেউ অংশ নেননি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সদুত্তর দিতে পারেনি। গতকাল শুক্রবার মেলার তৃতীয় দিনে গিয়ে এসব চিত্রই পাওয়া গেল। এবার মেলায় বাংলাদেশসহ ২১টি দেশ অংশ নিয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসেবে, বিদেশি প্যাভিলিয়ন ২৭টি, বিদেশি মিনি প্যাভিলিয়ন ১১টি এবং বিদেশি প্রিমিয়ার স্টলের সংখ্যা ১৭টি।
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, বিদেশি প্যাভিলিয়নগুলোর মধ্যে পাকিস্তানি প্যাভিলিয়নের একটি স্টলে সেই দেশেরই কর্মীর দেখা মেলে। আর ভারত প্যাভিলিয়নে ভারতের দুটি স্টলে ভারতীয় কর্মীর দেখা মিলেছে। এছাড়া বিদেশি আর কোনো প্যাভিলিয়নে গিয়ে বিদেশি কর্মীর দেখা মেলেনি। বিদেশি প্যাভিলিয়ন ৬। এটি বরাদ্দ নিয়েছেন বিদেশিরা। সেখানে ৪টি স্টল রয়েছে। বাকি স্টলগুলো নির্মাণের কাজ চলছে। কিন্তু ৪টি স্টলেই বাংলাদেশি পণ্যে সয়লাব। এই প্যাভিলিয়নের ফ্রেন্ডস গিফট কর্নারে সব বাংলাদেশি পণ্য। বিদেশি প্যাভিলিয়নে কেন বাংলাদেশি পণ্য জানতে চাইলে স্টলটির বিক্রয় কর্মী সাদাদ বলেন, এই প্যাভিলিয়ন বিদেশিরা বরাদ্দ নিয়ে বাংলাদেশিদের কাছে স্টল বিক্রি করেছেন। তাই তারা বাংলাদেশি পণ্য বিক্রি করছেন। প্যাভিলিয়ন-৫ ভুটান প্যালেস। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি স্টলে রয়েছে সব বাংলাদেশি। সেখানকার বিক্রয় কর্মীরাও বাংলাদেশি। তাদেরও একই বক্তব্য, বিদেশিরা প্যাভিলিয়ন নিয়ে বাংলাদেশিদের কাছে বিক্রি করেছে। তাই তারা বাংলাদেশি পণ্য বিক্রি করছেন। প্যাভিলিয়ন ১৫, দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে গিয়েও দেখা মিলেছে বাংলাদেশি পণ্য আর বাংলাদেশি বিক্রয়কর্মীদের। এখানেও যেমন নেই বিদেশি কর্মীর তেমনি বিক্রিও হচ্ছে না বিদেশি কোনো পণ্যের। থাইল্যান্ড প্যাভিলিয়নে গিয়ে ওই দেশের পণ্যের দেখা মিললেও কোনো বিদেশি কর্মীর দেখা মিললো না। পাকিস্তানি প্যাভিলিয়নে গিয়ে একজন পাকিস্তানি কর্মীর দেখা মিললেও বাকি স্টলগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীর দেখা মেলে। কয়েকটি স্টলে পাকিস্তানি শাড়ি, থ্রিপচ রয়েছে। আর বাকি স্টলে বাংলাদেশি পণ্যে সয়লাব। এখানকার পাকিস্তানি কর্মীরাও কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে, বিদেশি অন্যান্য প্যাভিলিয়নগুলো ঘুরেও বিদেশি কোনো কর্মীর দেখা মেলেনি। বিদেশি পণ্যের দেখা মেলাও দায়। সব স্টলেই বাংলাদেশি পণ্য থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আয়োজনকারীরা জানান, মেলা আগামী ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে। এ বছর প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য টিকিটের দাম বাড়িয়ে ৪০ টাকা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।